কেমন হবে ভবিষ্যতের যুদ্ধ?

ভবিষ্যতের যুদ্ধ কেমন হতে পারে, এর একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেছে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট।
ভবিষ্যতের যুদ্ধ কেমন হতে পারে, এর একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেছে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট।
  • ভূরাজনীতি ও প্রযুক্তিতে পরিবর্তন আসছে।
  • পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ছে।
  • যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার প্রতিযোগিতার সামরিক মাত্রা আছে।
  • ভবিষ্যতের যুদ্ধ হবে বহুমাত্রিক, বৈচিত্র্যময় ও কৌশলপূর্ণ।
  • অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও ভূরাজনীতি যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিই বদলে দেবে।

‘কী অস্ত্র দিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে, তা জানি না। তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে লাঠি আর পাথর দিয়ে।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক সাক্ষাৎকারে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এ মন্তব্য করেন।

স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে নাজুক এক পরিস্থিতি তৈরি হয়—এই বুঝি বেধে গেল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ! আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হয়। পূর্ব ও পশ্চিম ব্লকের শক্তির মধ্যে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে গেলেও আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা দেখতে হয়নি। তবে বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও কখনো কাটেনি।

গত আধা শতকে একেক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সে রকম যুদ্ধ দেখা যায়নি। এটা খেয়াল করে অনেক অবাক বটে। কিন্তু যুদ্ধবিগ্রহ কমেছে বলে যে শান্তির সুবাতাস বইবে—এমন নিশ্চয়তাও নেই। বরং আশঙ্কা রয়েছে পুরো মাত্রায়। বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী তেমনই। বিশ্ব এখন এক নতুন যুগে। চারদিকে যে গোলমেলে পরিবেশ, যেকোনো সময় মোচড় দিয়ে খাড়া হতে পারে যুদ্ধ।

গত ২৫ বছরে রক্তক্ষয়ী নানা সংঘাতে বহু মানুষের প্রাণ ঝরেছে। এখনো ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নানামুখী যুদ্ধ চলছে। অন্যদিকে, ভূরাজনীতি ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ছে।

এই তো, কিছুদিন আগের কথা। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন নতুন জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল প্রকাশ করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, এখন মার্কিন প্রতিরক্ষার মূল লক্ষ্য—ক্ষমতার লড়াই। আর তাদের প্রধান হুমকি চীন ও রাশিয়া।

সম্প্রতি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ রুশ হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। বলেছেন, রাশিয়া যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় হুমকি।

যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে যে টান টান উত্তেজনা, ক্ষণে ক্ষণে সংঘাতের আশঙ্কা ঝলকায়। এই বুঝি টিপ পড়ল পরমাণু অস্ত্রের বোতামে!

ভবিষ্যতের যুদ্ধ কেমন হতে পারে, এর একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেছে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। পত্রিকাটি বলছে, ভবিষ্যতের যুদ্ধ বহুমাত্রিক, বৈচিত্র্যময় ও কৌশলপূর্ণ। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিই বদলে দেবে।

পরাশক্তির সংঘাত
পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ বাধানোর ইচ্ছা তেমন আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু ভবিষ্যতে এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মাঝারি শক্তির পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা উচিত বলে পেন্টাগনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। এমন অস্ত্র তৈরি না করলে অস্ত্রের মহড়ায় যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়বে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। পেন্টাগনের প্রতিবেদনে পরাশক্তিগুলো ক্ষুব্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উসকানির অভিযোগ তুলেছে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবকে স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ বলছে চীন। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, অতীতের মতো ভবিষ্যতেও স্নায়ুযুদ্ধ দেখা দিতে পারে। তবে সেই স্নায়ুযুদ্ধ হবে ভিন্ন আঙ্গিকে।

