স্ত্রীর স্মৃতি ফেরাতে

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সাত দিন ধরে বিয়ের খুঁটিনাটি সব আয়োজন নিয়ে তিনি তুমুল ব্যস্ত ছিলেন। পাঁচ দশক আগে যা যা করেছিলেন, হুবহু তা–ই করেছেন। খাবারের মেন্যু থেকে শুরু করে কনের মালা—এই সবকিছু করতে গিয়ে সেই দিনগুলোর কথাই তাঁর মনে পড়ছে। যেদিন বাবার অমতে তাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মেয়েটি। সেই একই রকম ভালোবাসা এখনো বোধ করছেন সেই ‘মেয়েটি’র প্রতি। শুধু সময় আর পরিস্থিতি ভিন্ন।

৫৫ বছর পর স্ত্রীকে আবার বিয়ে করলেন তিনি। চিকিৎসকের পরামর্শে সবকিছু ভুলে যাওয়া স্ত্রীর স্মৃতি ফেরাতে আবার বিয়ের আয়োজন করেছেন তিনি। এর আগে স্ত্রীর স্মৃতি ফেরাতে তাঁর পিতৃপুরুষের আদি ভিটা বাংলাদেশও ঘুরে গেছেন। সিনেমার কাহিনিকেও যেন হার মানায় এ গল্প। আজ সোমবার দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া অনলাইনের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে অশীতিপর এক দম্পতির বিয়ের কথা।

বাস্তবের এই গল্পের দুজন হচ্ছেন ৮৩ বছর বয়সী পবিত্র নন্দী এবং ৮১ বছর বয়সী গীতা নন্দী। এই দম্পতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দমদমের বাসিন্দা। গত রোববার সেখানে তাঁদের রবীন্দ্রনগরের বাসায় মালাবদলের সময় বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছিলেন গীতা। আলঝেইমারে আক্রান্ত গীতা নন্দী অতীতের সবকিছুই ভুলে গেছেন। গত সাত বছরে এ রোগ ধীরে ধীরে তাঁর সব স্মৃতি মুছে ফেলেছে।

গীতা নন্দী নিজে একজন চিকিৎসক ছিলেন। আর পবিত্র নন্দী ছিলেন উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক।

পবিত্র জানান, চিকিৎসক হিসেবে গীতা তাঁর রোগীদের সবকিছু মনে রাখতে পারতেন। এমনকি ছয় মাস পর আসা রোগীকেও তিনি চিনতে পারতেন। কিন্তু আলঝেইমায় আক্রান্ত হওয়ার পর গীতা এখন নিজের স্বজনদেরও চিনতে পারেন না।
গীতা এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার শুরুতেও এই দম্পতি অনেক ব্যস্ত ছিলেন। পবিত্র ব্যস্ত থাকতেন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। আর গীতা যুক্ত হয়েছিলেন সমাজসেবায়। বি আর সিংহ হাসপাতাল থেকে অবসর নেওয়ার পর গীতা রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি মিউনিসিপ্যালটির চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল মনোনীত হন। এই দায়িত্বে থাকায় সারা দিন তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হতো। একদিন তিনি বললেন, তিনি এটা-সেটা ভুলে যাচ্ছেন। পবিত্র প্রথমে ভাবলেন বয়সের সঙ্গে এমন ভুলোমন হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু দিনে দিনে তা বাড়তেই লাগল। পবিত্র তখন সন্দেহ করলেন বিষয়টি স্বাভাবিক নয়, এটা অন্য কিছু। এর পরের কয়েক বছরে গীতা ধীরে ধীরে সবকিছুই ভুলে গেলেন।

পবিত্র নন্দী বলেন, ‘ ওঁর বাবা-মার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। ওঁ আমার ক্লাসে আসত, আমি তাঁর প্রেমে পড়ি। হয়তো তাঁর বাবা-মার ইচ্ছা ছিল ধনী ও সফল কারও সঙ্গে বিয়ে দেওয়া। আমার মতো অধ্যাপকের সঙ্গে নয়।’ তিনি জানান, দমদমে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে গীতার কয়েকজন চাচাতো ভাইবোনের উপস্থিতিতে তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরও গীতা পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং তিন বছর পর চিকিৎসক হন।
নিজেদের মধুর সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ঝগড়া করতাম। কিন্তু তা বেশিক্ষণ টিকত না। গীতা চুপ করে থাকত। আর ওঁ চুপ থাকলে আমার একদম ভালো লাগত না।’
পবিত্র জানান, চিকিৎসার একপর্যায়ে চিকিৎসক পরামর্শ দেন গীতার পিতৃপুরুষের আদি নিবাস বাংলাদেশ থেকে ঘুরিয়ে নেওয়ার জন্য। তাই করেছিলেন পবিত্র। কিন্তু তা কোনো কাজে আসেনি। এরপরই স্মৃতি ফেরাতে সেই সময়ের মতো আবার বিয়ের পরামর্শ দেন চিকিৎসক।
নিঃসন্তান এই দম্পতি তাঁদের সঞ্চয়ের সবটুকু দিয়ে দিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি ট্রাস্ট। এই ট্রাস্টের তহবিল থেকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা হয়। ট্রাস্টের জন্য তাঁরা দোতলা বাড়ির নিচতলা ছেড়ে দিয়েছেন।
এক হাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে পবিত্র বলেন, ‘সময়ে সময়ে ভয় গ্রাস করে আমাকে। আমাদের দুজনেরই বয়স হয়ে গেছে। আমি যদি ওর দেখাশোনা না করতে পারি তাহলে কী হবে ওর? কিন্তু যখন তার চোখে হাসির ঝিলিক দেখি, আমার সব ভয় উবে যায়।’