শুক-সারি শঙ্কর ও কৌশল্যার গল্প

বিয়ের দিন শঙ্কর ও কৌশল্যা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
বিয়ের দিন শঙ্কর ও কৌশল্যা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

শঙ্করের জীবনের শেষ দিনটি ছিল রোববার। সকাল নয়টার দিকে ঘুম থেকে ওঠেন তাঁরা। তিনি ও তাঁর স্ত্রী কৌশল্যা থিবর। বাসে করে তামিলনাড়ুর তিরুপুর এলাকার একটি বাজারে যান তাঁরা। কলেজের অনুষ্ঠানের জন্য শঙ্করের জন্য নতুন পোশাক কেনা হবে।

কাঠফাটা রোদ ছিল সেদিন। দোকানে ঘুরতে ঘুরতে এটি গোলাপি রঙের শার্ট পছন্দ করেন কৌশল্যা। এটাতেই শঙ্করকে মানাবে ভেবে কিনে নেন তিনি। পরে অবশ্য সবুজ একটি শার্ট খুব পছন্দ হয় শঙ্করের। গোলাপিটা পাল্টে ওটাই নিয়ে নেন তাঁরা। অসম্ভব খুশি ছিলেন দুজন। স্বপ্নমাখা দুটি মুখ।

দোকান থেকে বের হয়ে কিছু খাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিল তাঁদের। কিন্তু পকেটে মাত্র ৬০ রুপি। কৌশল্যা শঙ্করকে বলেন, ‘আজ থাক, আরেক দিন হবে। আজ বাসায় গিয়ে তোমার প্রিয় খাবার রান্না করব।’ কৌশল্যা ভাবতেও পারেননি, এই আরেক দিন তাঁদের জীবনে আর কখনোই আসবে না। আশপাশে ঘুরতে শুরু করেছে যমদূত।

২০১৬ সালের ১৩ মার্চ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থী দলিত যুবক শঙ্কর খুন হন। ২২ বছরের শংকরকে দিনদুপুরে ব্যস্ত রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মারাত্মক আহত হন তাঁর স্ত্রী কৌশল্যাও। শঙ্করের অপরাধ, তিনি উচ্চবর্ণের মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন।

কৌশল্যা দলিত সম্প্রদায়ের শঙ্করকে বিয়ে করায় তাঁর পরিবার ক্ষুব্ধ ছিল। তারা বারবারই কৌশল্যাকে শঙ্করের কাছ থেকে আলাদা করতে চেয়েছে। ঘটনার আগের দিন মা-বাবা এসে কৌশল্যাকে শাসিয়েও যান। বলেন, ‘কিছু ঘটলে তার জন্য আমরা দায়ী থাকব না।’ এই ‘কিছু’ যে এত ভয়ংকর, তা আঁচ করতে পারেননি দুজন।

তবে কীই–বা করতে পারতেন শঙ্কর আর কৌশল্যা? তাঁরা যে ভালোবেসেছিলেন! মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের মেয়ে কৌশল্যা। বাবা আর্থিক লেনদেন ও ট্যাক্সি অপারেটরের পেশায় আছেন। পালানি শহরে তাঁদের দোতলা বাড়ি। অন্যদিকে দিনমজুর বাবার ঘরে কষ্টেসৃষ্টে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন শঙ্কর।

ছোটবেলায় বিমানবালা হওয়ার স্বপ্ন ছিল কৌশল্যার। কিন্তু স্কার্ট পরতে হবে বলে বাবা সায় দেননি। ২০১৪ সালে স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার পরই মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। মেয়ে রাজি না হওয়ায় পরে একটি বেসরকারি কলেজে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পড়তে পাঠানো হয়। খুব কঠোর ছিল কলেজের নিয়মকানুন। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসা যাবে না, কারও সঙ্গে কথা বলা যাবে না। ভীষণ কড়াকড়ি। এরপরও ভালোবাসা এসেছিল।

কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে ঢ্যাঙা ছেলেটা এসে কৌশল্যাকে বলেছিল, ‘তুমি কি কাউকে ভালোবাস?’ সেদিন শঙ্করকে কিছু বলতে পারেননি কৌশল্যা। সলাজ অনুভূতি নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরদিন আবার এসেছিলেন শঙ্কর। কোনো জবাব নেই।

তৃতীয় দিন শঙ্করকে অন্য কাউকে পছন্দ করতে বলেন কৌশল্যা। তাঁর ভয় ছিল পরিবার নিয়ে। তবে একসময় দুটি মনের মিলই হলো। সমাজ-পরিবারের ভয়ে গুটিয়ে থাকলেও ভালোবাসা পালাল না। কৌশাল্যাকে নিজের স্বপ্নের কথা বলতেন শংকর, একটা সুন্দর বাড়ি বানাবেন আর নিরন্তর তাঁকে ভালোবেসে যাবেন। বেশ কাটছিল দুজনের দিন।

২০১৫ সালের জুলাইয়ে পরিচিত একজন দুজনকে দেখে ফেলেন। এ কথা কৌশল্যার মাকে জানান তিনি। ওই দিন বিকেলে কৌশল্যার ফোন নিয়ে নেন বাবা-মা। শঙ্করের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলেন। শঙ্করকেও দূরে থাকতে সতর্ক করেন। পরদিন কলেজ থেকেও ছাড়িয়ে আনেন মেয়েকে।

