বিদায় কাস্ত্রো যুগ, কে হচ্ছেন উত্তরসূরি?

রাফায়েল (প্রকৃত নাম নয়) হাভানা ইউনিভার্সিটি থেকে শিগগিরই পড়াশোনা শেষ করতে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর মন যেন পড়ে রয়েছে অন্য কোথাও। কিউবার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেখানে ফিন্যান্স ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়ানো হয়। সেভাবেই তিনি পড়ছেন। তিনি মনে করেন, এগুলো অন্য কোনো দেশে একইভাবে প্রয়োগ করা যায় না।

কিউবার সমাজতন্ত্রবাদী সরকার তাঁর শিক্ষাব্যয় বহন করছে। জীবনযাপনের জন্য মাসে চার ডলার বৃত্তি পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিন থেকে ১০ বারের খাবার কেনার জন্য তা যথেষ্ট। অতিরিক্ত হিসেবে বিদেশে বসবাসকারী ভাইবোনদের কাছ থেকে তিনি দুপুরের খাবারের অর্থ পান। রাফায়েলও বিদেশে চলে যেতে চান। ইউরোপের কোনো একটি দেশ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য বৃত্তি খুঁজছেন তিনি। যদি পেয়ে যান, তাহলে সেখানেই থেকে যাওয়ার ইচ্ছা। তাঁর মতে, সেখানে তিনি সত্যিকারের উপার্জন করতে পারবেন।

কিউবার আরও অনেক তরুণ রাফায়েলের মতোই ভাবছেন। তাঁরা কেউ কিউবার শাসনপদ্ধতি নিয়ে ক্ষুব্ধ নন। তাঁরা সমাজতন্ত্রের বিরোধিতাও করেন না। কিন্তু তাঁরা দেশ থেকে পালাতে চান। তাই দেশের শাসনতন্ত্রের হঠাৎ পরিবর্তন নিয়ে রাফায়েলের কোনো উত্তেজনা নেই। যদিও কিউবার ৬০ বছরের শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আসার খবর বিশ্বব্যাপী আলোচনায় পরিণত হয়েছে।

এক দশক ক্ষমতায় থাকার পর কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো আজ বৃহস্পতিবার ক্ষমতা ছাড়ছেন। এর মধ্য দিয়ে শেষ হতে যাচ্ছে দীর্ঘ ছয় দশকের কাস্ত্রো যুগ। তাঁর বড় ভাই কিংবদন্তি নেতা ফিদেল কাস্ত্রো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৫৯ সালে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। ফিদেল কাস্ত্রো অসুস্থ হয়ে পড়লে ২০০৮ সালে ৮৬ বছর বয়সী রাউল কাস্ত্রো ক্ষমতায় আসেন। দুই ভাই মিলে কিউবা শাসন করেছেন প্রায় ৬০ বছর। কিউবার একসময়ের পরম মিত্র পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে তা খণ্ড খণ্ড হয়ে গেলেও নিজ দেশে সমাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছিলেন এই দুই ভাই।

তবে এ সবকিছুই প্রভাবিত করছে না তরুণ ছাত্র রাফায়েলকে। তিনি মনে করেন, কাস্ত্রোর চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু ‘তাতে আমার কিছু যায়-আসে না।’

রাউল কাস্ত্রো। ছবি: রয়টার্স
রাউল কাস্ত্রো। ছবি: রয়টার্স

তবে রাফায়েলের কাছে এটা কোনো বিষয় না হলেও কিউবার ১ কোটি ১০ লাখ অধিবাসীর বেশির ভাগের কাছে এটা একটি বড় ব্যাপার; বিশেষ করে যাদের এই রাষ্ট্র ছেড়ে চলে যাওয়া তত সহজ নয়। দেশটিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা প্রায় দেখাই যায় না। ধারণা করা হচ্ছে, রাউল কাস্ত্রো দেশটির ‘প্রথম’ ভাইস প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াস-কানেলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। রাউল কাস্ত্রোর বড় ভাই ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৫৯ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত স্বৈরশাসক ফালজেনসিও বাতিস্তাকে অপসারণ করেন, তখন দিয়াস-কানেলের জন্মই হয়নি। আশা করা যায়, দেশটিতে বিপ্লব-পরবর্তী প্রজন্ম শাসনপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনবেন এবং সরকারের কাছে সাধারণ নাগরিকদের প্রত্যাশার বিষয়গুলো তুলে ধরবেন। তবে নতুন নেতারা কীভাবে বিষয়গুলো তুলে ধরবেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

ভাইস প্রেসিডেন্ট দিয়াস-কানেল একজন প্রকৌশলী। তিন দশক ধরে সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টিতে থাকা অবস্থায় সততার জন্য তিনি সুনাম কুড়ান। নিজ এলাকা কিউবার কেন্দ্রীয় প্রদেশ ভিল্লা ক্লারায় তিনি অফিসের গাড়ির পরিবর্তে বাইসাইকেলে চলাচল করতেন। গতবার দেশটির একদলীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে তিনি অন্য ভোটারের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছিলেন। চিন্তাভাবনায় তিনি অন্যদের তুলনায় উদার। তিনি বেশ আগে থেকেই সমকামীদের অধিকার দেওয়ার পক্ষে। ২০১৩ সালে কিছু শিক্ষার্থী ব্লগার সরকারের সমালোচনা করার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ওই সময় ওই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করেন দিয়াস-কানেল। পরে তিনি শিক্ষার্থীদের নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে আসেন এবং বলেন, ইন্টারনেটের এই যুগে কোনো কিছু নিষিদ্ধ করা মতিভ্রম ছাড়া কিছু নয়।

