রোহিঙ্গা বিতাড়নের তদন্ত চেয়ে আইসিসিতে আরজি

ফেরার অপেক্ষায় রোহিঙ্গারা। ফাইল ছবি
ফেরার অপেক্ষায় রোহিঙ্গারা। ফাইল ছবি
>
  • তদন্তের অনুমতি প্রার্থনা করেছেন আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি।
  • মিয়ানমারে ত্রাণ সহায়তা ঢুকতে দেওয়ার আহ্বান জাতিসংঘের।
  • প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা।

রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে জোর করে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার তদন্ত করতে চেয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি ফাতৌ বেনসুদা। গত সোমবার তিনি আইসিসির বিচারকদের কাছে এ বিষয়ে আবেদন করেছেন।

এদিকে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের আদি নিবাসে ফেরানোর বিরোধিতা করছে প্রাদেশিক আইনসভা। মংডুতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের বিরোধিতা করে রাখাইন রাজ্যের আইনসভা গত শুক্রবার একটি প্রস্তাব পাস করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠিয়েছে।

আজ বুধবার বাংলাদেশ সফরে আসছেন মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উইন মিয়াত আই। সকালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর পাশাপাশি ঢাকায় কর্মরত বেশ কিছু কূটনীতিকের সঙ্গে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজার যাচ্ছেন। শিবিরে আশ্রয় নেওয়া যেসব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসনের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করেছে, তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন।

উইন মিয়াত আই গত সোমবার মিয়ানমার টাইমসকে জানান, বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি রোহিঙ্গা, মানবিক সহায়তা দানকারী কর্মী ও সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিলম্বিত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলবেন। উইন মিয়াত আই বলেন, ‘আমি শিবির (রোহিঙ্গা শিবির) পরিদর্শন করব। প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের প্রস্তুত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করব।’

তবে ঢাকা ও ইয়াংগুনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে অতীতের মতোই কালক্ষেপণের পথ থেকে মিয়ানমার এখনো সরেনি। মিয়ানমারে স্থানীয় পর্যায়ে প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করা হচ্ছে। আবার মন্ত্রিসভার একজন সদস্যকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে মিয়ানমার দেখাতে চাইছে, সমস্যা সমাধানে তারা আন্তরিক।

রাখাইনসহ মিয়ানমারের সংকটপূর্ণ রাজ্যগুলোয় ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ করতে দিতে দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।

তদন্ত চান আইসিসির কৌঁসুলি
আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি ফাতৌ বেনসুদা রোহিঙ্গাদের তাড়ানোর ঘটনার তদন্তের জন্য আবেদন করেছেন। ওই আবেদনে ফাতৌ বেনসুদা বলেন, সামঞ্জস্যপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদন থেকে ইঙ্গিত মিলেছে, আইনসংগতভাবে মিয়ানমারে থাকা ৬ লাখ ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে বিতাড়ন করা হয়েছে। এ বিতাড়নের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত আইনি পদক্ষেপ নেবেন কি না, সে ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। আইসিসি এ তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে জটিলতা আছে। কারণ, বাংলাদেশ আইসিসির সদস্য হলেও মিয়ানমার এর সদস্য নয়।

প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা
মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতি জানায়, রাখাইনের বুচিডংয়ের আইনপ্রণেতা তুন অং থেইন গত মঙ্গলবার প্রাদেশিক আইনসভায় প্রস্তাবটি তোলেন। ওই সময় তিনি বলেন, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব, মংডুতে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী আরাকান জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা এবং আইনের শাসন বিবেচনায় নিয়ে তিনি প্রস্তাবটি করছেন।

সংখ্যালঘু আরাকান জনগোষ্ঠী এবং অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোকজন আতঙ্কে বাড়িঘর ফেলে চলে যাচ্ছে। পুরো এলাকা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, এমন লোকজনের হাতে চলে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মংডুর দক্ষিণাঞ্চলে মিয়ানমারের নাগরিক নয়, এমন লোকদের পুনর্বাসন ভবিষ্যতে সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। স্থানীয় লোকজন ওই এলাকায় রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই তাদের ইচ্ছার প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত।’

তুন অং থেইনের প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনার পর শুক্রবার তা পাস করেন রাখাইন আইনসভার সদস্যরা। তাঁদের সবাই এর পক্ষে মত দেন। আইনপ্রণেতাদের ভাষ্য, পুনর্বাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে অবৈধ অভিবাসী ও সন্ত্রাসীরা খুব সহজেই সমুদ্রপথে ওই এলাকায় ঢুকে পড়বে।

এ ব্যাপারে রাখাইন আইনসভায় মাইবনের আইনপ্রণেতা অং উইন বলেন, সব দেখে মনে হচ্ছে, অবৈধ অভিবাসী ও সন্ত্রাসীদের স্বাগত জানাতেই মংডুর দক্ষিণাঞ্চলে রোহিঙ্গা গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।
রাখাইন পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি মেজর অং জিন থানও মংডুতে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের বিপক্ষে কথা বলেন। আর এই রাজ্যের পরিকল্পনা ও অর্থমন্ত্রী কিয়াও আই থেইন বলেন, ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কোনো কারণ নেই আইনপ্রণেতাদের।

মিয়ানমারের সাত সেনার ১০ বছর জেল
ইয়াঙ্গুন থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যার দায়ে মিয়ানমারের সাত সেনাসদস্যকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দেশটির সেনাপ্রধান গতকাল তাঁর ফেসবুকে এক পোস্টে এই তথ্য জানান।

এই সাজা দেওয়ার মধ্য দিয়ে গত বছরের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্মম নির্যাতন শুরু হওয়ার পর প্রথমবারের মতো নৃশংস ঘটনা স্বীকার করল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এই ১০ পুরুষ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর ইন ডিন গ্রামে।

সেনাপ্রধানের ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, ‘সেনাবাহিনীর চার কর্মকর্তা ও তিন সদস্যকে চাকরিচ্যুত করে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।’

তথ্য চাইল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত
বার্তা সংস্থা এএনআই জানায়, ভারতের হরিয়ানায় আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ও তাদের কী কী চাহিদা পূরণ করা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে গত সোমবার তা জানতে চেয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। হরিয়ানার মেওয়াত ও ফরিদাবাদ শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে উল্লেখ করে রোহিঙ্গাদের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ করেন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ।