পথে পথে ছড়ানো শিল্প

ম্যানহোলের ঢাকনায় বিচিত্র নকশা। জাপানের সাইতামা অঞ্চলের কাওয়াগুচি এলাকা l ছবি: এএফপি
ম্যানহোলের ঢাকনায় বিচিত্র নকশা। জাপানের সাইতামা অঞ্চলের কাওয়াগুচি এলাকা l ছবি: এএফপি

ঢাকার রাস্তায় চলতে-ফিরতে প্রায়ই চোখে পড়ে ঢাকনাহীন ম্যানহোল বা নর্দমার মুখ। কর্তৃপক্ষের এই অবহেলায় মাঝে মাঝে ঘটে দুর্ঘটনা। হাত-পা ভাঙে পথচারীর, নষ্ট হয় যানবাহন।

ঢাকায় যখন এই অবস্থা, জাপান তখন ম্যানহোলের সেই ঢাকনাকেই বেছে নিয়েছে শিল্প আর ঐতিহ্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। নানা নকশা আঁকা ঢাকনায় ঢেকে দেওয়া হয়েছে রাজধানী টোকিও থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত হাজারো ম্যানহোলের মুখ।

জাপানে দেড় হাজারের বেশি শহর-বন্দর-গ্রামের সড়কে এখন কিছু পরপর ম্যানহোলের মুখে নকশা আঁকা ঢাকনার ছড়াছড়ি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ঢাকনায় ‘হ্যলো কিটি’র দেখা মিলবে। জাপানের কার্টুন চরিত্র হ্যালো কিটি দেশটিতে বেশ জনপ্রিয়। নকশা বাছাইয়ের সময় এই বিষয়টি মাথায় রেখেছিল কর্তৃপক্ষ। শুধু তা-ই নয়, এলাকাভেদে নকশারও ভিন্নতা আনা হয়েছে। ফলে এসব নকশা কেবল সৌন্দর্যের বিষয় নয়, একই সঙ্গে ইতিহাস ও লোকজ ঐতিহ্যের সাক্ষীও হয়ে উঠেছে। যেমন প্রাচীন শহরগুলোয় গেলে দেখা মিলবে দুর্গ আঁকা ম্যানহোলের ঢাকনার। বন্দর এলাকায় মিলবে সেতু আঁকা ঢাকনার।

এত কিছুর পরও কিন্তু জাপানে সব ম্যানহোলে নকশাযুক্ত ঢাকনা নেই। মোটের ওপর দেশটিতে প্রায় দেড় কোটি ম্যানহোল রয়েছে। সে তুলনায় অল্প কিছু সংখ্যক ম্যানহোলে নকশার দেখা মিলবে। দেশটিতে নকশা ছাড়া একটি ঢাকনার দাম পড়ে প্রায় ৬০০ মার্কিন ডলার। এ ক্ষেত্রে বর্ণময় নকশা আঁকা ঢাকনার দাম প্রায় দ্বিগুণ।

হ্যালো কিটির ছবি আঁকা নকশা
হ্যালো কিটির ছবি আঁকা নকশা

রাজধানী টোকিওর পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকা তামায় গেলে হ্যালো কিটি আঁকা বেশ কিছু ম্যানহোলের ঢাকনার দেখা মিলবে। এখানকার বাসিন্দারা মনে করছেন, এতে ওই এলাকা আরও বেশি পর্যটন-আকর্ষী হয়ে উঠবে। এখানকার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান মিকিও নারাশিমা বলেন, ‘পর্যটকেরা যদি এখানে এসে হ্যালো কিটি ম্যানহোলগুলো দেখতে দেখতে কিছু সময় কাটান, তাহলে আমরা খুবই খুশি হব।’

ফুকুই শহরে দুটো ম্যানহোলে বসানো হয়েছে ফিনিক্স পাখি আঁকা ঢাকনা। বিষয়টি বেশ আগ্রহী করে তুলেছিল মধ্যবয়সী শোজি মুরিমোতোকে। তিনি বলেন, ওই আগ্রহ থেকেই তিনি ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেন। পরে জানতে পারেন, ১৯৪৫ সালে এই শহরে মার্কিন বিমান হামলা এবং এর তিন বছর পর প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের পর ফুকুইয়ের আবার উত্থানের প্রতীক ছিল রূপকথার পাখি ফিনিক্স। শোজি মুরিমোতো বলেন, ‘আমি কিছু সময় এটা নিয়ে গবেষণা করেছি। ম্যানহোলের ঢাকনার নকশাগুলো এই শহরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে বুঝতে পেরে আমি অভিভূত।’ তাঁর মতে এই অভাবনীয় উদ্যোগ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গুপ্তধন (ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বোঝানো হয়েছে) অনুসন্ধানের সুযোগ করে দিয়েছে।

কেবল নকশা আঁকা ম্যানহোলের ঢাকনা বসিয়েই থেমে থাকেনি কর্তৃপক্ষ। কোথাও কোথাও এগুলোর পাশেই রোপণ করা হয়েছে লতাজাতীয় উদ্ভিদ। এই গাছগুলো ম্যানহোলের চারপাশে বিস্তৃত হয়ে এগুলোর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

নকশায় ফিনিক্স পাখি
নকশায় ফিনিক্স পাখি

গত বছরের শেষ দিকে ম্যানহোলের নকশাযুক্ত ঢাকনা বসানোর কার্যক্রম শুরু করে কর্তৃপক্ষ। এ জন্য গত নভেম্বর মাসে জাপানের পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় ‘ম্যানহোল সম্মেলনের’ আয়োজন করা হয়। তিন হাজারের বেশি মানুষ এতে যোগ দেন। তবে এবারই প্রথম যে জাপানে ম্যানহোলের নকশাযুক্ত ঢাকনার ব্যবহার শুরু হয়েছে, তা কিন্তু নয়। দেশটির এই ঐতিহ্য চার দশকের। এবার কেবল নকশাগুলো উন্নত ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।