পরিবেশকে আমল দিতে নারাজ নেতারা

প্রতিনিয়ত পরিবেশের ওপর চলছে নাগরিক সভ্যতার নিষ্ঠুর হামলা। নেতার ব্যস্ত ভোট প্রচারে। মাথাব্যথা নেই পরিবেশ নিয়ে। ছবি: সংগৃহীত
প্রতিনিয়ত পরিবেশের ওপর চলছে নাগরিক সভ্যতার নিষ্ঠুর হামলা। নেতার ব্যস্ত ভোট প্রচারে। মাথাব্যথা নেই পরিবেশ নিয়ে। ছবি: সংগৃহীত

মেঘের নিজভূমেই বৃষ্টির আকাল। ধু ধু করছে চারদিক। বাড়ছে দূষণের মাত্রা দিন দিন। পাল্টে যাচ্ছে সবুজ পাহাড়ি রাজ্যটির পরিবেশ। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ছোট পাহাড়ি রাজ্যটির মাটির তলায় রয়েছে পাথর, কয়লা থেকে ইউরেনিয়াম, হরেক অর্থকরী পণ্যের সুলুকসন্ধান। মাটির ওপরে রয়েছে সবুজ বনানী। পাহাড়, চারদিকে শুধু পাহাড়। সেই পাহাড়েই গড়ে উঠেছে জনপদ। মেঘের আপন বসতভূমি উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়। কিন্তু সেই মেঘালয়েই প্রকৃতি এখন প্রতিশোধ নিতে চলেছে দূষণের হাত ধরে। তবু ভ্রুক্ষেপ নেই কারও, এমনটাই মত পরিবেশবিদদের।

মেঘালয়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি ভোট। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর পর এদিন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভোট চাইতে এসেছিলেন মেঘালয়ের ফুলবাড়িতে। তিনিও প্রশংসা করলেন রাজ্যটির এবং এখানকার সৌন্দর্যের। কিন্তু প্রকৃতির আপন হাতে গড়া সৌন্দর্যের এমন ক্যানভাস নগরায়ণ আর অর্থায়নের জাঁতাকলে ধ্বংস হতে বসলেও তেমন কোনো কর্মসূচি নেই মোদি বা তাঁর দলের। বোঝা গেল তাঁর ভাষণেই।
খাসিয়া, জয়ন্তীয়া আর গারো পাহাড় নিয়ে গঠিত এই রাজ্যে কংগ্রেস, বিজেপি ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দলও রয়েছে ভোট প্রচারে। কিন্তু পরিবেশ নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও। নামকাওয়াস্তে প্রতিটি দলই দূষণ নিয়ে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারে দু-চার শব্দ খরচ করেছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না কেউই। এমনটাই মনে করেন পরিবেশবিদেরা।
মেঘালয় সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা টোকি ব্লোর মতে, মেঘালয়ের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ পরিবেশ। পরিবেশ রক্ষা করতে না পারলে এই পাহাড়ি জনপদ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে তাঁর আশঙ্কা। ব্লো নিজেও একজন পরিবেশ আন্দোলনকারী। দুঃখের সঙ্গে প্রথম আলোকে বললেন, ‘সুন্দর রাজ্যটি শেষ হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে। গড়ে তোলা হচ্ছে বড় বড় ইমারত। পরিবেশও তাই বদলা নিচ্ছে।’ সেই সঙ্গে তাঁর আক্ষেপ, ‘রাজ্যের কোনো রাজনৈতিক দলই পরিবেশ নিয়ে সিরিয়াস নয়। বরং কীভাবে কয়লার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে আবার রাজ্যটিকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেওয়া যায়, তারও ঘোষণা রয়েছে দলগুলোর প্রতিশ্রুতিতে।’
প্রসঙ্গত, গ্রিন ট্রাইব্যুনালের আপত্তিতে মেঘালয়ে কয়লা তোলা এখন নিষিদ্ধ। কিন্তু ক্ষমতাসীন কংগ্রেসসহ সব দলই বলছে কয়লার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলার জন্য দরবার করবে। একই অভিমত বিরোধীদেরও।

এ প্রসঙ্গে কংগ্রেস মুখপাত্র ফিয়ারলেস ওয়াগ্রির পাল্টা দাবি, কয়লা রাজ্যের অর্থনীতির মূল শক্তি। কয়লাখনি ফের চালুর জন্য তাঁরা সচেষ্ট হবেন বলেও প্রথম আলোকে জানিয়েছেন তিনি। কয়লা নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখার বিষয়ে একমত বিজেপির রাজ্য সভাপতি শিবুম লিংডোও।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শিলভেমাস লামারের মতে, নতুন প্রজন্ম পরিবেশ নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু বড়রাই তাঁদের প্রকৃতিপাঠের শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে দিচ্ছে না বলেও মনে করেন তিনি। মেঘালয়ে ইউরেনিয়াম খনন বন্ধ করে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। ইউরেনিয়ামের ক্ষতির বিষয়ে তাঁরা সচেতন। তবু সরকারি কোষাগারের পাশাপাশি রাজ্যের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে অনেকেই চাইছেন ইউরেনিয়াম ব্যবহৃত হোক। কিন্তু গ্রামবাসীর প্রতিরোধে তা সম্ভব হয়নি।

মেঘালয়ে উপজাতিদের সংস্কৃতি রক্ষায় মাত্র ৩২ লাখের মধ্যে ২২ হাজার ৪৩০ বর্গকিলোমিটারের ভেতরেই রয়েছে তিনটি স্বশাসিত জেলা পরিষদ। এদের মূল কাজই হলো উপজাতি পরম্পরা রক্ষা। কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় নেই তেমন কোনো বাস্তবসম্মত উদ্যোগ। ফলে পাহাড় কেটে সাফ হয়ে যাচ্ছে। গড়ে উঠছে বড় বড় অট্টালিকা। চাষের জমিও বেদখল হচ্ছে নগদ টাকার কাছে। আর এর পরিণামে শৈল শহরের তাপমাত্রা বাড়ছে। বৃষ্টির হার কমছে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টির শহর চেরাপুঞ্জিতেও। শিলঙে হোটেলের রুমেও ফিরে এসেছে বৈদ্যুতিক পাখা। তবু কোনো রাজনৈতিক দলই বিষয়টিকে ভোটের বাজারে আমল না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ পরিবেশবিদ টোকি ব্লো।