আফ্রিকার লৌহমানবী: জনতার হৃদয়ে থাকবেন?

এক নজরে সারলিফ
* ১৯৩৮ সালে রাজধানী মনরোভিয়ায় জন্ম
* হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা
* ১৯৭৯: অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ
*১৯৮০: সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশত্যাগ
*১৯৯৭: নির্বাচনে পরাজিত হলেও দেশে ফেরেন
*২০০৬: প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ
*২০১১: শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন
*২০১২: দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ
* ২২ জানুয়ারি, ২০১৮: ক্ষমতা হস্তান্তর
সূত্র: বিবিসি

সমর্থক-ভক্তদের কাছে তিনি লৌহমানবী। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিজ দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। শুধু নিজ দেশেরই নন, তিনি আফ্রিকা মহাদেশেরই প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখায় নোবেল পুরস্কারেও ভূষিত হন। তিনি লাইবেরিয়ার সদ্যবিদায়ী প্রেসিডেন্ট ইলেন জনসন সারলিফ (৭৯)। গতকাল সোমবার তাঁর এক যুগের শাসনক্ষমতার সমাপ্তি হলো।

আফ্রিকার এই লৌহমানবীকে কীভাবে মনে রাখবে মানুষ? নানা সাহসী ভূমিকার জন্য প্রশংসিত হলেও দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এক দল তাঁকে নিজেদের জন্য ‘আশীর্বাদ’ বলে মনে করে, তবে অন্যরা তাঁকে মনে করেন আর দশজনের মতোই। ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার কয়েক দিন আগে নিজ দল থেকেও বহিষ্কৃত হন তিনি। অভিযোগ, দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেননি তিনি।

লাইবেরিয়ার তরুণী জেনেহ সেবোর (২২) চোখে সারলিফ দেশে শান্তি এনেছেন, ‘সারলিফ সবচেয়ে ভালো যে কাজটি করেছেন, সেটা হলো তিনি আমাদের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন।’ এই তরুণীর মন্তব্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই। টানা প্রায় ১৪ বছর পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটিতে চলছিল বর্বরতা, অবাধ মাদক ব্যবসা, চরম বিশৃঙ্খলা। এ সময় ‘শিশু সেনারা’ অচিন্তনীয় সব অপরাধ করত। অসংখ্য বিদ্রোহী গোষ্ঠী দেশটির বিভিন্ন শহর-নগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। অবকাঠামো বলতে কিছু ছিল না। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ল্যাম্পপোস্ট—কিছুই ঠিক ছিল না। এ পরিস্থিতি থেকে দেশকে স্থিতিশীল পর্যায়ে আনার জন্য তিনি সবার কাছেই ধন্যবাদ পাওয়ারই কথা।

বয়সে তরুণী জেনেহ সেবো অবশ্য এত কিছু মনে করতে পারবেন না। তবে ৭৩ বছর বয়সী কুলা ফ্রিম্যানের কথায়ও তরুণী জেনেহ সেবোর কথারই প্রতিধ্বনি মেলে। লাইবেরিয়ার পুরো পরিস্থিতিই দেখেছেন তিনি। কুলা বলেন, সারলিফ দেশে শান্তি এনেছেন। আর আগের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ফিরতে চাই না।

নোবেল পুরস্কার হাতে ইলেন জনসন সারলিফ। ছবি: রয়টার্স
নোবেল পুরস্কার হাতে ইলেন জনসন সারলিফ। ছবি: রয়টার্স

প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষের দেশটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান সারলিফ। তাঁর সঙ্গে অবদান রাখায় সহযোগী মিজ জিবোয়িও একই সঙ্গে নোবেল পান। একসময়ের সহযোদ্ধা সারলিফ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সারলিফ লাইবেরিয়া তথা আফ্রিকার প্রথম নির্বাচিত নারী প্রেসিডেন্ট। এটা তিনি অর্জন করেছেন। তবে নারীদের ইস্যুগুলোতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর যে ভূমিকা আমরা চেয়েছিলাম, সেটা পাইনি। আর তিনি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন।’

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সারলিফের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ থাকলেও ২০০৬ সালে ক্ষমতা নেওয়ার তিন বছরের মধ্যেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির প্রায় ৫০০ কোটি ডলার ঋণ শোধ করেন। বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যান দেশকে। দেশের বার্ষিক বাজেট আট কোটি ডলার থেকে বাড়িয়ে ২০১১ সালে নিয়ে যান সাড়ে ৫১ কোটি ডলারে। তবে মিজ জিবোয়িও তাঁর কাছে নারীদের ইস্যুতে আরও বেশি ভূমিকা প্রত্যাশা করেছিলেন। সারলিফের সময় ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি প্রণয়ন করা হয়। যদিও পরে শাস্তি কিছুটা শিথিল করা হয়। তবে ক্ষমতা ছাড়ার শেষ সপ্তাহে তিনি গৃহ সহিংসতা বন্ধে একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। আর ক্ষমতা ছাড়ার মাত্র দুদিন আগে তিনি ১৮ বছরের কম বয়সী কন্যাশিশুদের খতনা বন্ধের একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। এটাও নারীদের প্রতি সহিংসতা রোধের পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

অনেকে ভেবেছিলেন সারলিফ নারীদের রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করবেন। তিনি ক্ষমতা থেকে গেলেও অনেক নারীকে রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে পাবেন। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১৯ প্রার্থীর মধ্যে মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন নারী প্রার্থী। তিনি আবার নতুন প্রেসিডেন্ট সাবেক ফুটবলার জর্জ উইয়াহর বান্ধবী মাদেলা কুপার। কুপার বলেন, সারলিফ পার্লামেন্টে পর্যাপ্ত নারী সদস্য আনতে পারেননি। নারী ইস্যুগুলোতে পর্যাপ্ত অর্থও বরাদ্দ করেননি তিনি।

লাইবেরিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট সারলিফ। ছবি: রয়টার্স
লাইবেরিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট সারলিফ। ছবি: রয়টার্স

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বলছে, সারলিফের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠে যখন তাঁর তিন ছেলেকে সরকারের উচ্চপদে নিয়োগ দেন। তাঁর পরিবারের অন্তত ২০ জন সদস্য সরকারের কোনো না কোনো পদে যোগ দেন। দুর্নীতিকে ২০০৬ সালে সারলিফ ‘জনগণের এক নম্বর শত্রু’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

নানা কারণে সরকারের বেসামরিক কর্মীদের মাঝেমধ্যে বেতন বন্ধ থাকত সারলিফের সময়। লোফা কাউন্টির চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট কর্মীদের অবস্থা ছিল করুণ। তাঁর সময় ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ মারা যায়।

তবে সর্বোপরি কথা হলো সারলিফ ইতিহাস গড়েছেন। তাঁর শাসনামলে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগ থাকলেও তিনি বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও একজন নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন। গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত বিশৃঙ্খল একটি দেশকে তিনি সুযোগ্য নেতৃত্বে স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। আর দেশটিতে ৭০ বছরের মধ্যে এই প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হলো। এ ক্ষেত্রেও ইতিহাস গড়লেন সারলিফ।