দেশটিতে ব্যাপক পরিবর্তনের অংশ হিসেবেই প্রেসিডেন্ট পদে দিয়াস-কানেলের নাম এসেছে। কিউবার পার্লামেন্ট তাঁকে রাউল কাস্ত্রোর উত্তরসূরি হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে। দিয়াস-কানেল এই পদের জন্য একমাত্র প্রার্থী ছিলেন। কয়েকজন অশীতিপর রক্ষণশীল, যেমন হোসে র‍্যামন মাচাদো ভেনচুরা এবং রামিরো ভালদেস, দেশটিতে আইনপ্রণয়নে ক্ষমতাশীল প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অব স্টেট ছেড়ে চলে যেতে পারেন। দিয়াস-কানেল তাঁর নিজের লোকজন নিয়ে নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে এই পরিবর্তন হলেও তা দ্রুত হবে না। রাউল কাস্ত্রো ২০২১ সাল পর্যন্ত পলিটব্যুরোর প্রধান হিসেবে থাকতে পারেন, এটাই কমিউনিস্ট পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। নীতিগত বিষয়ে নির্দেশনা দেবে পলিটব্যুরো। ভেনচুরা সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে থাকবেন। আর দিয়াস-কানেল হবেন তৃতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি।

তবে কিউবার অধিবাসীরা পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা করছেন, তেমন সংস্কারক দিয়াস-কানেল না-ও হতে পারেন। কমিউনিস্ট পার্টির একান্ত বৈঠকের এক ভিডিও গত বছরের আগস্টে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, তিনি সরকারের সমালোচনাকারী গণমাধ্যমগুলো বন্ধ করবেন এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের টুঁটি চেপে ধরবেন বলে হুংকার দিচ্ছেন। ২০১৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কিউবার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা শুরু করেন। এটা দিয়াস-কানেল তত পছন্দ করেননি। তিনি বলেন, এটা কিউবার বিপ্লবকে ধ্বংস করার চক্রান্ত। এই ভিডিও দেখার পর অনেকেই বলেন, প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথটি নিশ্চিত করছেন দিয়াস-কানেল। এই ভিডিও প্রমাণ করে, তিনি সরকারের সমালোচক ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন নন। এ ক্ষেত্রে তিনি ফিদেল কাস্ত্রো ও রাউল কাস্ত্রোর চেয়েও বিরূপ। বিরোধী দল বা মুক্ত গণমাধ্যমের পথ প্রশস্ত করবেন এমন আশা তাঁর কাছ থেকে করা যায় না।

তবে সংস্কারের ক্ষেত্রে দিয়াস-কানেল চীন ও ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির শাসনব্যবস্থাকে অনুসরণ করতে পারেন—এমন আশা করা যেতে পারে। সেখানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়েও বাজার মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে এবং নাগরিকদের নিজেদের সমৃদ্ধ করতে বলা হয়েছে। তবে কিউবার রাজনীতিকেরা মনে করেন, এ ব্যবস্থা তাদের দেশকে ধনী মার্কিনদের জন্য সস্তায় পণ্য তৈরির দেশে পরিণত করতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, দিয়াস-কানেল কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার না এনে পারবেন না। দেশটিতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। দিনে দিনে তা আরও নাজুক হচ্ছে। ব্যবসার ক্ষেত্রেও আগের তুলনায় পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। ২০১২ সালে সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে ২০১৬ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে হারিকেন ইরমা আঘাত হানার পর কিউবায় বাজেট-ঘাটতি জিডিপির ১২ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। গ্রামগুলোয় সেভাবে উন্নয়ন হয়নি। এক দশক ধরে কৃষি উৎপাদন থমকে আছে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ খাদ্যসামগ্রী বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ পাভেল ভিদাল বলেন, ১৯৮৫ সালের তুলনায় কিউবার অর্থনীতির আকার এক-তৃতীয়াংশ ছোট হয়ে এসেছে। ওই সময় দেশটির মিত্র দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে সহায়তা মিলত। এখন সেই সুযোগ নেই।

রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে মিগেল দিয়াস-কানেল (বায়ে)। ছবি: রয়টার্স
রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে মিগেল দিয়াস-কানেল (বায়ে)। ছবি: রয়টার্স

কিউবার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষের মাসিক গড় আয় ৩০ ডলার। তারা কাজ করে বিভিন্ন অদক্ষ রাষ্ট্রীয় খাতে। তবে মাথাপিছু আয় কম হলেও শিক্ষা, চিকিৎসা সেখানে বিনা মূল্যে মেলে। খাদ্য ও আবাসন খাতেও রয়েছে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি।

রাউল কাস্ত্রোর এক দশকের শাসনামলে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে গতিশীল করতে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বেসরকারি খাতে অংশগ্রহণ বাড়াতে নানা সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে সেসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সরকারের কার্যকর ভূমিকা না থাকায় তা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

তবে ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক উইলিয়াম লিওগ্রান্দের মতে, সংস্কারের মধ্য দিয়ে কিউবা দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পাবে। রাউলের উত্তরসূরিরা তাঁর সংস্কারের পথে হাঁটলে রাউল কিউবার দেং জিয়াও পিং হয়ে থাকবেন। সংস্কারের মধ্য দিয়েই চীনে পরিবর্তন এনেছিলেন দেং। তবে সংস্কার থমকে গেলে রাউল শুধু একজন সংস্কারবাদী কমিউনিস্ট হিসেবে গণ্য হবেন। তাঁর ব্যাপারে বলা হবে, যথেষ্ট চেষ্টা করেও তিনি প্রথাগত ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন আনতে পারেননি। এএফপি, রয়টার্স ও ইকোনমিস্ট অবলম্বনে