বিহারে ধরে এনে বিয়ে!

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বিয়ের আসরে বসে বর কেঁদেকেট আকুল। পাশেই বিয়ের সাজে বসেছে কনে। পাশ থেকে খুব বিরক্তি নিয়ে একজন বলছেন, ‘আমরা তো তোমাকে ফাঁসি দিচ্ছি না, বাপু!’ একজন বয়স্ক নারীকে দেখা গেল বরের চোখ মুছে দিতে। সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া দুই মিনিটের এই ভিডিও অনেকেই দেখেছেন। এমন খাপছাড়া দৃশ্য সাধারণত বিয়েতে দেখা যায় না। পরে তা বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। ভিডিওটি দেখে বেচারা বরের জন্য কারও কারও সহানুভূতি জেগেছে। কেউ কেউ হাস্যরসও করেছেন।

গণমাধ্যমের বদৌলতে অনেকেই জেনে গেছেন, কাঁদতে থাকা এই বর কে। বরের নাম বিনোদ কুমার (২৯)। একটি প্রতিষ্ঠানে কনিষ্ঠ ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনার শহরতলিতে তাঁকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। বিহারে এ ধরনের বিয়ে ‘পাকারুহা শাদি’ বা ‘ধরে এনে বিয়ে’ নামেই বেশি পরিচিত, যেটাকে কেতাবি ভাষায় লেখা হচ্ছে ‘শটগান ওয়েডিং’ বা অস্ত্রের মুখে বিয়ে। কিন্তু কেন এই ‘শটগান ওয়েডিং’? যা তথ্য বেরিয়েছে তাতে দেখা গেছে, বিনোদ একাই এমন ঘটনার শিকার নন। দশকের পর দশক ধরে বিহারে এমন ঘটনা ঘটছে। হাজার হাজার ছেলে এমন অপহরণের পর জোরপূর্বক বিয়ের শিকার হচ্ছে।

দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং দ্য ইন্ডিয়া টুডেতে শটগান ওয়েডিং নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে এ ধরনের বিয়ের ঘটনা ও কারণ তুলে আনা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অতিমাত্রায় যৌতুক দাবি এবং আইনের প্রতি অবজ্ঞা এ ধরনের গুরুতর অপরাধের মূল কারণ। যৌতুকের জন্য কনের পরিবারকে যত অর্থ ব্যয় করতে হয়, এর চেয়ে অনেক কম খরচ হয় অপহরণের কাজে। অপহরণকারীরা কম খরচেই বর তুলে আনার কাজটি করে দেয়।

আশির দশকে বিহারের বেগুসারাই, সামস্তিপুর, পাটনা ও লক্ষ্মীসারাই জেলাগুলোতে বিয়ের জন্য বর তুলে আনার ঘটনা প্রথম শোনা যায়। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এ ঘটনা রীতিমতো রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। অজস্র গল্পের উপাদান হয়েছে এসব ঘটনা। হিন্দি ও ভোজপুরি ভাষায় এই কাহিনি নিয়ে তথ্যচিত্র এবং সিনেমাও তৈরি হয়েছে। এ ধরনের বিয়ের পর কনেরাও পড়েন সমস্যায়। এক মেয়ে জানান, বিয়ের পর বরের বাড়িতে গিয়ে দেখেন সবাই শোকাহত। কিন্তু তিনি যেভাবে হোক সংসার টেকাবেন বলে দৃঢ় ছিলেন। চার বছর চেষ্টার পর বরের পরিবার তাঁকে মেনে নেয়।

শুরুতে শটগান ওয়েডিংয়ের ঘটনা ঘটা শুরু করেছিল উচ্চবর্ণের ভূমিহার এবং পশ্চাৎপদ শ্রেণির ওবিসি (আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস) যাদবের মধ্যে। ভারত সরকার সামাজিক ও শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা বর্ণের লোকজনকে শ্রেণিভুক্ত করতে ওবিসি শব্দটি ব্যবহার করে। বিনোদ একজন ওবিসি। বিনোদের ঘটনাটি বুঝিয়ে দিয়েছে, অপহরণ করে বিয়ে হলেও বর্ণ ও গোত্র ( নির্দিষ্ট একটি বর্ণের মধ্যে উপশাখা) নিয়ে সতর্কতা বজায় রাখা হয়েছে।

বিষয়টি তুলে ধরে এশীয় উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের পাটনাভিত্তিক সমাজবিষয়ক গবেষক শৈবাল গুপ্তা বলেন, এ ধরনের বিয়ের মধ্যেও বর্ণ-গোত্রের বিষয়ে সতর্কতা বজায় রাখা হয়েছে। একই বর্ণের মধ্যে শটগান ওয়েডিংয়ের ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে না। এমনকি গোত্রের ক্ষেত্রেও সামঞ্জস্য রাখা হচ্ছে। উচ্চগোত্রের একজন ছেলে নিম্নগোত্রের মেয়েকে বিয়ে করতে পারেন। কিন্তু জোরপূর্বক বিয়েতে একজন রাজপুত্রের সঙ্গে ভিখিরির বিয়ে হতে দেখা যায় না সাধারণত।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় যৌতুক দাবি এবং আইনের প্রতি অবজ্ঞাকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এক পুলিশ কর্মকর্তার ভাষায়, মেয়েটির পরিবার যৌতুকের চেয়ে বর তুলে আনতে অপহরণকারীকে আরও কম খরচে ভাড়া করতে পারে।

শটগান ওয়েডিংয়ের একটি সত্য ঘটনার ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন ভারতীয় নির্মাতা অমিতাভ ভার্মা। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে বরকে নিখুঁতভাবে বিয়ের যাবতীয় সব কাজে বাধ্য করা হয়। মেয়েটির পরিবার চায়, মেয়েটি যেন তাড়াতাড়ি গর্ভধারণ করে ছেলেটির ওপর নৈতিক ও মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেটি একপর্যায়ে সবকিছু মেনে নিয়ে সংসার করতে থাকে।

