রাজাপক্ষে কি ফিরছেন?

শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে।
শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে।

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার স্থানীয় নির্বাচনে মাহিন্দা রাজাপক্ষের দল ফ্রিডম পার্টি বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছে। দলটি পোডুজানা পেরামুনা বা পিপলস ফ্রন্ট নামে পরিচিত। 

১০ ফেব্রুয়ারির ওই নির্বাচনের ফল রাজাপক্ষকে আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে আনতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। মাহিন্দা রাজাপক্ষের দল প্রদত্ত ভোটের ৪৫ শতাংশ পেয়ে প্রথম হয়েছে । বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের দল ইউনিয়ন ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) ভোটের হিসেবে দ্বিতীয় দল। তারা ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ইউএনপি সংসদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। আর দেশটির প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষেরই সাবেক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী মাইথ্রিপালা সিরিসেনার (দুটো দলের সমর্থনে ক্ষমতায়) দলের অবস্থা আরও শোচনীয়। সিরিসেনার সর্বসাকুল্যে পকেটে পুরতে পেরেছেন ১৫ শতাংশ ভোট।

গ্রামের দিকের অনেক সিংহলির বিশ্বাস, ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ধাপ্পাবাজি বা প্রতারণা করে মাহিন্দা রাজাপক্ষের জয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এমনকি অনেকের দৃঢ় বিশ্বাস, রাজাপক্ষের হারের পেছনে পশ্চিমাদের ভূমিকা আছে।

রাজাপক্ষে ক্ষমতার মসনদ থেকে সরে যাওয়ার পর নির্বাচনের এ ফল সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহের জনপ্রিয়তার ভাটা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এ ফলাফলে কেন্দ্রীয় সরকারের পতন হবে না; তবে রাজাপক্ষের গ্রহণযোগ্যতা আগের চেয়ে যে বেড়েছে তা বলা যায়।

নির্বাচনে পরাজয়ের পর ক্ষমতাসীন জোট সরকারের অবস্থা যে টালমাটাল, তা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। কারণ এরপরই বিক্রমাসিংহের পদত্যাগের দাবিও জোরালো হচ্ছে। এরই মাঝে এখন প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা আবার রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রক্রিয়ার কথা বলছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভোটের পর রাজাপক্ষের প্রত্যাবর্তন সিরিসেনা-বিক্রমাসিংহের জুটির জন্য অশনিসংকেত এবং আগামী নির্বাচনে চ্যালেঞ্জও।

দেশটির রাজনৈতিক ভাষ্যকার দায়ান জয়াতিল্লেকা বলেন, ‘তাঁর (রাজাপক্ষের) রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রাজনীতির মাঠে বক্সার মোহাম্মদ আলীর মতো একই ওজন শ্রেণির ছিলেন না। এ রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মত হলো, তামিল টাইগারদের সামরিকভাবে পরাজিত করা রাজাপক্ষের জন্য নির্বাচনের ফলাফল সাবেক রাষ্ট্রপতির প্রত্যাবর্তন বলা যেতেই পারে।

শ্রীলঙ্কায় স্থানীয় নির্বাচনের তাৎপর্য খুব অর্থপূর্ণ নয়। তবে তা থেকেও দেশটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক অনিশ্চয়তা ভর করতে পারে। বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের নেতৃত্বে নতুন গড়ে তোলা দলের ব্যাপক বিজয়ের পর এ আলোচনা জোরালো হয়েছে। দু’বারের সাবেক এ প্রেসিডেন্টের এভাবে ফিরে আসা এক বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

২০১৫ সালে নির্বাচনে ভোটাররা তাঁকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তৃতীয়বারের জন্য নির্বাচিত করেনি। তামিল মুসলিম সিংহলিদের একটি বিরোধী জোট তাঁর কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন ও মন্ত্রিসভায় তাঁর ভাই ও কয়েকজনের উপস্থিতিতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। দৃঢ় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ভোটাররা মুদ্রাস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান ঋণ এবং ব্যাপক দুর্নীতি পছন্দ না করায় তিনি হেরে যান। তাঁর ক্ষমতাধর কর্তৃত্বপরায়ণতা গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাজাপক্ষে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অবসান মেনে না নিয়ে পুনরায় ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
রাজাপক্ষের উত্তরসূরি, সাবেক সহকর্মী মাইথ্রিপালা সিরিসেনা তেমন কর্তৃত্বপরায়ণ নন, এটা রাজাপক্ষের জন্য চরম সৌভাগ্যের।

