উন্নত দেশের চিকিৎসাতেও নারীর ব্যথা উপেক্ষিত!

প্রতীকী ছবি। রয়টার্স ফাইল
প্রতীকী ছবি। রয়টার্স ফাইল

উন্নত দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি নেই। রোগী যাওয়ামাত্রই চিকিৎসকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েন রোগ নির্ণয়ে। নারী-পুরুষ যে-ই হোন না কেন, রোগীর কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনেন। এমন ধারণা যাঁরা পোষণ করেন, তাঁদের জন্য জেনিফার বা অ্যাবির গল্প হতাশাই বাড়াবে।

অভিযোগ রয়েছে, উন্নত দেশেও নারীরা চিকিৎসায় অবহেলিত হন। রোগের ব্যাপারে, বিশেষ করে ব্যথার ক্ষেত্রে নারীরা খুব বেশি অভিযোগ করেন উল্লেখ করে নারীর ব্যথাকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। নারীর ব্যথাকে ‘দুশ্চিন্তা’ উল্লেখ করে প্রায়ই তাঁদের পাঠানো হয় মনোচিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীর কাছে। এমনকি উন্নত দেশের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত গবেষণাতেও দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ছিলেন নারীরা।

জেনিফার বিলক নামে এক নারী বিবিসি অনলাইনে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেছেন, চিকিৎসকের কাছে গিয়ে যখন সমস্যার কথা জানান, তখন চিকিৎসক ততটা গুরুত্ব দেননি। চিকিৎসকের মতে, অন্য নারীদের মতো জেনিফারও শরীরের দিকে বেশি নজর দিচ্ছেন। তিনি জেনিফারকে দুশ্চিন্তা না করতে এবং সমস্যাটি নিয়ে না ভাবতে বলেন। এটা ২০০৯ সালের কথা। ওই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর জেনিফারকে বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে হয়েছিল। হার্টবিট ছিল প্রতি মিনিটে ২২০। জরুরি বিভাগের কর্মী জানালেন, তাঁর ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হয়েছে। তাঁকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো। এরপর তিনি আবার চিকিৎসকের কাছে গেলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো। নিজেও ভাবলেন, দুশ্চিন্তা থেকে এমন হচ্ছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে হবে।

জেনিফার বলেন, ‘এরপর থেকে এমন বুকে ব্যথা হতেই থাকল। প্রথমে প্রতি মাসে। এরপর প্রতি সপ্তাহে। নয় বছর ধরে এমন চলতেই থাকল। আমিও চিকিৎসকের কাছে সমস্যার কথা বলেই যেতে লাগলাম। আর চিকিৎসকও আমাকে আগের মতোই বলতে লাগলেন, দুশ্চিন্তা থেকে আতঙ্কিত হয়ে আমার বুকে ব্যথা হচ্ছে। আমার যেমনভাবে বুকে ব্যথা দেখা দেয়, নারীদের হৃদ্‌যন্ত্রের ব্যথা সেভাবে হয় না বলে জানানো হয় আমাকে।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এ অভিজ্ঞতা শুধু জেনিফার একার নয়। নারীদের রোগকে পাত্তা না দেওয়ার এমন প্রবণতা রয়েছে উন্নত দেশে।
‘আসক মি অ্যাবাউট মাই ইউটেরাস’-এর লেখক অ্যাবি নরমান তাঁর সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকদের গুরুত্ব না দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে লিখেছিলেন। বইটিতে তিনি লেখেন, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায় যে তাঁর এন্ডোমেট্রিওসিস আছে। জরায়ুর ঝিল্লিতে থাকা গ্রন্থি ও টিস্যু জরায়ু ছাড়াও পেটের অন্য স্থানে দেখা দিলে তাকে এন্ডোমেট্রিওসিস বলে। এটা অনেক যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি। তাঁর এই সমস্যা ধরা পড়ার আগে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, তাঁর মূত্রনালির সংক্রমণ রয়েছে। রোগের উপসর্গ শুনে এক চিকিৎসক এমনও বলেছিলেন, শিশু অবস্থায় যৌন নির্যাতনের শিকার হলে এমনটা হয়। অথচ নরমান নিশ্চিত তিনি এমন কোনো নির্যাতনের শিকার হননি।

