ভারতে শীর্ষ রাজনীতিকদের বিদ্বেষপূর্ণ বুলি ৫০০ শতাংশ বেড়েছে

ভারতে গত চার বছরে শীর্ষ রাজনীতিকদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো কথার পরিমাণ প্রায় ৫০০ শতাংশ বেড়েছে।

এখন বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ভারতে ক্ষমতায় আছে। এর আগে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার ছিল। কংগ্রেসের সেই সরকারের চেয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারের সময় ব্যাপক হারে বেড়েছে ধর্ম, বর্ণ, জাতি নিয়ে রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য।

ভারতের ইংরেজি সংবাদের টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভি এই জরিপ করেছে। প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন, ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা মন্তব্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। ঘৃণা কে ছড়াননি? বিধানসভার সদস্য, লোকসভার সদস্য, মন্ত্রী, বিজেপির সভাপতি—কেউই বাদ যাননি। এসব ঘৃণা ছড়ানো মন্তব্য বাড়লেও এর জন্য মন্তব্যকারীদের শাস্তির নজির একেবারেই নগণ্য।

এনডিটিভি ঘৃণানির্ভর বাক্য হিসেবে সেসব মন্তব্যকেই গণ্য করেছে, যেগুলো কোনো সম্প্রদায়, জাতিকে খাটো করে করা হয়েছে এবং যেগুলো হিংসা ছড়ানোর আশঙ্কা ছিল। এসব মন্তব্য আবার আইনের দৃষ্টিতেও ছিল শাস্তিযোগ্য। ভারতীয় দণ্ডবিধির অন্তত তিনটি ধারায় মন্তব্যগুলো দণ্ডযোগ্য। তবে এখানে তির্যক বা নারীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার এবং ২০১৪ থেকে এ বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ইউপিএ সরকারের সময় করা মন্তব্যগুলো বিবেচনায় নিয়েছে এনডিটিভি। এ সময়ে মোট ১ হাজার ৩০০ প্রতিবেদন এবং টুইটারে করা ১০০০ বার্তা বিশ্লেষণ করা হয়। দেখা গেছে, ২০১৪ সালের মে মাস থেকে চলতি এপ্রিল মাস পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ১২৪ বার ঘৃণা ছড়িয়েছেন। ৪৪ জন রাজনীতিক এসব কথা বলেছেন। অন্যদিক, আগের কংগ্রেস সরকারের সময় এ ধরনের বাক্যের সংখ্যা ছিল ২১। অর্থাৎ, মোদি সরকারের সময় ঘৃণা ছড়ানো বাক্যের সংখ্যা বেড়েছে ৪৯০ শতাংশ।

মোদি সরকারের সময় যে ৪৪ জন রাজনীতিক ঘৃণানির্ভর কথাবার্তা বলেছেন, তাঁদের মধ্যে ৩৪ জনই বিজেপির। অর্থাৎ, ৭৭ শতাংশ বিদ্বেষপূর্ণ কথা বলেছেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী এ দলের নেতারা। বাকি ২৩ শতাংশ অন্য দলের নেতা।

আবার কংগ্রেস আমলে ঘৃণানির্ভর কথা বলা ২১ রাজনীতিকের ৩ জন বা ১৪ শতাংশ ছিলেন কংগ্রেসের। তখনকার বিরোধী দল এমন কথার দিক থেকে তখনো এগিয়ে ছিল। তাদের সাত নেতা তখন বিদ্বেষী কথা বলেছেন। বাকি ১১ রাজনীতিক সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি, মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন ও শিবসেনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

জরিমানা হয় না
মোদি সরকারের সময় যে ৪৪ রাজনীতিক ঘৃণামিশ্রিত কথা বলেছেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র পাঁচজনকে (মোট রাজনীতিকের ৪ শতাংশ) সাবধান করে দেওয়া বা ক্ষমা চাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ৯৬ শতাংশ ক্ষেত্রে এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে কোনোরূপ জরিমানা দিতে হয় না বা তাঁদের কোনো শাস্তিও হয় না।

ঘৃণা ছড়ানো ব্যক্তিদের অবস্থান বরং দৃঢ় হয়
যোগী আদিত্যনাথ এখন ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে তিনি লোকসভার সদস্য ছিলেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘শাহরুখ খান ও হাফিজ সাইদের কথার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ওই আদিত্যনাথই বলেন, উত্তর প্রদেশে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বাড়ার কারণ সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বৃদ্ধি।

এসব ঘৃণা ছড়ানোর দায়ে যোগী আদিত্যর কোনো জরিমানা হয়নি; বরং এমপি থেকে মুখ্যমন্ত্রীতে পদোন্নতি হয় তাঁর।

২০১৬ সালে কর্ণাটক থেকে নির্বাচিত বিজেপির এমপি অনন্ত কুমার হেগড়ে বলেন, বিশ্বে যত দিন পর্যন্ত ইসলাম থাকবে, তত দিন সন্ত্রাস বন্ধ হবে না।

২০১৭ সালে হেগড়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন।

২০১৪ সাল থেকে একের পর ঘৃণা ছড়ানো কথা বলে বেড়িয়েছেন হেগড়ে।
রাজনীতিকদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা এই হেগড়ের মতোই বারবার বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ চালাতে থাকেন। এঁদের মধ্যে আছেন তেলেঙ্গানার বিজেপি বিধায়ক টি রাজা সিং। গত বছরের নভেম্বরে তিনি হুমকি দেন, ‘পদ্মাবতী’ চলচ্চিত্রের প্রদর্শন করা হলে প্রেক্ষাগৃহ পুড়িয়ে দেওয়া হবে।

