আলফা কন্ডে, গিনির জাতির পিতা
একজন নিরাপত্তারক্ষী তার বন্দুক উঁচিয়ে ধরে বলল, ‘তোমার ব্যাগে সন্দেহজনক কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে।’ অথচ সেখানে ময়লা জামাকাপড় ছাড়া আর কিছু ছিল না। চর্মসার মোজাগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি বলে মনে করেছিল রক্ষীটি। কপাল, তার (রক্ষী) কাছে এর সমাধানও ছিল। সে বলল, ‘আমাকে ৪০ হাজার ফ্রাঙ্ক (৪.৫০ ডলার) দাও, আমি ব্যাপারটা দেখছি।’ সিয়েরা লিওন থেকে গিনির রাজধানী পর্যন্ত প্রধান সড়কে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীরা অস্থায়ী তল্লাশিচৌকি বসিয়ে চাঁদা আদায় করছে। সমস্ত বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও এক ঘণ্টার কম সময়ে দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদক সেখানে আটবার চাঁদা দিতে বাধ্য হন।
এসব সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডের শাসনামলে গিনি তুলনামূলক কম দুর্নীতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। তিনি যে বছর ক্ষমতায় বসেন, সে বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে ১৭৮টি দেশের মধ্যে দুর্নীতির তালিকায় গিনির অবস্থান ছিল ১৬৪। এখন দুর্নীতির সেই ঊর্ধ্বগতি কিছুটা কমেছে। সীমান্ত পুলিশের চাঁদাবাজি সত্ত্বেও ২০১৭ সালে গিনির অবস্থান ছিল ১৪৮ নম্বরে।
১৯৩৮ সালে জন্ম নেওয়া আলফা কন্ডে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো গিনির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে ফ্রান্সের থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর সেটাই ছিল গিনির প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। কিন্তু এ পথ সহজ ছিল না। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল আন্দোলন করেন আলফা কন্ডে। এ জন্য তিনি নির্বাসন ও কারাভোগ করেন। ২০১৫ সালে গিনির পরবর্তী নির্বাচনেও জয়লাভ করেন কন্ডে।
গিনির দুর্নীতি দমন খুব সহজ হয়নি। ঘুষের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণকারী রাজস্ব বিভাগের এক প্রধান ২০১২ সালে সামরিক উর্দি পরা লোকদের হাতে নিহত হন। আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, বড় কর্মকর্তাদের কখনো দুর্নীতির দায়ে ধরা হয় না। মানবাধিকার সংগঠন ‘সেম রাইটস ফর অল’-এর প্রতিষ্ঠাতা ফ্রেডরিক লউয়া বলেন, ‘কারাগারে আছে শুধু মুরগিচোরেরা।’
আলফা কন্ডে বলেন, তাঁর দেশ এখন অনেক বেশি শান্তিপূর্ণ অবস্থায় আছে। সাবেক ভিন্নমতাবলম্বী এবং রাজনৈতিক বন্দী এ নেতার কথায় যুক্তি আছে। গিনির সাবেক শাসকদের নৃশংস বাহিনী ছিল। ২৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আহমেদ শেকু তোরেসহ অন্য সামরিক জান্তাদের বাহিনী প্রতিপক্ষের প্রচুর লোকেদের ধর্ষণ ও হত্যা করে। সে তুলনায় আলফা কন্ডের বেসামরিক শাসন অনেক বেশি শান্তিপূর্ণ।
গিনির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে। গত বছর এটি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল। খনিশিল্পে কার্যকর উদ্যোগের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য নেওয়া সরকারি উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে প্রভাবকের কাজ করেছে।
বিপুল খনিজ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও গিনি খুবই দরিদ্র একটি দেশ। জনপ্রতি জিডিপি ৮০০ ডলারের কিছু বেশি। যেটি ওই অঞ্চলের গড় জিডিপির প্রায় অর্ধেক। এতে সাধারণ মানুষ ক্রমেই অধৈর্য হয়ে পড়ছে। হাজার হাজার মানুষ তাদের অল্প মজুরির কারণে হতাশ। বিদ্যুতের অভাব, পুলিশের নিপীড়ন এবং সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দুর্নীতি নিয়ে তাদের অভিযোগ রয়েছে। গত দুই মাসের সহিংসতায় সেখানে ১৫ জন মারা গেছে।
গিনির জাতিগত উত্তেজনায় এটি একটি অশুভ সংকেত। প্রেসিডেন্টের দল র্যালি অব দ্য গিনিয়ান পিপলের (আরপিজি) মূল নিয়ন্ত্রক মালিংকে জাতিগোষ্ঠী। গিনির মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশই এ জাতিগোষ্ঠীর লোক। আবার প্রধান বিরোধী দল ইউনিয়ন অব ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস অব গিনির (ইউএফডিজি) নিয়ন্ত্রক পিউল জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এরা মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ শতাংশ। পিউল জাতির অনেক মানুষ মনে করে, কন্ডের শাসনামলে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ইউএফডিজির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তাদের বেশ কিছু লোক নিহত হয়েছে। পরিস্থিতি ঠান্ডা করার পরিবর্তে কিছু রাজনীতিবিদ বরং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দলের নেতা-কর্মীদের উসকে দিচ্ছেন।
তবে জাতিগত উত্তেজনার এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন কন্ডে। বেলজিয়ামের ফ্লেমিংস এবং ওয়ালুনস জাতিগোষ্ঠীর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘এরা একসঙ্গে থাকতে পারছে না, কিন্তু কেউই তাদের সহিংসতা নিয়ে কথা বলে না। তারা শুধু আফ্রিকার জাতিগত সংঘাত নিয়ে সরব।’
অনেকেই এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন যে প্রেসিডেন্ট কন্ডে হয়তো ২০২০ সালে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার জন্য সংবিধান পরিবর্তন করবেন। সেটা হলে সহিংসতা বাড়বে। কন্ডে দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, ‘এটি গিনির জনগণের ব্যাপার, আমার নয়।’ অবশ্য তিনি মনে করেন, আফ্রিকান প্রেসিডেন্টরা কত মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সময়সীমা থাকা উচিত নয়। তাতে তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পরিকল্পনাগুলো বাধাগ্রস্ত হয়। অবশ্য আফ্রিকার সাধারণ জনগণের কাছে এ রকম কথা বেশ পুরোনো।
আলফা কন্ডের সঙ্গে আলাপকালে তাঁর প্রাসাদের বাইরে একটি গাড়ি যাচ্ছিল, সেখান থেকে লাউডস্পিকারে গান ভেসে আসছিল—‘আলফা কন্ডে জাতির পিতা। আলফা কন্ডে সব নারীর অভিভাবক।’ এটা ঠিক যে আলফা কন্ডে গিনিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এনেছেন। কিন্তু তাঁর এটাও জানা উচিত, কখন বিদায় নিতে হবে।