একজন 'জাতির মাতার' বিদায়

সেই অসাধারণ মুহূর্ত। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। বেরিয়ে আসছেন কারাগার থেকে। পাশে উইনি ম্যান্ডেলা। অবিসংবাদী নেতাকে স্বাগত জানাচ্ছে সমবেত জনতা। হাত তুলে তার জবাব দিচ্ছেন নেলসন ও উইনি (ফাইল ছবি: রয়টার্স)
সেই অসাধারণ মুহূর্ত। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। বেরিয়ে আসছেন কারাগার থেকে। পাশে উইনি ম্যান্ডেলা। অবিসংবাদী নেতাকে স্বাগত জানাচ্ছে সমবেত জনতা। হাত তুলে তার জবাব দিচ্ছেন নেলসন ও উইনি (ফাইল ছবি: রয়টার্স)

দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে বিয়ে ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে অবদানের জন্য দেশটির অনেকেই উইনি ম্যান্ডেলাকে ‘জাতির মাতা’ হিসেবে দেখেন। ৮১ বছর বয়সে তিনি সোমবার পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন।

নেলসন ম্যান্ডেলাকে বিয়ের পর বিবাহিত জীবনের বেশির ভাগ সময়ই তাঁদের আলাদা থাকতে হয়েছে। তাঁদের বিবাহিত জীবন ছিল ৩৮ বছরের। ওই সময়ের ২৭ বছর কারাবন্দী ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এই সময়ে উইনিকে একাই তাঁদের দুই মেয়েকে বড় করতে হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের অত্যাচার ও দমন-পীড়নের মধ্যে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখে নেলসন ম্যান্ডেলার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছে তাঁকে।

১৯৯০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা উইনির হাতে হাত রেখে হেঁটে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন—এই ছবি দেখেছে সারা বিশ্ব। এর দুই বছর পর অবশ্য তাঁরা বিচ্ছিন্ন হন। পরে আইনি লড়াইয়ের সময় তরুণ দেহরক্ষীর সঙ্গে উইনির সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯৯৬ সালে উইনি-নেলসনের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।

নেলসনকে নিয়ে বা নেলসনকে ছাড়া কঠোর, চিত্তাকর্ষক এবং স্পষ্টবাদী উইনি নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। আত্মজীবনীতে উইনি বলেছেন, ‘সব ধরনের পরিস্থিতিতেই আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।’

উইনি ম্যান্ডেলা। ছবি: এএফপি
উইনি ম্যান্ডেলা। ছবি: এএফপি

উইনি ১৯৩৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মাবংওয়েনিতে (বর্তমানে ইস্টার্ন কেপ) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। তখনকার সময়ে কৃষ্ণাঙ্গ নারীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার ঘটনা ছিল বিরল। পড়াশোনা শেষ করার পর কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে জোহানেসবার্গের বারাগওয়ানাথ হাসপাতালে সমাজকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন উইনি। এই কাজের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয়। বিশেষ করে শহরতলির আলেকজান্দ্রায় শিশুমৃত্যু নিয়ে গবেষণা তাঁর চোখ খুলে দেয়।

উইনি বলেন, ‘আমি দারিদ্র্যের বিষয়টি বুঝতে শুরু করি। বেশির ভাগ মানুষকে জোর করে দরিদ্র পরিস্থিতিতে রাখা হয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থা বৈষম্যের মাধ্যমে ভয়াবহ ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।’

উইনির বয়স যখন ২২, তখন সোয়েতোর একটি বাসস্ট্যান্ডে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। ১৯৫৮ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। বিয়ের পরই বর্ণবিদ্বেষী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বাঁচাতে পালিয়ে যান নেলসন ম্যান্ডেলা। ওই বছরেরই অক্টোবরে শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত কিছু এলাকায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির বিরুদ্ধে নারীদের আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হন উইনি।

১৯৬৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর নেলসনের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে তাঁর স্ত্রী উইনিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সরকারি বাহিনী উইনির ওপর নির্যাতন চালাত। জোহানেসবার্গের শহরতলি সোয়েতোতে তাঁকে আটক রাখত। তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো হতো। স্বামীর সঙ্গে কদাচিৎ সাক্ষাতের সুযোগ পেতেন উইনি।

বর্ণবিদ্বেষের চূড়ান্ত অবস্থায় উইনি সামনে থেকে লড়াই করে যান। ১৯৭৬ সালে সোয়েতো অভ্যুত্থানের সময় তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি লড়াই করে যাওয়ার আহ্বান জানান।

কারামুক্তির পরদিন কেপটাউনে ডেসমন্ড টুটুর বাসভবনের বাগানে হাঁটছেন নেলসন ম্যান্ডেলা ও তাঁর স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলা (ফাইল ছবি এএফপি)
কারামুক্তির পরদিন কেপটাউনে ডেসমন্ড টুটুর বাসভবনের বাগানে হাঁটছেন নেলসন ম্যান্ডেলা ও তাঁর স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলা (ফাইল ছবি এএফপি)

১৯৮০–এর দশকে উইনি ‘ম্যান্ডেলা ফুটবল ক্লাব’ নামে পরিচিত একটি নজরদারি কমিটির প্রহরায় থাকতেন সব সময়। সহিংসতার জন্য ওই কমিটির বদনাম রয়েছে। ওই সময় সন্দেহভাজন শত্রু এবং বিশ্বাসঘাতকদের পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া গাড়ির টায়ারে ফেলে হত্যা করা হতো। উইনি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে এক ভাষণেও উইনি এ কথা স্বীকারও করেন।

১৯৯১ সালে ১৪ বছর বয়সী এক বালককে অপহরণ ও হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন উইনি। গুপ্তচর সন্দেহে ১৯৮৯ সালে উইনির দেহরক্ষীরা ওই বালককে হত্যা করেছিলেন। পরে উইনির কারাদণ্ডের সাজা কমিয়ে জরিমানা করা হয়।

উইনি সম্পর্কে ডেসমন্ড টুটু তাঁর সাক্ষ্যে বলেছিলেন, ‘তিনি আমাদের সংগ্রামের এক অসাধারণ সাহস এবং মুক্তিযুদ্ধের মূর্তি। তবে কিছু ভুল হয়ে গেছে, ভয়ানকভাবে, খারাপভাবে।’

ম্যান্ডেলা সরকারে উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন উইনি। তবে অবাধ্যতার কারণে পরে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়।