নারীরা ব্যথার কথা বললে পাত্তা না দেওয়ার এমন আরও নানা উদাহরণ রয়েছে। ২০১৪ সালের সুইডেনে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরুরি বিভাগে ব্যথা নিয়ে আসা নারী-পুরুষদের মধ্যে নারীটিকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়।
এ ছাড়া চিকিৎসক ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার পর তা হাতে পেতেও নারীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।

প্রতীকী ছবি। এএফপি ফাইল
প্রতীকী ছবি। এএফপি ফাইল

জরুরি বিভাগে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার কারণে এ বছর মে মাসে ফ্রান্সে এক তরুণীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। ২২ বছর বয়সী ওই তরুণী তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে জরুরি সেবা পেতে ফোন করেন। ফোন অপারেটরকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পেটে এত ব্যথা হচ্ছে যে মনে হচ্ছে মারা যাব।’ ফোন অপারেটর নির্বিকার কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সবার মতো তোমাকেও একদিন মরতে হবে।’ ওই তরুণীকে হাসপাতালে আনার পর পাঁচ ঘণ্টা তাঁকে অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়। ওই সময় স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।

নারীরা তলপেটের ব্যথা নিয়ে গেলে তা গাইনি সমস্যা বলে ধরে নেওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। এ ছাড়া ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আসা নারীদের দুশ্চিন্তা রোধক ওষুধ দেওয়ার চেয়ে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত রোগী হিসেবেই বেশি বিবেচনা করা হয়।

এ ব্যাপারে ক্রনিক পেইন রিসার্চ অ্যালায়েন্সের পরিচালক ও সহপ্রতিষ্ঠাতা ক্রিস্টিন ভিসলে বলেন, পুরুষদের যেখানে রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। সেখানে নারীদের বেশির ভাগকে পাঠানো হয় মনোচিকিৎসক বা মনোবিজ্ঞানীদের কাছে। এ ব্যাপারে নারী রোগীদের কাছ থেকে শোনা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘নারীদের কাছ থেকে জেনেছি, চিকিৎসকেরা তাঁদের যা বলেছেন, তা রীতিমতো ভয়াবহ। যেমন কোনো কোনো চিকিৎসক রোগের কথা শুনে বলেছেন, নিশ্চয় তোমার স্বামীর সঙ্গে সমস্যা হয়েছে। যৌন সংসর্গের আগে তুমি বরং এক গ্লাস ওয়াইন নিয়ো। এটা ভালো কাজ দেবে।’ এমন মন্তব্যের তালিকা আরও দীর্ঘ বলে তিনি জানান।

তবে ব্যাপারটিকে ঠিক বৈষম্য বলে মানতে রাজি নন যুক্তরাষ্ট্রের জাকারবার্গ সান ফ্রানসিসকো জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ইসথার চেন। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে নারীরা অনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এটা বলা খুবই কঠিন। কারণ, একজন নারী তাঁর ব্যথাকে চিকিৎসকের কাছে যেভাবে তুলে ধরবেন, সেই ভিত্তিতেই চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে।