সারা রাত কেঁদেছিলেন কৌশল্যা। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেন, বাড়িতে কেউ নেই। খুঁজতে খুঁজতে ঘরেই পেয়ে যান ফোনটা। শঙ্করের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর পালিয়ে যান তাঁরা। একটি মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করেন। এরপর জীবনের আট মাস ছিল তাঁদের সবচেয়ে সুখের সময়। অভাব, কষ্ট—কোনো কিছুই যেন প্রভাব খাটাতে পারেনি তাঁদের ছোট্ট সংসারে। একটা ছোট চাকরি জুটে যায় কৌশল্যার। মাসে পাঁচ হাজার রুপি বেতন।

এরপর আসে ওই ভয়ংকর দিন, ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, শঙ্কর ও তাঁর স্ত্রী কেনাকাটা সেরে ফিরছিলেন। এ সময় তিনটি মোটরবাইকে করে ছয় ব্যক্তি এসে আক্রমণ করে তাঁদের। জনাকীর্ণ সড়কে পাঁচজন মিলে দুজনকে ছুরিকাঘাত করে। আর একজন প্রত্যক্ষ করছিল পুরো বিষয়টি। হামলাকারীরা কৌশল্যার উদ্দেশে চিৎকার করে বলে, ‘কেন তুমি তাকে ভালোবেসেছ, কেন?’ মাত্র ৩৬ সেকেন্ডে পুরো ঘটনা ঘটিয়ে আবার বাইকে চড়ে পালিয়ে যায় তারা। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকেন শঙ্কর ও কৌশল্যা।

২০১৬ সালের ১৩ মার্চ দিনদুপুরে ব্যস্ত বাজারে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থী দলিত যুবক শঙ্কর খুন হন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে।
২০১৬ সালের ১৩ মার্চ দিনদুপুরে ব্যস্ত বাজারে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থী দলিত যুবক শঙ্কর খুন হন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে।

ঘটনাস্থলে দ্রুত একটি অ্যাম্বুলেন্স আসে। অ্যাম্বুলেন্সে নিজের ব্যথা ভুলে স্ত্রীর রক্তাক্ত মাথা বুকের ওপর নিয়ে বসে ছিলেন শঙ্কর। তবে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মারা যান তিনি। তাঁর শরীরে ৩৪টি আঘাত লেগেছিল। আর ক্ষতবিক্ষত শরীরে হাসপাতালে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছিলেন কৌশল্যা।

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। তবে এটা তো কোনো গল্প ছিল না। এটি ছিল বর্ণবাদের এক বলি, পারিবারিক সম্মান রক্ষার নামে একটি হত্যাকাণ্ড। তাই জীবনের টানে ফিরে আসেন কৌশল্যা। ছোটবেলা থেকেই যে তাঁর খুব সাহস। এই সাহস নিয়ে ঘুরে দাঁড়ান তিনি। কারাতে শেখেন, দলিত সম্প্রদায়ের মতো ঢোল বাজাতে শেখেন। ছোট করে ফেলেন চুল। আরও আত্মপ্রত্যয়ী হন। লড়াই শুরু করেন বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে।

পুলিশি তদন্তে এই হত্যাকাণ্ডে কৌশল্যার বাবা-মায়ের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। তদন্তে বের হয়ে আসে, তাঁদের হত্যা করার জন্য পাঁচজনকে ৫০ হাজার রুপিতে কৌশল্যার বাবাই ভাড়া করেছিলেন। নিজের মেয়ে ও জামাইকে হত্যা করতে বলেছিলেন প্রকাশ্যে। নিম্নবর্ণের হয়ে উচ্চবর্ণের কাউকে ভালোবাসলে কী পরিণতি হয়, সেই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন তিনি সমাজকে। ১২০ জন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল এ ঘটনার। আদালতে ৫৮ বার বাবা-মায়ের জামিনের আবেদনের বিপক্ষে লড়েন কৌশল্যা। বারবার সাক্ষ্য দেন তাঁদের বিরুদ্ধে।

অবশেষে গত বছরের ডিসেম্বরে আদালত রায় দেন। রায়ে কৌশল্যার বাবাসহ ছয়জনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। কৌশল্যার মাসহ দুজনকে দেওয়া হয় কারাদণ্ড। তবে মায়ের শাস্তির বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করেছেন কৌশল্যা। তাঁর মতে, মায়েরও মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। তিনিও সমান অপরাধী।

বর্ণবাদ নিয়ে এখন পড়াশোনা করছেন কৌশল্যা। সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ যে অর্থ তিনি পেয়েছেন, তা দিয়ে শঙ্করের পরিবারের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া গ্রামের গরিব শিশুদের পড়ান তিনি। তবে পরিবার চালানোর জন্য ছোট একটি চাকরি নিতে হয়েছে তাঁকে। সাপ্তাহিক ছুটিতে তামিলনাড়ুর গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান তিনি। বর্ণবাদের বিষমুক্ত করতে মানুষকে সচেতন করেন। ভালোবাসার গুরুত্ব তুলে ধরেন।

‘ভালোবাসা পানির মতো। এটা প্রাকৃতিক। ভালোবাসা হয়ে যায়, নারীদের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এটা বন্ধ করতে হবে’—এমনটাই মনে করেন কৌশল্যা।

বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে শাকিলা হক