এ বছরের জানুয়ারিতে তিনি বলেন, ‘অন্য কোনো ধর্মের মানুষ যদি কিছু বলে, তবে প্রতিটি হিন্দুর উচিত হাতে অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করা।’ ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে অন্তত ১০টি ঘৃণার বাক্য বলেছেন তিনি।

ঘৃণামিশ্রিত কথা ছড়িয়েছেন ভারতের এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন এমপি বিনয় কাটিয়ার এবং ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায়।

গরুর ওপর যত ঘৃণা
ভারতে গত নয় বছরে যত ঘৃণামিশ্রিত কথা হয়েছে, এর বড় একটি অংশই হয়েছে গরু রক্ষার নামে। এঁদের মধ্যে বিধায়ক, এমপি, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীও আছেন। গত বছরের এপ্রিলে ছত্তিশগড় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রমণ সিং বলেন, ‘এ রাজ্যে গরু হত্যার মতো কোনো ঘটনা ঘটে না। এ রাজ্যে ১৫ বছর ধরে এ ঘটনা ঘটে না। যারা এমন ঘটনা ঘটাবে, তাদের ঝুলিয়ে মারা হবে।’

গত বছর উত্তর প্রদেশের বিধায়ক বিক্রম সাইনি বলেন, ‘যারা গরুকে তাদের মা হিসেবে মনে করবে না, আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তাদের হাত-পা ভেঙে দেব।’

রাজস্থানের বিজেপি বিধায়ক জ্ঞানদেব আহুজা বলেন, ‘আমি পরিষ্কার বলছি, কেউ যদি গরু চোরাচালান বা গরু হত্যা করে, তবে তাদের মেরে ফেলা হবে। গরু আমাদের মা।’

মুসলিমরা মূল লক্ষ্যবস্তু
ঘৃণা ছড়ানোর একটি বড় অংশজুড়ে আছে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য। তাদের মধ্যে ভীতি ছড়ানোর জন্যও এসব কথা বলা হয়। এ বছরের জানুয়ারিতে উত্তর প্রদেশের এক বিজেপি বিধায়ক বলেন, ‘যেসব মুসলিম আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারবে, তারাই কেবল ভারতে থাকবে। যারা তা করতে পারবে না, তারা অন্য দেশে চলে যেতে পারে।’

বিজেপির এমপি সাক্ষী মহারাজ গত বছরের জুনে হিন্দু নারীদের চারটি করে সন্তান গ্রহণের আহ্বান জানান। ধর্মরক্ষার জন্যই এ কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

বিজেপির এমপি সুব্রাহ্মনিয়াম স্বামী গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে অন্তত ১৭টি ঘৃণানির্ভর বার্তা লিখেছেন।

শীর্ষ নেতারা নিশ্চুপ থাকেন
যাঁরা ঘৃণা ছড়ান, সেসব নেতাকে সংযত করতে ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি মোটেও তৎপর নয়। বরং শীর্ষ নেতৃত্ব কখনো কখনো এমন কথা বলেছেন, যার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থেকেছে। এসব ব্যক্তির মধ্যে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহও রয়েছেন।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে উত্তর প্রদেশের ফতেহপুরে এক নির্বাচনী সমাবেশে মোদি বলেন, ‘রমজান মাসে যদি বিদ্যুতের সরবরাহ থাকতে পারে, তবে দেওয়ালির সময়ও থাকতে হবে। কোনো বৈষম্য করা যাবে না।’

২০১৫ সালে বিহারের নির্বাচনের সময় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেন, ‘বিজেপি যদি এই নির্বাচনেও কোনোক্রমে হেরেও যায়, তবে বিহারে জয়-পরাজয় হবে। কিন্তু পাকিস্তানে এরপর বাজি পুড়বে।’

ধর্ম নিয়ে নানা কটুবাক্য বর্ষণ কয়েক বছর ধরে ভারতের রাজনীতিতে বাড়ছে। বড় নেতাদের নিয়েও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যও বাড়ছে। গত বছরের অক্টোবরে বিহারে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের বিধায়ক তেজপ্রতাপ যাদব বলেন, ‘লালুজিকে (লালুপ্রসাদ যাদব) হত্যার চক্রান্ত চলছে। এ ধরনের ঘটনায় আমরাও বসে থাকব না। নরেন্দ্র মোদির চামড়া তুলে নেব।’

এর এক সপ্তাহ আগে তেজ প্রতাপের মা ও লালুর স্ত্রী, বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ি দেবী বিজেপির এমপি নিত্য অনন্ত রাইয়ের আঙুল কেটে ফেলার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘এমন অনেক লোক আছে, যারা প্রধানমন্ত্রী মোদির হাত ও গলা কেটে ফেলতে পারে।’

কংগ্রেসি আমলে যত ঘৃণা
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে তখনকার এমপি রাহুল গান্ধী বলেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে ২২ হাজার মানুষ মারা পড়বে।

ওই বছরের নির্বাচনে উত্তর প্রদেশের কংগ্রেস নেতা ইমরান মাসুদ বলেন, ‘মোদি যদি উত্তর প্রদেশকে গুজরাট বানাতে চান, তবে তাঁকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব।’

২০১২ সালে অন্ধ্র প্রদেশের বিধায়ক এবং মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন নেতা আকবরউদ্দিন ওয়াইসি বলেন, ‘পুলিশ প্রত্যাহার করুন, আমরা ১০০ কোটি হিন্দুকে শেষ করে দেব।’