অবরোধেও কাতারে স্থিতিশীল বাংলাদেশের শ্রমবাজার

সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের কাতারের ওপর অবরোধের পরও বাংলাদেশ থেকে এ দেশে জনশক্তি আমদানির ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি। উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় কাতারে বাংলাদেশি কর্মী আসার হার স্থিতিশীল রয়েছে। গত বছরের পবিত্র রমজান থেকে এবারের রমজান মাস—এই এক বছরে বিগত বছরের প্রায় সমসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী কাতারে এসেছেন। বেশির ভাগই আসছেন কাতারের নির্মাণ খাতের বিভিন্ন প্রকল্পের ভিসায়।
বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি ও কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ ব্যুরোর প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে কাতারে মোট কর্মী এসেছেন ২৮ হাজার ৯৫৫ জন। মাসওয়ারি হিসাবে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে কাতারে এসেছেন ৭ হাজার ১২৭ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৬ হাজার ৮৫৪ জন, মার্চ মাসে ৭ হাজার ৩৬৮ জন এবং এপ্রিল মাসে ৭ হাজার ৬০৬ জন বাংলাদেশি কর্মী। ফলে গড় হিসাবে প্রতি মাসে কাতারে এসেছেন ৭ হাজার ২৩৮ জন বাংলাদেশি।
২০১৭ সালে কাতারে মোট কর্মী এসেছেন ৮৯ হাজার ৭৪ জন বাংলাদেশি, যা গড়ে প্রতি মাসে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৪২২ জন। আর চলতি বছর প্রথম চার মাসে এসেছেন ২৬ হাজার ৪৪৮ জন, যা গড়ে প্রতি মাসে সাড়ে ৭ হাজার ৬৪২ জনে দাঁড়ায়। কয়েক মাস ধরে দূতাবাসে ভিসা সত্যায়ন বাধ্যতামূলক করায় কথিত ফ্রি ভিসায় কর্মী আসার হার হ্রাস পাওয়ায় এই সামান্য তারতম্য দেখা যাচ্ছে বলে দূতাবাস সূত্র জানায়।
কাতারের পাশাপাশি কুয়েতেও বাংলাদেশি কর্মীদের যাওয়ার হার স্বাভাবিক রয়েছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসের মধ্যে জানুয়ারিতে ৪ হাজার ২৭৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২ হাজার ৮১ জন, মার্চে ৪ হাজার ৩৭০ জন এবং এপ্রিলে ৪ হাজার ৭৩১ জন কর্মী কুয়েতে গেছেন। সব মিলিয়ে চার মাসে দেশটিতে গেছেন ১৫ হাজার ৪৫৬ জন কর্মী। অন্য চারটি দেশের মধ্যে সৌদি আরবে প্রথম চার মাসে ১ লাখ ৭ হাজার ৯৩৫ জন, আরব আমিরাতে মাত্র ৮৮১ জন, ওমানে ২৬ হাজার ৪৪৮ জন এবং বাহরাইনে ৫২৮ জন বাংলাদেশি কর্মী গেছেন। গত এক বছরে তুলনামূলকভাবে সৌদি আরবে বাংলাদেশি কর্মী যাওয়ার হার কমছে। জানুয়ারি মাসে দেশটিতে ৩৮ হাজার ৯৫৪ জন গেলেও ফেব্রুয়ারি মাসে সে দেশে গেছেন ২৭ হাজার ৭২৬ জন। এর পরের মাস মার্চে ১৮ হাজার ৪৭৮ জন এবং এপ্রিলে ২২ হাজার ৭৭৭ জন কর্মী গেছেন সৌদি আরবে।
সৌদি আরবে ২০১৭ সালে মোট কর্মী গেছেন ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩০৮ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতি মাসে ৪৫ হাজার ৯৪২ জন বাংলাদেশি কর্মী কাজের আশায় এই দেশে গেছেন। সেই তুলনায় চলতি বছরের প্রথম চার মাসে প্রতি মাসে গড়ে ২৬ হাজার ৯৮৩ জন কমী গেছেন। ফলে গত বছরের মাসিক গড়ের তুলনায় চলতি বছরের মাসিক গড় হিসাবে কর্মীর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমে গেছে।
একইভাবে বড় দেশ ওমানেও গত এক বছরে বাংলাদেশি কর্মী যাওয়ার হার কমেছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসের মধ্যে জানুয়ারিতে ৭ হাজার ৮৭১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৫ হাজার ৯৯৫ জন, মার্চে ৬ হাজার ৪১৮ জন এবং এপ্রিলে ৬ হাজার ১৭৪ জন কর্মী বাংলাদেশি কর্মী এই দেশটিতে গেছেন।
ওমানে বর্তমানে বাস করছেন প্রায় সাত লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি। ওই দেশে বসবাসরত অভিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মী বাংলাদেশের। ওমানে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর জাহেদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ওমানে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি কর্মী আসার হার কমার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে উপসাগরীয় অঞ্চলে চলমান অর্থনৈতিক মন্দা, অবৈধ ভিসা বাণিজ্য বন্ধ, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে শ্রমবাজার খোলা এবং অন্যান্য দেশকেও কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে ওমান কর্তৃপক্ষের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত এসব দেশে বাংলাদেশি কর্মী যাওয়ার হার কমার কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ওমানে বাংলাদেশি শ্রম কাউন্সেলর দাবি করেন, ওমানে আগের চেয়ে কমসংখ্যক কর্মী এলেও বর্তমানে যাঁরা আসছেন, তাঁরা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সুশৃঙ্খল ও নিশ্চিত উপায়ে আসছেন। বর্তমানে ওমানে আগত প্রত্যেক কর্মীর চুক্তিপত্র ও ইনস্যুরেন্স নিশ্চিত করা হচ্ছে। ফলে সংখ্যায় কমলেও সুযোগ-সুবিধায় কর্মীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ।
উপসাগরীয় অঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য এখনো শ্রমবাজার পুরোপুরি চালু না হওয়ায়
গত চার মাসের মধ্যে জানুয়ারিতে ২৭১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৭৪ জন, মার্চে ১৬০ জন এবং এপ্রিলে ২৭৬ জন বাংলাদেশি গেছেন। ব্যাপকভাবে কমে গেছে বাহরাইনগামী বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যাও। এই দেশে জানুয়ারিতে ১৭২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১০৬ জন, মার্চে ১১৩ জন ও এপ্রিলে ১৩৭ জন কর্মী গেছেন। 

কাতারে বাংলাদেশের শ্রম কাউন্সেলর ড. সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাতারে বাংলাদেশের শ্রমবাজার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ ভালো এবং স্থিতিশীল। কাতার এখনো বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার। আমরা শ্রমিকদের সংখ্যার চেয়ে গুণগত মানের দিকে নজর রাখছি। কোনো কর্মী যেন কাতারে এসে প্রতারিত না হন, প্রত্যেক কর্মীর আইনি অধিকার যেন সুরক্ষিত থাকে, এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ দূতাবাস আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সক্রিয় নজরদারি করছে।’
শ্রম কাউন্সেলর আরও বলেন, এক বছর পূর্ণ হতে চলা অবরোধের ধাক্কা কাটিয়ে কাতার নির্মাণকাজ অব্যাহত রেখেছে। এটি একদিকে যেমন কাতারের সাফল্য, অন্যদিকে বাংলাদেশের শ্রমবাজার স্থিতিশীল থাকার বড় একটি কারণও। আশা করছি, এখানে আমাদের শ্রমবাজার আরও বিস্তৃত ও বহুমুখী হবে।’