সাধারণভাবে বলা হয়, রোগের সমস্যার ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে নারীরা তাড়াতাড়ি অভিযোগ জানান। যুক্তরাজ্যের এক গবেষণামতে, নারীর চেয়ে পুরুষেরা চিকিৎসকদের ৩২ শতাংশ কম অভিযোগ জানান। নারীদের ব্যথা কম গুরুত্ব দেওয়ার এটা একটা কারণ হতে পারে। তবে অন্য একটি গবেষণা বলছে, পুরুষের চেয়ে নারী রোগের অভিযোগ বেশি করে এটা ভুল ধারণা। বরং একই ধরনের ব্যথার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অভিযোগ একই সমান। মাথাব্যথা ও মেরুদণ্ডের ব্যথার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমানভাবেই চিকিৎসকের কাছে যান।
অন্যদিকে অনেক গবেষক ও চিকিৎসকেরা বলছেন, ১৯৭২ সালের আগে ও ২০০৩ সালের ভিন্ন ভিন্ন গবেষণায় পাওয়া গেছে, পুরুষের চেয়ে নারীর ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা কম। পাশাপাশি নারীদের রোগের উপসর্গের সঙ্গে দুশ্চিন্তার সম্পর্ক রয়েছে বেশি। নারীদের ব্যথানাশক ওষুধ গ্রহণেরও প্রবণতা অত্যন্ত বেশি।
এ বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলোজিস্ট কারেন সিবার্ট। তিনি বলেন, ‘যখন মানুষ দুশ্চিন্তায় থাকে, তাদের ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা কমে যায়। ব্যথা কী কারণে, তা নির্ণয়ের আগে তাঁদের দুশ্চিন্তা ও ভয় কাটানোর চেষ্টাই করা উচিত।’

উন্নত দেশে স্বাস্থ্য গবেষণার ক্ষেত্রেও দীর্ঘদিন নারীরা উপেক্ষিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
১৯৯০ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ) নারী স্বাস্থ্যের ওপর গবেষণা শুরু করার আগে মার্কিন মুলুকে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার গবেষণার ক্ষেত্রে পুরুষদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরত। ইউরোপেও এসব গবেষণায় নারীদের বাইরে রাখা হয়েছে। কানাডা ও যুক্তরাজ্যেও একই পরিস্থিতি।
২০১৫ সালে এনআইএইচ নারী ও পুরুষ দুই লিঙ্গকেই স্বাস্থ্য গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করতে এক নতুন নীতিমালা গ্রহণ করে। তবে নীতিমালাটি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে কি না, তা কয়েক বছর না গেলে বোঝা যাবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) ‘নারীর কথা শোনো’ শিরোনামে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। যদি এটি এন্ডোমেট্রিওসিস নির্ণয়কে গতিশীল করার জন্য বেশি প্রযোজ্য। একই ধরনের নীতি ২০০০ সালের শুরুতে নিয়েছে কানাডা ও ইউরোপ। তবে এসবই গবেষকদের জন্য পরামর্শ ও সুপারিশ। এর কোনোটিই আইনে রূপ পায়নি।

নারীর চিকিৎসায় অবহেলার বিষয়টি তুলে ধরে ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০০১ সালে ডিয়ান হফম্যান ও আনিতা তারজিয়ানের যৌথ ওই গবেষণায় বলা হয়, ব্যথা নিয়ে নারী ও পুরুষ চিকিৎসকের কাছে গেলে নারীরা বৈষম্যের শিকার হন। ব্যথা মুক্তির জন্য নারীকে সাধারণত ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়। আর পুরুষদের দেওয়া হয় ব্যথা কমানোর ওষুধ। প্রায়ই নারীরা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে যথাযথ চিকিৎসা পান না। গত বছর আনিতা তারজিয়ান এ ব্যাপারে বলেন, ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের ১৬ বছর পরও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তিনি বলেন, ‘সব সময় মনে হয় যেন এই অবস্থার পরিবর্তন হবে। কিন্তু বিভিন্ন সংবাদ জানার পর বোঝা যায়, আসলে এর কোনো পরিবর্তনই হয়নি’।

যে নারীর কথা নিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছে, সেই জেনিফার বিলক জানান, শেষ পর্যন্ত তিনি একজন হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞকে পেয়েছেন, যিনি মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনেছেন। তাঁর ব্যথা দুশ্চিন্তার কারণে বলে উড়িয়ে না দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এ বছরের মার্চে তাঁর অপারেশন হয়েছে। হৃদ্‌রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা পেতে যদিও তাঁর নয়টি বছর লেগে গেছে। তবে সঠিক চিকিৎসা পেতে দীর্ঘ যাত্রার এই অভিজ্ঞতা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছে, নারীদের ব্যথার মর্ম বোঝাতে আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে।