যুক্তরাজ্যের পিছু ছাড়ছে না রাশিয়া

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রুশ রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া। ছবি: রয়টার্স
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রুশ রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া। ছবি: রয়টার্স

সাবেক দ্বৈত চর (ডাবল এজেন্ট) সের্গেই স্ক্রিপালকে হত্যাচেষ্টার জন্য রাশিয়াকে দায়ী করে আসছে যুক্তরাজ্য। এ ঘটনার জের ধরে পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক বহিষ্কার ও কথার লড়াইয়ে পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর সম্পর্ক এখন তলানিতে। বর্তমান পরিস্থিতিকে অনেকে টালমাটাল স্নায়ুযুদ্ধকালের সঙ্গে তুলনা করছেন। 


শুরু থেকে অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া। অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ হাজিরের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে আহ্বান জানিয়ে আসছে তারা। তবে রাশিয়ার যুক্ত থাকার দৃশ্যমান প্রমাণ হাজির করেনি যুক্তরাজ্য। উল্টো ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি টুইট মুছে ফেলার ঘটনা যুক্তরাজ্যের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এতে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়েছে দেশটি। এই পরিস্থিতিকে পুঁজি করে রুশরা ব্রিটিশদের দাবিকে ভুয়া প্রমাণে একের পর এক কূটনৈতিক খেলায় মেতেছে। প্রচারণা যুদ্ধে অগ্রগামী ব্রিটিশরা বিষয়টি এখন অনেকটা এড়িয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু পিছু ছাড়ছে না রুশরা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ (ব্রেক্সিট নামে পরিচিত) নিয়ে সৃষ্ট সংকট থেকে দৃষ্টি ফেরাতে ব্রিটিশরা সলসব্যারির ঘটনা সাজিয়েছে বলে পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার দূত ভ্যাসিলি নাভিনা।

সের্গেই স্ক্রিপাল রুশ গুপ্তচর ছিলেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তিনি রাশিয়ার গোপন তথ্য বিক্রি করেছিলেন। নিজ দেশের সঙ্গে বেইমানির দায়ে ২০০৬ সালে রাশিয়ার আদালত তাঁকে কারাদণ্ড দেন। যুক্তরাষ্ট্রে আটক ১০ রুশ গোয়েন্দাকে ফেরত আনার বিনিময়ে ২০১০ সালে স্ক্রিপালকে ছাড়ে রাশিয়া। স্ক্রিপাল যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেন।

গত ৪ মার্চ যুক্তরাজ্যের সলসব্যারি শহরে একটি রেস্তোরাঁর বাইরের বেঞ্চিতে সের্গেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ে ইউলিয়া স্ক্রিপালকে অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁদের ওপর রাসায়নিক সমরাস্ত্র (মিলিটারি গ্রেড নার্ভ এজেন্ট) প্রয়োগ করা হয়েছে বলে দাবি করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেন, রাশিয়ার তৈরি রাসায়নিক ‘নোভিচক’ প্রয়োগ করা হয়েছে তাঁদের শরীরে। এটি ‘সম্ভবত’ রাশিয়ার কাজ বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্রাণঘাতী ‘নোভিচক’ কীভাবে হামলাকারীর হাতে গেল, সেই ব্যাখ্যা চেয়ে রাশিয়াকে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন থেরেসা মে।

নির্ধারিত সময়ে জবাব না পেয়ে ২৩ জন রুশ কূটনীতিককে যুক্তরাজ্য থেকে বহিষ্কার করা হয়। জবাবে রাশিয়াও সমানসংখ্যক ব্রিটিশ কূটনীতিক বহিষ্কার করে। এরপর যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ২০টি মিত্র দেশ গোয়েন্দাগিরির অভিযোগ তুলে রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে। ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সমানসংখ্যক কূটনীতিক বহিষ্কার করে পাল্টা জবাব দেয়। ঠান্ডা মাথায় কূটনৈতিক বিতাড়নের এক নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হলো বিশ্ব।

এরপর অনেকটা তৃপ্তি নিয়ে কিছুটা দমে গিয়েছিল লন্ডন। কিন্তু নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে মরিয়া হয়ে ওঠে ক্রেমলিন। প্রমাণ হাজির অথবা যৌথ তদন্তের জন্য অব্যাহতভাবে আহ্বান জানাতে থাকে রুশরা। কথার আক্রমণে সেসব দাবি উড়িয়ে দেয় যুক্তরাজ্য।

৩ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের সামরিক গবেষণাগার (মিলিটারি ল্যাবরেটরি) পোর্টন ডাউন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে জানায়, হামলায় ব্যবহৃত রাসায়নিক ‘নোভিচক’। তবে এর উৎস কোথায় এবং কোনো দেশের গবেষণাগারে তৈরি হয়েছে, সেটি তারা জানে না। এমন বিবৃতির পর তুমুলভাবে সমালোচিত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। কেননা, তিনি জার্মানিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন, পোর্টন ডাউনের গবেষকেরা তাঁকে শতভাগ নিশ্চিত করেছেন, ‘নোভিচক’ রাশিয়ার তৈরি। একই দাবি করে পররাষ্ট্র দপ্তর একটি টুইট করেছিল। পোর্টন ডাউনের বিবৃতির পর ওই টুইটও মুছে ফেলা হয়। এতে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয় যুক্তরাজ্যের অবস্থান। তবে যুক্তরাজ্য সরকারের দাবি, আরও বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তারা রাশিয়াকে দায়ী করছে।

রাসায়নিক অস্ত্র বিষয়ে নজরদারির কাজে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘অর্গানাইজেশন ফর দ্য প্রোহিভিশন অব কেমিক্যাল ওয়েপন’-এ (ওপিসিডব্লিউ) নালিশ করে রাশিয়া। ৪ এপ্রিল জার্মানির হেগে অনুষ্ঠিত ওপিসিডব্লিউর বৈঠকে ভোটে হেরে যায় রাশিয়ার যৌথ তদন্তের প্রস্তাব। যুক্তরাজ্য এমন প্রস্তাবকে রাশিয়ার ‘দুর্বৃত্তসুলভ আচরণ’ বলে আখ্যায়িত করে।

এরপর একই বিষয়ে আলোচনার জন্য রাশিয়া ৬ এপ্রিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকে। ওই বৈঠকেও যুক্তরাজ্য যৌথ তদন্তের প্রস্তাব নাকচ করে। জাতিসংঘে নিযুক্ত রুশ দূত ভ্যাসিলি নাভিনা অভিযোগ করেন, যুক্তরাজ্য তাঁর দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা যুদ্ধে নেমেছে। যুক্তরাজ্য আগুন নিয়ে খেলছে বলে হুঁশিয়ার করে দেন তিনি। জবাবে ব্রিটিশ দূত ক্যারেন পিয়ার্স বলেন, রাশিয়াকে তদন্তের সুযোগ দেওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারকের দায়িত্ব দেওয়ার শামিল।

এর আগে যুক্তরাজ্যে আক্রান্ত ইউলিয়া স্ক্রিপালের সঙ্গে রাশিয়ায় অবস্থিত তাঁর চাচাতো বোন ভিক্টোরিয়া স্ক্রিপালের কথা হয়েছে দাবি করে একটি টেলিফোনালাপ প্রকাশ করে রাশিয়ান টিভি (আরটি)। ওই আলাপে ইউলিয়া বলেন, তিনি ও তাঁর বাবা সুস্থ আছেন। ভিক্টোরিয়া তাঁদের দেখতে যুক্তরাজ্যে আসার কথা জানালে ইউলিয়া বলেন, ‘কেউ তোমাকে ভিসা দেবে না।’ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এই কথোপকথন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

