ট্রুডোর প্রতি ভারতের এ আচরণ কেন?

গতকাল রোববার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে ভারতের আগ্রায় তাজমহল পরিদর্শনে যান কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ছবি: রয়টার্স
গতকাল রোববার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে ভারতের আগ্রায় তাজমহল পরিদর্শনে যান কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ছবি: রয়টার্স

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর যেকোনো বিদেশ সফর নিয়ে আনন্দ-উৎসব বয়ে যায়। এত দিনে হয়তো তাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর প্রথম ভারত সফর নিয়েও এমন হুল্লোড় পড়ে যাওয়ার কথা। অথচ হচ্ছে উল্টো। এক সপ্তাহের সফরে ট্রুডো এখন সপরিবারে ভারতে। অথচ তাঁকে নিয়ে সরকারি মহলে কোনো হইচই নেই। এমনকি তাঁর প্রতি ভারত ‘অবজ্ঞা’ প্রদর্শন করছে বলেও অভিযোগ করছেন কেউ কেউ।

বিমানবন্দরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বদলে ট্রুডোকে অভ্যর্থনা জানান এক কনিষ্ঠ মন্ত্রী। গতকাল রোববার সপরিবারে ট্রুডোর তাজমহল পরিদর্শনের সময় প্রচুর ছবি তোলার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা গ্রহণ করেনি সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। আজ সোমবার বিবিসি অনলাইনের খবরে এ তথ্য জানানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের রাজধানী দিল্লিতে শনিবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পৌঁছানোর পর তাঁকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান এক কনিষ্ঠ মন্ত্রী। অনেকেই এটাকে ট্রুডোর প্রতি ভারতের ‘অবজ্ঞা’ বলে মনে করছেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অনেকবারই বিদেশি নেতাদের নিজে গিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাঁর সুনামও রয়েছে। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে ভারত সফরে আসা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে তিনি বিমানবন্দরে গিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। অথচ কানাডার প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে এসেছেন দুদিন হয়ে গেল, নরেন্দ্র মোদির দেখা নেই। আজ সোমবার তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাট সফরে গেছেন ট্রুডো, অথচ মোদি সেখানেও অনুপস্থিত।

গতকাল সপরিবারে ট্রুডোর তাজমহল সফরের সময় উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সেখানে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে যাননি। বিষয়টি আলোচনায় আসে গণমাধ্যমেও। 
সাধারণত ট্রুডোর বিদেশ সফর নিয়ে গণমাধ্যমে ছবি, শিরোনাম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে উত্তেজনা দেখা যায়, তেমনটা এই সফর ঘিরে দেখা যাচ্ছে না।

তাহলে কি ভারত জাস্টিন ট্রুডোর বিষয়ে নিরুত্তাপ? যদি তা নয়, তাহলে কেন?
জবাবে এটাকে অবজ্ঞা-প্রদর্শন বলেই মন্তব্য করলেন ভারতীয় কলাম লেখক ও অর্থনীতিবিদ বিবেক দেহেজিয়া। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘এটা বড় ধরনের অবজ্ঞা। কানাডার প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারকে অভ্যর্থনা জানাতে কনিষ্ঠ মন্ত্রীকে পাঠানো সুনির্দিষ্টভাবে অবজ্ঞা দেখানো।’ তিনি বলেন, ট্রুডোর প্রতি আগ্রহ কম দেখানোর কারণ হতে পারে তাঁর সরকারে থাকা কয়েকজন ভারতীয় শিখ থাকা নিয়ে। ওই শিখ ব্যক্তিদের সঙ্গে ভারতের শিখ স্বাধীনতা আন্দোলন ‘খালিস্তান আন্দোলন’-এর নেতাদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলা হয়। পাঞ্জাব রাজ্যে স্বাধীন ভূখণ্ডের দাবিতে ওই আন্দোলন করা হচ্ছে। 
১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ায় বোমা হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত শিখ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ওই সময়ের কানাডা সরকারের জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। ওই হামলায় ৩২৯ জন নিহত হয়। এ ছাড়া ট্রুডোর দল লিবারেল পার্টির ভোট ব্যাংক বলা হয় শিখ বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিকদের। ট্রুডোর মন্ত্রিসভায় চারজন শিখ-কানাডীয় রয়েছেন। 
ঘটনা যদি তা-ই হয়, তাহলে খালিস্তান ইস্যুতে এটাই দুই দেশের মধ্যে তিক্ততার প্রথম ঘটনা নয়।

এক সপ্তাহের সফরে এখন ভারতে রয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ছবি: রয়টার্স
এক সপ্তাহের সফরে এখন ভারতে রয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ছবি: রয়টার্স

গত বছরের এপ্রিলে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ‘খালিস্তানির প্রতি সহানুভূতিশীল’ অভিযোগে সফররত কানাডার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হারজিৎ সাজ্জানের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান। 
এদিকে কানাডায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বিষ্ণু প্রকাশ ট্রুডোকে ‘অবজ্ঞা’ করার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে ভারত যথাযথভাবে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনেছে। 
তিনি আরও বলেন, যদিও নরেন্দ্র মোদি এর আগে কয়েকবার প্রটোকল ভেঙে বিদেশি নেতাদের স্বাগত জানিয়েছেন, তাই বলে এটা আশা করা ঠিক না যে ভারত সফরে আসা প্রত্যেককে তিনি নিজে গিয়ে স্বাগত জানাবেন।
বিষ্ণু প্রকাশ বলেন, ‘এমন নয় যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে দেখাই করবেন না। ২৩ ফেব্রুয়ারি সফররত প্রধানমন্ত্রীর জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে দুই প্রধানমন্ত্রীর দেখা হবে।’

সাবেক কূটনীতিক কানওয়াল সিবাল বিবিসিকে বলেন, শুধু অনুমাননির্ভর হয়ে খালিস্তানি ইস্যুতে ট্রুডোর রাষ্ট্রীয় সফর নিয়ে ভারতের এই আচরণ রাজনৈতিক ও পেশাদারি—দুই দিক দিয়েই ‘ভুল’। বরং ভারত খালিস্তান ইস্যুতে ভারতের উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরতে পারত।

তবে ট্রুডোর প্রতি অবজ্ঞা-প্রদর্শন ‘সত্য নয়’ বলে মনে করেন কানওয়াল সিবাল। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে দুই দেশের সম্পর্কে নাটকীয়ভাবে উন্নয়ন হয়েছে। পরমাণু চুক্তি করে দুই দেশই জানান দিয়েছে যে এ ব্যাপারে তাদের স্বার্থ এক। তাঁর মতে, জাস্টিন ট্রুডোকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কনিষ্ঠ মন্ত্রীকে পাঠানোর ব্যাপারে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে। এটা স্বাভাবিক প্রটোকল। ভারত বা কানাডা কেউই একটি দেশ সফর নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইবে না। কারণ এর ফল কী হতে পারে তারা তা জানে। এই সফরের সফলতা নিশ্চিত করতে দুই দেশেরই স্বার্থ রয়েছে।