এ ধরনের বিয়ের জন্য কুখ্যাত নাওয়াদা জেলার শিক্ষক অশোক প্রিয়দর্শী বলেন, যৌতুকের মতো ভয়াবহ প্রথার কারণেই বর তুলে এনে বিয়ের ঘটনা ঘটছে। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে একটি পরিবারের ওপর সাধ্যের বাইরে চাপ সৃষ্টি করা হয়। এই এলাকায় ছেলের পরিবারগুলোর মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে অর্থ বানানো একটি বাণিজ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যায়, অপহরণ করে বিয়ে দেওয়ার পর ছেলের পরিবারের সঙ্গে অনেক কম অর্থে যৌতুক বিষয়ের রফাদফা হয়।

বিহার পুলিশ বিয়ের জন্য বর অপহরণের আলাদা কোনো ডেটা সংরক্ষণ করে না। পালিয়ে বিয়ের ঘটনাও এতে ধরা হয়। রাজ্যের অপরাধবিষয়ক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১০ সালে বিয়ের জন্য অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৭০২টি। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা প্রায় দেড় গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭০টিতে। ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এ ধরনের অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ১১০টি। তবে যে হারে শটগান ওয়েডিংয়ের ঘটনা ঘটছে, সে তুলনায় এই পরিসংখ্যানে তা খুব কমই প্রকাশ পাচ্ছে।

গত বছরের মার্চে পাটনা থেকে ১৫ বছরের এক ছেলেকে তুলে এনে ১২ বছরের একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেটির বাবা ২৬ বিঘা জমির মালিক হলেও মেয়েটির বাবা ছিলেন অটোরিকশাচালক।

গত বছরের মে মাসে ২২ বছরের অভিনয় কুমারকে অপহরণ করে মোজাফফরপুর জেলায় নিয়ে এসে বিয়ে দেওয়া হয়। তবে ওই ঘটনায় পুলিশ ও গ্রামবাসীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই বিয়ের কনের নাম ছিল জুলি (১৯)। অভিনয়ের বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ যখন সেখানে পৌঁছায়, তখন বিয়ের সব কাজ শেষ। তা-ও তারা বরকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। কিন্তু গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে ছেলের পরিবার ও পুলিশ ফেরত যায়। পরে আরও পুলিশ নিয়ে তারা ফিরে আসে এবং দুই পক্ষের মধ্যে তুলকালাম বেধে যায়। সংঘর্ষে কনে জুলিসহ কমপক্ষে ১২ জন নারী-পুরুষ আহত হয়। সারা শরীরে আঘাত নিয়ে জুলিকে দীর্ঘদিন ভুগতে হয়েছিল। ওই ঘটনায় বাড়াবাড়ির কারণে বরখাস্ত করা হয়েছিল গেঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। তবে আহত কনেকে দেখে পরে বর অভিনয় কুমারের মায়া হয়। তিনি বিয়েটাকে মেনে নেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সাধারণত ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী ছেলেদের অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে ম্যাট্রিকুলেশন ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে বিভিন্ন কেন্দ্রে আসা ছেলেদের অপহরণ করার ঘটনা ঘটে বেশি।

নাভাদা নামের এক গ্রামের ৯০ শতাংশ বিয়েই হয় এভাবে। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে পাটনা শহরে এসে অপহরণের শিকার হয় ১৭ বছর বয়সী এক ছেলে। দশম শ্রেণির এক ছাত্রকে ক্লোরোফরম দিয়ে অজ্ঞান করে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

মেয়ের পরিবারের বন্ধু ও স্বজনেরা সাধারণত অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকে। তবে অনেক সময় পেশাদার অপহরণকারীকেও ভাড়া করা হয়। ২০০৯ সালের মে মাসে ১৬ বছর বয়সী লালবাবু বিয়ের জন্য পেশাদার অপরাধীদের হাতে অপহরণের শিকার হয়। কোচিং শেষে বের হওয়ার পর প্রকাশ্যে গুলি করে একদল ছাত্রের মধ্য থেকে অপহরণ করা হয় লালবাবুকে। পরে তাকে জেহানাবাদের এক মন্দিরে নিয়ে ১৩ বছর বয়সী ববিতার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। অপহরণকারীদের গুলিতে নিহত হয় লালবাবুর বন্ধু প্রবীণ। পরে পুলিশ ওই ঘটনায় কনের বাবা ও ভাইয়ের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে।

এদিকে যার ক্রন্দনরত ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেই বিনোদ কুমার এই বিয়ের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়েছেন। তাঁর ভাষ্য, তাঁর বাবা একটি বেসরকারি হাসপাতালে চার মাস ধরে কোমায় আছেন। একদিন কনের ভাই সুরেন্দ্র তাঁকে এসে জানান, তিনি তাঁর বাবার বন্ধু। পরে তাঁকে হাসপাতাল থেকে বাইরে নিয়ে গিয়ে অপহরণ করেন। ঘটনার প্রায় ছয় সপ্তাহ পর ১৩ জানুয়ারি বিনোদ কনের পরিবারের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বিয়ের অভিযোগ এনে মামলা করেছেন। এর আগে ঘটনার পরপর তিনি ভাইকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গেলেও পুলিশ অভিযোগ নেয়নি। পুলিশ তাঁর ভাইকে বলেছিল, ‘কাঁহি তো শাদি কিজিয়েগা, ম্যানেজ কর লিজিয়ে’ (কোথাও না কোথাও তো বিয়ে করবেনই, মিটমাট করে ফেলুন)।