এর এক দিন পর গত শুক্রবার জানা যায়, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ইউলিয়ার ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, অভিবাসন আইনের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ভিক্টোরিয়া স্ক্রিপালকে ভিসা দেওয়া হয়নি। এটিকেও যুক্তরাজ্যের অসহযোগিতার নজির হিসেবে ব্যবহার করছে রাশিয়া।

এর পরদিন শনিবার সলসব্যারি ডিসট্রিক্ট হসপিটাল জানিয়েছে, ইউলিয়া সুস্থ আছেন। আর তাঁর বাবা সের্গেই এখন বিপদমুক্ত। তিনি দ্রুত সেরে উঠছেন। হাসপাতালের এমন বিবৃতির পর নতুন সমালোচনার মুখে পড়ে যুক্তরাজ্য। প্রাণঘাতী ‘নোভিচক’ দিয়ে হামলার শিকার হওয়ার পর বেঁচে যাওয়াটা আশ্চর্যের।

শুক্রবার দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের আহ্বান জানিয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে রাশিয়া। যুক্তরাজ্য এটিকে দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নেওয়ার কৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তবে সময়মতো চিঠির জবাব দেবে বলে জানিয়েছে।

গত ১২ মার্চ লন্ডনের নিজ বাড়ি থেকে নিকোলে গ্লুশকভ নামে এক রাশিয়ার ব্যবসায়ীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ব্রিটিশ পুলিশ এটিকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে ধরে নিয়ে তদন্ত করছে। এ তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে গতকাল রোববার ব্রিটিশ পুলিশ সদর দপ্তর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে বৈঠকের আবেদন জানিয়ে আলাদা চিঠি দিয়েছে রাশিয়া।

রাশিয়ার দাবি ইউলিয়া স্ক্রিপাল এবং নিকোলে গ্লুশকভ দুজনই রাশিয়ার নাগরিক। তাই এসব ঘটনার তদন্তে রাশিয়াকে যুক্ত করতে হবে।

রাশিয়া একের পর এক দাবি জানাচ্ছে। আর যুক্তরাজ্য সেসব প্রত্যাখ্যান করছে। এতে যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রচারণার হাতিয়ার পাচ্ছে রাশিয়া। যুক্তরাজ্যকে অসহযোগী আচরণের জন্য দায়ী করছে। সলসব্যারির ঘটনার পক্ষে ব্রিটিশদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই বলে চ্যালেঞ্জ করছে।

গতকাল রাতে রাশিয়ার টিভির অনলাইনে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল এমন, ‘স্ক্রিপালরা বেঁচে আছেন, কিন্তু গিনিপিগরা মরে গেছে—সলসব্যারি বিষপ্রয়োগের অদ্ভুত ঘটনা।’

এই প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি রেস্তোরাঁ, একটি পানশালা, একটি গাড়ি এবং সের্গেই স্ক্রিপালের ঘরের দরজায় নোভিচকের আলামত পেয়েছে বলে দাবি করেছিল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ, প্রাণঘাতী এই রাসায়নিকের প্রয়োগ ছিল ব্যাপক। রাসায়নিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক মিলিমিটার নোভিচক প্রয়োগে মানুষের বাঁচার সম্ভাবনা নেই। অথচ সলসব্যারির ঘটনায় মারা গেল কেবল দুটি গিনিপিগ।

প্রসঙ্গত, সের্গেই স্ক্রিপালের পোষা দুটি গিনিপিগ এবং দুটি বিড়াল ছিল। রাসায়নিকের ব্যাপকতা সম্পর্কে আঁচ করতে লন্ডনের রুশ দূতাবাস চিঠি দিয়েছিল ঘরের পোষা প্রাণীদের অবস্থা জানাতে। ফিরতি চিঠিতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ জানায়, ঘরের দুটি গিনিপিগ মারা গেছে। একটি বিড়ালের অবস্থা সংকটাপন্ন।