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার প্রতিযোগিতার বিষয়টি প্রকাশ্য। আর নিশ্চিতভাবে এই প্রতিযোগিতার একটি সামরিক মাত্রা আছে। বিশেষ করে রাশিয়া ও চীন কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য মানতে নারাজ। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে তারা চ্যালেঞ্জ করে আসছে। আঞ্চলিক পর্যায় তারা দারুণ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। দৃঢ় প্রভাববলয় গড়ে তুলেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরাশক্তি দুটি প্রমাণ করেছে, তারা তাদের স্বার্থ রক্ষায় সামরিক শক্তি প্রয়োগেও প্রস্তুত। এই প্রেক্ষাপটে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা পুরোপুরি নাকচ করা যায় না।

চীন অর্থনৈতিকভাবে এখন খুবই শক্তিশালী। তারা তাদের সামরিক শক্তিকেও সমৃদ্ধ করছে। চীন এখন সময়কে নিজের করে নিতে চায়। রাশিয়ার বর্তমান নেতৃত্ব দেশের হারানো শৌর্য-বীর্য পুনরুদ্ধার করতে তৎপর। যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলায় চীন ও রাশিয়া গত দশকে সামরিক খাতে প্রচুর অর্থ ঢেলেছে। পেন্টাগনের প্রতিবেদনে রাশিয়া ও চীন উদ্বেগ দেখালেও দেশ দুটি কিন্তু তাদের নিজ নিজ পরমাণু অস্ত্রের ভান্ডার সমৃদ্ধের পাশাপাশি তার আধুনিকায়ন করে চলছে।

পরাশক্তির দুশ্চিন্তা
পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে পরাশক্তিগুলোর বড়াইয়ের শেষ নেই। আবার এই অস্ত্রই তাদের দুশ্চিন্তার কারণ। পারমাণবিক অস্ত্রের ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ ব্যবস্থা সাইবার হামলায় সাময়িক সময়ের জন্য অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া রাশিয়া ও চীনের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে তাদের (চীন ও রাশিয়া) পারমাণবিক অস্ত্রকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। অস্ত্রটি নিয়ে চীন-রাশিয়াও কাজ করছে।

লাশ নয়
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য আফগানিস্তান থেকে হাজারো কফিন আসার বিষয়টিকে আংশিক দায়ী বলে মনে করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাই তিনি যুদ্ধে প্রাণহানি এড়াতে চান। ভবিষ্যতের যুদ্ধের প্রকৃতি কেমন হবে, তার আলামত পাওয়া যায় সিরিয়ায়। দেশটিতে যথাসম্ভব প্রাইভেট মিলিটারি কনট্রাকটর ব্যবহার করেছেন তিনি।

যুদ্ধের দামামা
কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধের দামামা বাজছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন দুজনই খ্যাপাটে। তাঁর একে অন্যকে শাসাচ্ছেন। দুই দেশ পরস্পরকে ধূলিসাৎ করতে অব্যাহতভাবে হুমকি দিচ্ছে। কোরীয় উপদ্বীপে পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুদ্ধটা একতরফা হবে না। যুদ্ধ বাধলে উত্তর কোরিয়া জল, স্থল ও আকাশপথে তীব্র আক্রমণ চালাবে। তারা জৈব, রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে পিছপা হবে না। যুদ্ধ যেমনই হোক না কেন, তা পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। নিহত হতে পারে লাখো মানুষ।

রাষ্ট্রের ভেতরে যুদ্ধ
সিরিয়ায় প্রায় সাত বছর ধরে গৃহযুদ্ধ। ইয়েমেনে চলমান গৃহযুদ্ধের বয়সও তিন বছর ছুঁই ছুঁই। ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লিবিয়া, মিসর, তুরস্ক, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, নাইজার, চাদসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও জাতিগত সংঘাতে জর্জরিত। এসব দেশে রক্তপাত নিয়মিত ঘটনা। জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জাতিগত বিদ্বেষ ও মৌলবাদের বিস্তার সামনের দিনগুলোয় রাষ্ট্রের ভেতরের সংঘাত আরও বাড়াতে পারে।

শহরে যুদ্ধ
মানুষ দলে দলে গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে। ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ শহরে বসবাস করবে। গত ২০ বছরে মেগা সিটির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকবে। আশঙ্কার কথা হলো, ভবিষ্যতে অধিকাংশ যুদ্ধের লড়াইয়ের ক্ষেত্র হতে পারে শহর। শহরে যুদ্ধ কেমন হবে, কতটা তীব্র হবে, সিরিয়ার আলেপ্পো ও ইরাকের মসুলে তার নজির দেখা গেছে। উভয় শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝাতে কেউ কেউ নরকের উদাহরণও টানছে। অন্যান্য যুদ্ধের মতো শহরের যুদ্ধের প্রকৃতিও বদলে দেবে প্রযুক্তি। যুদ্ধ হবে ব্লকে ব্লকে, ঘরে ঘরে।

ঘাতক রোবট
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগও আছে। এই প্রযুক্তি যুদ্ধের ধরন, যুদ্ধ নিয়ে মানুষের প্রচলিত চিন্তাভাবনা বদলে দিতে পারে। এআই ব্যবহার করে স্বাধীন অস্ত্রব্যবস্থা (অটোনোমাস ওয়েপনস সিস্টেমস) তৈরি করা হলে রোবট নিজেই মানুষ হত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ঘাতক রোবট রণক্ষেত্রের হিসাব-নিকাশ উল্টে দিতে পারে। বিপদের কথা ভেবে এই প্রযুক্তি বাস্তবে আসার আগেই তার বিরোধিতা করছেন স্টিফেন হকিংসহ অনেকে।

হাইব্রিড যুদ্ধ
ভবিষ্যতে হাইব্রিড যুদ্ধ বাড়বে। এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বহুমুখী কৌশল ব্যবহার করা হয়। উদ্দেশ্য হাসিলে এখানে নিয়মিত ও অনিয়মিত উভয় কৌশলের সমন্বয় ঘটানো হয়। হাইব্রিড যুদ্ধে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, গোয়েন্দা তৎপরতার মিশেল থাকতে পারে। এতে সন্ত্রাস, নির্বিচারে সহিংসতা, অপরাধমূলক কাজ, অপতথ্য, প্রচারণা, অনুপ্রবেশ, হ্যাকিংয়ের মতো হাতিয়ার (টুল) ব্যবহার করা হয়। হাইব্রিড যুদ্ধের ব্যাখ্যায় ইউক্রেনে রাশিয়া সাম্প্রতিক ভূমিকার উদাহরণ টানা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এই যুদ্ধ কৌশলেরই অংশ। চীনও একই ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত। প্রভাববলয় গড়তে হাইব্রিড যুদ্ধে হিজবুল্লাহকে ব্যবহার করছে ইরান।

তথ্যযুদ্ধ
তথ্যযুদ্ধের আলামত ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দিন যত যাবে, তথ্যযুদ্ধের ব্যাপকতা ও প্রভাব তত ঘনীভূত হতে থাকবে। রাষ্ট্রীয় মদদে তথ্য হ্যাক, তথ্য ফাঁস, অপতথ্য, সত্য-মিথ্যার মিশেল, মিথ্যা খবর (ফেক নিউজ) ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইন্টারনেট বিপ্লবের এই যুগে তথ্যযুদ্ধ যে কতটা কার্যকর, তা সম্ভবত রাশিয়া দেখিয়ে দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগটি বেশ জোরালো। এ নিয়ে তদন্ত চলছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে-পরে রাশিয়া থেকে হাজারো পোস্ট ছাড়া হয়। ফেসবুকে রাশিয়ার অপতথ্যমূলক পোস্ট যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক কোটি ব্যবহারকারী দেখে থাকতে পারেন। তথ্যযুদ্ধ পরিচালনার জন্য রুশ সেনাবাহিনীতে ইউনিট সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রতিপক্ষরা নিশ্চয়ই বসে নেই।