মমতার ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন সোনিয়া?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সোনিয়া গান্ধী।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সোনিয়া গান্ধী।

এখনো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তথা তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেসের দা-কুমড়া সম্পর্ক। কেউ যেন কারও নাম শুনতে পারেন না। অথচ এই মমতা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করেছেন। নির্বাচন করেছেন বিজেপির সঙ্গে জোট করে, এমনকি বাম দলের সঙ্গেও।

মমতার এখন একমাত্র ধ্যানধারণা শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাটই নয়, গোটা দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপিকে হটানো। সেই লক্ষ্যে তিনি মাঠে নেমে পড়েছেন। বলেছেন, ২০১৯ সালই হবে বিজেপির পতনের বছর। আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভারতে অবসান হবে বিজেপি শাসনের, মোদি শাসনের। কিন্তু পারবেন কি মমতা? সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

আগামী বছর ভারতের লোকসভার ৫৪৩টি আসনের নির্বাচন। মাঠে নেমে পড়েছে বিজেপি। বসে নেই ভারতের দ্বিতীয় শক্তিধর দল কংগ্রেসও। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সভাপতি হওয়ার পর রাজনীতির মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন দলের বর্তমান সভাপতি রাহুল গান্ধী। ঘোষণা দিয়েছেন, ২০১৯ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বিজেপিকে হটিয়ে ভারতে আনতে হবে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে লালিত রাজনৈতিক দলকে। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএকে। সেই লক্ষ্যে এখন বিজেপিবিরোধী দলও ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছে। গত বৃহস্পতিবার সোনিয়া গান্ধীর ডাকে দিল্লিতে বিজেপিবিরোধী ১৭টি রাজনৈতিক দলের এক বৈঠকও হয়ে যায়। সেখানেও বিজেপিকে হটিয়ে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে।

পশ্চিমবঙ্গও বসে নেই। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এখন বিজেপির জনপ্রিয়তায় ভাটা শুরু হয়েছে। সেটা সাম্প্রতিক বেশ কটি জনসমীক্ষায় উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বিজেপির জনপ্রিয়তা গত এক বছরে ১২ শতাংশ কমে গেছে। কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা ১০ শতাংশ বেড়েছে। এতে জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে কংগ্রেস। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া একটি লোকসভা ও একটি বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলাফল দেখিয়ে দিয়েছে, এই রাজ্যে এখনো মমতার জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন রয়েছে। বরং বেড়েছে আরও। অন্যদিকে, কংগ্রেস এবং বাম দলের জনপ্রিয়তা কমেছে। আর বেড়েছে বিজেপির। তবু বিজেপির এই জনপ্রিয়তা বাড়াকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না তৃণমূল। মমতা বলেছেন, আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিজেপি ধুয়েমুছে যাবে এই রাজ্যপাট থেকে।

অন্যদিকে, গোটা দেশেও বিজেপির পতনের ছবি ক্রমে ফুটে উঠছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মোদির রাজ্য গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে বিজেপিকে কংগ্রেস জোট। সেখানে বিজেপি পেয়েছে ৯৯টি আসন আর কংগ্রেস পেয়েছে ৭৯টি আসন। বিজেপি-শাসিত আরেকটি রাজ্য রাজস্থানের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দুটি লোকসভা ও একটি বিধানসভার উপনির্বাচনেও জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। আগামী বছরে লোকসভা নির্বাচনের আগে এই ফলাফল বিজেপির কাছে এক অশনিসংকেত। রাজস্থান ও গুজরাটের উপনির্বাচন এবং নির্বাচনের পর হালে পানি পায় কংগ্রেস, অন্যদিকে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে বিজেপি শিবিরে।

এরপরই কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর উপলব্ধিতে আসে বিজেপির জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া আর কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা বাড়ার ছবি। কংগ্রেসও বুঝে নিয়েছে, বিজেপি সরকারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত, জিএসটি চালু, সর্বোপরি ব্যাংকে আধার পরিচয়পত্র সংযুক্ত, দেশে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়গুলো ভালোভাবে বেছে নেয়নি দেশবাসী। তাঁরই ছবি ফুটে ওঠা শুরু করেছে বিভিন্ন নির্বাচন ও উপনির্বাচনের ফলাফলে।

কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখনই বুঝে ফেলেছে, কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসতে হলে তৃণমূলের সমর্থন জরুরি। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে লোকসভার ৪২টি আসন। এই আসনের সিংহভাগই পাবে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস। সুতরাং, সরকার গড়তে মমতার সাহায্য এবং সমর্থন জরুরি। তাই তো পশ্চিমবঙ্গে তিনটি উপনির্বাচনের পর সোনিয়া গান্ধী টেলিফোনে কথা বলেন মমতার সঙ্গে। বুঝিয়ে দেন—বিজেপিকে পরাস্ত করতে তৃণমূলের সমর্থন অনস্বীকার্য। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-তৃণমূল কংগ্রেসের অহি-নকুল সম্পর্কের কারণে কতটুকু এগোন যাবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্কের অভাব নেই। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য কংগ্রেস এখনো অনড় নয় তৃণমূলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গড়তে। তারা এখনো চায় বাম দলের সঙ্গেই জোট করতে। কিন্তু এতে হিত হবে কি না, সে প্রশ্নটি রয়েছে রাজনৈতিক মহলে। তবু সোনিয়া চাইবেন মমতার মতো একটি দলের সমর্থন। কারণ, ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪ আসনের মধ্যে তৃণমূল একাই ১৮৪টি আসন পেয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল তাদের শক্তি কত? আবার ২০১৬ সালের পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল তাদের আসন ১৮৪ থেকে বাড়িয়ে ২১১ করে বুঝিয়ে দিয়েছে, এই রাজ্যে তৃণমূলের বিকল্প তৃণমূলই।

বর্তমান দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মমতাও অনুধাবন করতে শুরু করেছে বিজেপিকে তাড়াতে কংগ্রেসের মতো শক্তিধর একটি দলের প্রয়োজন। কারণ, কংগ্রেসে দেশের দ্বিতীয় শক্তিশালী দল। সেই তুলনায় তৃণমূল একটি আঞ্চলিক দল। সব রাজ্যে তাদের সংগঠন নেই। তাই তো কংগ্রেস এখন দিল্লির শাসনক্ষমতায় যাওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। সেটিকে অনুধাবন করে ২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় রাজ্য বাজেটের সমাপনী ভাষণে মমতা বলেই ফেলেন, ‘দিল্লিতে তৃণমূল ছাড়া কংগ্রেসের চলে না। সোনিয়া গান্ধী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। আর রাজ্যের কংগ্রেস নেতারা চুনোপুঁটি।’ মমতার মূল কথা, ‘দিল্লি বা ভারতের সংসদে তৃণমূলকে ছাড়া কংগ্রেসের চলে না। তাহলে এ রাজ্যে এত বিরোধিতা কেন?’

ভবিষ্যতে বিজেপিকে হটানোর জন্য কংগ্রেস-তৃণমূল কাছাকাছি আসছে—এই প্রশ্ন এখন মমতার উক্তিতে উঠে এসেছে। বিজেপিকে হারাতে তৃণমূলের অংশীদারত্ব এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ, জনপ্রিয়তা কমছে বাম দল আর কংগ্রেসের। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয়তা বাড়ছে বিজেপির।