৭২ বছর বয়সী রাজাপক্ষে সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ তিনবার করেছিলেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি বৌদ্ধদের কাছে এখনো রাজাপক্ষে জনপ্রিয়তা প্রায় আকাশচুম্বী। ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে তামিল বিদ্রোহের অবসানে রাজাপক্ষে সিংহলিদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তামিলদের পরাজয়ের মাধ্যমে দেশটিতে দীর্ঘ দিনের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে সমর্থকেরা প্রায় প্রতিদিন তাঁর বাড়িতে ভিড় করেন। পরাজয়ের পর থেকে তিনি মন্দিরে পূজা করেন এবং সমর্থকদের উদ্দেশে নিয়মিত বক্তব্য দেন। এতে করে তিনি পরাজয়ের পর থেকে প্রচারণাটা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে রাজাপক্ষের রাজনৈতিক ভাগ্য উজ্জ্বলের দিকে যাচ্ছে, তা বলাই যায়।

দীর্ঘ ৩৭ বছরের তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াইয়ে সাফল্যের জন্য দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের কাছে এখনো বেশ জনপ্রিয় রাজাপক্ষে। তবে রাজাপক্ষের চরিত্রের মধ্যে বিভক্তির যে বৈশিষ্ট্য আছে, সেটির কারণে ভবিষ্যতে কি হয় তা নিয়ে আগাম মন্তব্যর জায়গাও আবার একটু কম।

ক্ষমতার রাজনীতির মঞ্চে রাজাপক্ষের প্রত্যাবর্তন শ্রীলঙ্কার জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। কারণ তামিল ও মুসলিমদের কাছে তিনি আবার খলনায়ক। এ দুই জাতিগোষ্ঠী তাঁকে রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে বসে দমন পীড়নের বজায় রাখার দোষে দুষ্ট ব্যক্তি বলে মনে করে।

সংখ্যাগুরু সিংহলি এবং সংখ্যালঘু তামিলদের মধ্যে কয়েক দশকব্যাপী লড়াইয়ের কারণে শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক বিভাজনটা খুবই তীব্র। তামিল গেরিলাদের বিরুদ্ধে জয় এবং যুদ্ধ-পরবর্তী অবকাঠামো নির্মাণে রাজাপক্ষের ভূমিকা সিংহলিদের অনেকেই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। কিন্তু তামিল ও মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে তিনি ঠিক এর উল্টোটা। তামিল বিদ্রোহ দমনে বাড়াবাড়ির জন্য যুদ্ধাপরাধেরও অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। তামিলরা এখনো মনে করেন, তারা ক্রমশ প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাচ্ছেন। তবে এর আগে মুসলিমদের ওপর কট্টর বৌদ্ধরা বেশ কয়েক দফা আক্রমণ করার সময় রাজাপক্ষে ক্ষমতায় থাকার সত্ত্বেও বাধা দেননি। কিন্তু এটিও সত্য যে সিরিসেনা ক্ষমতায় আসার পরও এ অবস্থার যে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি তার জ্বলন্ত উদাহরণ সাম্প্রতিক বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যকার সংঘর্ষের ঘটনা।

প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহ ও প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। ছবি: রয়টার্স
প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহ ও প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। ছবি: রয়টার্স

প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন সিরিসেনা। এতে তিনি সফল। সংবিধানের ঊনবিংশ সংশোধনী প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের সাংবিধানিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য প্রণীত বিংশতিতম সংশোধনী পার্লামেন্ট পাস করেনি। উপরন্তু আত্মীয়স্বজনকে সরকারি উচ্চপদে আসীনের অভিযোগ উঠেছে, দুর্নীতির প্রশ্ন এসেছে তাঁর বিরুদ্ধেও। কিন্তু এসবের চেয়েও বড় সমালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যেটা, তা হচ্ছে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে তাঁর সরকারের সাফল্য আশাব্যঞ্জক নয়। তামিলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সময়, বিশেষ করে গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, যেসব যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নিতে তিনি উৎসাহ দেখাননি। এসব কারণে ভোটারদের একটি অংশ তার ওপর রুষ্ট।

শুধু তা-ই নয়, তামিলদের সঙ্গে বিরোধ মেটানোর বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সিরিসেনার শাসনামলে অগ্রগতি সামান্যই। আর একপর্যায়ে এটা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে, তা বলাই যায়। তামিল টাইগাররা যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হলেও বিশ্বজুড়ে তাদের যে নেটওয়ার্ক, সেটা কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়নি। আর নৈতিক বিবেচনায় একটি গণতান্ত্রিক দেশ কোনো অবস্থাতেই তার অতীত অপকর্মের দায় এড়াতে এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারবঞ্চিত করে শাসন অব্যাহত রাখতে পারে না।

‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ প্রভাব
ভারতের একটি মহলের ইন্ধনে ২০১৫ সালে রাজাপক্ষের নিশ্চিত জয় ঠেকাতেই দিল্লি সিরিসেনাকে সমর্থন করে। আর এ ধারণা আরও জোরালো হয় সিরিসেনা প্রেসিডেন্ট হয়েই প্রথম বিদেশ সফরে দিল্লি যাওয়ার পরই। নরেন্দ্র মোদিও শ্রীলঙ্কা সফর করেন।

২০০৭ সালের পর থেকে শ্রীলঙ্কা, চীন, ইরান ও রাশিয়ার সমন্বয়ে এ অঞ্চলে যে ঐক্য গড়ে উঠছে তা ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ হিসেবে পরিচিত। একই সঙ্গে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থকে আঘাত করছে ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’। এ অঞ্চল ঘিরে মুক্তার মালা নীতি ভারত মহাসাগরে চীনের কর্তৃত্বকে নিশ্চিত করতেই লক্ষ্যেই প্রণীত। ভারত মহাসাগরে চীনের শক্তি বৃদ্ধিকে ভারত তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপও মনে করে। ফলে ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কায় পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল। মনে রাখতে হবে, চীন একদিকে বেলুচিস্তানের গাওদার বন্দর তৈরি করে দিয়েছিল, অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার হামবানটোটায়ও গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে দিয়েছে। ফলে খুব সহজভাবে ভারতের এটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। অভিযোগ আছে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তনে (২০১৫ সালে) ওই সময়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। এ জন্যই দলে ভাঙন সৃষ্টি করে সিরিসেনাকেই রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়। ফলে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয় রাজাপক্ষকে।

এ ক্ষেত্রে সিরিসেনার ভারতমুখী ভোটারদের আবার রাজাপক্ষের নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টিমুখী করেছে কি না তা সময়ই বলতে পারবে। তাই ভবিষ্যতে সিরিসেনাকে বেশ হিসাব কষেই এগোতে হবে। কারণ এ অঞ্চলের আধিপত্য বজায় রাখার খেলার মাঠে শেষ গোলটা ভারত না চীন দেবে-এর উত্তর ভবিষ্যতের জন্য জমা রাখা যেতে পারে।

শ্রীলঙ্কায় আবার জাতীয়তাবাদী চেতনা বেশ প্রখর। ভারত বা চীন তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাক, এটা সিংহলিরা ভালো চোখে দেখেন না। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এটাও সত্য যে, এ অঞ্চলের ব্যাটনটি কার হাতে থাকবে তা নিয়ে দিন দিন ভারত ও চীনের মধ্য প্রতিযোগিতা ভালো জমে উঠছে।

রাজাপক্ষে প্রায় এক দশক ধরে শ্রীলঙ্কার একচ্ছত্র নেতা ছিলেন। নানান কর্মকাণ্ডের বিবেচনায় তাঁকে ‘রাজা’ও বলা হয়। সমর্থকদের অনেকেই এখনো সে সম্বোধনও করে থাকেন। রাজাপক্ষকে প্রায়ই তুলনা করা হয় প্রাচীন যুগের সিংহলি সম্রাটদের সঙ্গে। তামিল বিদ্রোহীদের কাছ থেকে ‘রাজা’ কীভাবে দেশকে বাঁচিয়েছেন, তার বিবরণসংবলিত গান এক সময় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে নিয়মিত প্রচার হতো। সেগুলো আবার অনলাইন ও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে বেশ ঘটা করেই প্রচার শুরু হয়েছে।

স্থানীয় নির্বাচনের এ ফল শ্রীলঙ্কার রাজনীতির জন্য অনেক কিছু। রাজাপক্ষে তার চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়ার বার্তা কিন্তু শ্রীলঙ্কায় বড় ধরনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলতে পারে। ২২৫ সদস্যের পার্লামেন্টের আগামী নির্বাচনের পর শ্রীলঙ্কা কোনো পথে যাবে ভবিষ্যতের জন্য সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভোটারদের।