টি-শার্টের বার্তাবাহক হয়ে ওঠার গল্প

সম্প্রতি লন্ডনে ‘ফ্যাশন অ্যান্ড টেক্সটাইল মিউজিয়াম’-এ ‘টি-শার্ট: কাল্ট, কালচার অ্যান্ড সাভভারশন’ শীর্ষক আয়োজনে নানান ধরনের টি-শার্টের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ছবি: প্রথম আলো
সম্প্রতি লন্ডনে ‘ফ্যাশন অ্যান্ড টেক্সটাইল মিউজিয়াম’-এ ‘টি-শার্ট: কাল্ট, কালচার অ্যান্ড সাভভারশন’ শীর্ষক আয়োজনে নানান ধরনের টি-শার্টের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ছবি: প্রথম আলো

হালকা কাপড়ের আরামদায়ক বস্ত্র টি-শার্ট বা গোল গলার গেঞ্জি। সম্ভবত বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিধেয় পোশাকও এটি। লিঙ্গ বৈষম্যহীন এ বস্ত্র তরুণ-তরুণী সবার প্রিয়। টি-শার্টে আঁকা নকশা ও বার্তায় ফুটে ওঠে পরিধানকারীর রুচি, ফ্যাশনবোধ কিংবা সাংস্কৃতিক পরিচয়।

টি-শার্ট আবার প্রচারণা ও প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবেও বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন টি-শার্টে বার্তা ছেপে হরহামেশা নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। রাস্তায় বের হলে দেখা যায়, মানুষের গায়ের টি-শার্টগুলো নানান কথা বলছে। পরিবেশ, প্রেম, মানবিকতা, রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা থাকে এতে।

টি-শার্টে আঁকা নকশা ও বার্তায় ফুটে ওঠে পরিধানকারীর রুচি, ফ্যাশনবোধ কিংবা সাংস্কৃতিক পরিচয়। ছবি: প্রথম আলো
টি-শার্টে আঁকা নকশা ও বার্তায় ফুটে ওঠে পরিধানকারীর রুচি, ফ্যাশনবোধ কিংবা সাংস্কৃতিক পরিচয়। ছবি: প্রথম আলো

টি শার্টের বার্তাবাহক হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে সম্প্রতি ব্যতিক্রমী এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে লন্ডনের ‘ফ্যাশন অ্যান্ড টেক্সটাইল মিউজিয়াম’। ‘টি-শার্ট: কাল্ট, কালচার অ্যান্ড সাভভারশন’ শীর্ষক ওই প্রদর্শনীতে উঠে এল এ পোশাকের প্রচারণায় অসাধারণ হাতিয়ার হয়ে ওঠার রোমাঞ্চকর ইতিহাস। প্রদর্শিত বিভিন্ন সময়ের সংরক্ষিত টি-শার্টগুলো নিয়ে যায় আগেকার দিনগুলোতে।

জন্মকথা
প্রদর্শনী থেকে জানা গেল টি-শার্টের জন্ম ইতিহাস বহু পুরোনো। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চ শতকেও নাকি টি-আকৃতির পোশাকের অস্তিত্ব ছিল। তবে পোশাকে টি-আকৃতির যথাযথ দৃশ্যমান ঘটে ৯৬০ থেকে ১২৭৯ সাল সময়ে। এরপর কেটে যায় আরও কত শত বছর। ১৯০৭ সালে ইংল্যান্ডের স্যামুয়েল সায়মন ‘স্ক্রিন প্রিন্টিংয়ের’ কৌশল আবিষ্কার করলে বদলে যেতে শুরু করে গোল গলার, হাতা কাটা এ পোশাকের ইতিহাস।

‘টি-শার্ট: কাল্ট, কালচার অ্যান্ড সাভভারশন’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয় পোশাক প্রচারের অসাধারণ হাতিয়ার হয়ে ওঠার রোমাঞ্চকর ইতিহাসের গল্প। ছবি: প্রথম আলো
‘টি-শার্ট: কাল্ট, কালচার অ্যান্ড সাভভারশন’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয় পোশাক প্রচারের অসাধারণ হাতিয়ার হয়ে ওঠার রোমাঞ্চকর ইতিহাসের গল্প। ছবি: প্রথম আলো

১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী তাদের আনুষ্ঠানিক পোশাকের (ইউনিফর্ম) ভেতরে পরিধানের জন্য হালকা সাদা কটনের গেঞ্জি যুক্ত করে। অবশ্য ১৮৮০-এর দশকে ইংল্যান্ডের শৌখিন বক্সার ও দাঁড় টানিয়েরা (রোয়ার) একই রকম গেঞ্জি পরিধান করতেন।

তবে ‘টি-শার্ট’ শব্দটির সঙ্গে বিশ্বের প্রথম পরিচিতি ঘটে ১৯২০ সালে। এফ স্কট ফিটজগেরল্ডের লেখা ‘দিজ সাইড অব দ্য পেরাডাইজ’ উপন্যাসে প্রথম এই শব্দজোট ব্যবহার হয়। একই বছর শব্দটি ‘মেরিয়াম-ওয়েবস্টার ডিকশনারি’ তে যুক্ত হয়। অল্প কথায় এটুকু টি-শার্ট হয়ে ওঠার গল্প।

টি-শার্ট প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবেও বেশ জনপ্রিয়। ছবি: প্রথম আলো
টি-শার্ট প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবেও বেশ জনপ্রিয়। ছবি: প্রথম আলো



চুরি ঠেকাতে বার্তা যোগ
১৯৩৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার (ইউএসসি) একটি ঘটনা টি-শার্টের ব্যবহার ভাবনাকে আমূল বদলে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের ক্রীড়াবিদদের জন্য টি-শার্ট তৈরি করেছিল। কিন্তু মুশকিল হলো এগুলো চুরি হয়ে যায়। চুরি ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত ওই টি-শার্টগুলোতেই মোটা অক্ষরে লিখে দেওয়া হলো, ‘প্রোপার্টি অব ইউএসসি’। অর্থাৎ এটি ইউএসসির সম্পদ। বেশ কার্যকর হলো এ উপায়। বন্ধ হলো চুরি।

প্রচারকাজে টি-শার্ট
১৯৩৯ সালের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের মার্ভিন লি রয় ‘দ্য উইজার্ড অব ওজ’ নামে একটি ছবি বানালেন। সংগীতনির্ভর কাল্পনিক এই ছবির প্রচারে ছাপানো হলো টি-শার্ট। ছবিতে চিত্রায়িত এমারল্ড শহরের বাসিন্দাদের ‘ওজ’ লেখা টি-শার্ট গায়ে দেখা যায়। এটিকে বাণিজ্যিক প্রচারণার কাজে টি-শার্টের প্রথম ব্যবহার হিসেবে মনে করা হয়।

প্রথম রাজনৈতিক প্রচার
নিউইয়র্কের গভর্নর থোমাস ই. ডেওই ১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হলেন। তাঁর সমর্থকেরা ‘ডেও-ইট-ইউথ ডেওই’ (Dew-it-with DEWEY) লেখা টি-শার্ট পরে প্রচারে নামলেন। ডেওই নির্বাচনে হেরেছিলেন। কিন্তু প্রচারে তিনি যে অভিনবত্ব যোগ করলেন, তা বেশ গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের রাজনীতি ও নির্বাচনী প্রচারে।

বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য, প্রতিবাদ ও আহ্বান জানাতে টি-শার্টে নানান লেখা এখন চোখে পড়ে হরহামেশাই। ছবি: প্রথম আলো
বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য, প্রতিবাদ ও আহ্বান জানাতে টি-শার্টে নানান লেখা এখন চোখে পড়ে হরহামেশাই। ছবি: প্রথম আলো



স্মারক হিসেবে টি-শার্ট
১৯৫৫ সালে বিনোদন প্রতিষ্ঠান ‘ডিজনিল্যান্ড’ স্মারক হিসেবে প্রথম টি-শার্ট বিক্রি শুরু করে। ভ্রমণের স্মৃতি সংরক্ষণে বিভিন্ন বার্তা সংবলিত এসব টি-শার্ট বেশ জনপ্রিয় ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে।

প্রযুক্তি এনে দেয় আরও জনপ্রিয়তা
১৯৫৯ সালে টেকসই কালি ‘প্লাস্টিসোল’-এর আবিষ্কার এবং তার পরের বছর ‘মাল্টি কালার রোটারি স্ক্রিন প্রিন্টিং মেশিন’ আবিষ্কার টি-শার্টের রূপ-নকশা আরও বদলে দেয়। সিনেমা-নাটকের চরিত্রগুলো টি-শার্ট গায়ে দেখা যেতে লাগল। এভাবে আধুনিক ও ফ্যাশনপণ্য হিসেবে বেশ কদর পেতে শুরু করে টি-শার্ট।

বিভিন্ন সময়ের সংরক্ষিত টি-শার্টগুলো আগেকার দিনের নানান কাহিনি ও অবস্থান তুলে ধরে। ছবি: প্রথম আলো
বিভিন্ন সময়ের সংরক্ষিত টি-শার্টগুলো আগেকার দিনের নানান কাহিনি ও অবস্থান তুলে ধরে। ছবি: প্রথম আলো

১৯৬৯ সালে যুক্তরাজ্য সরকার ধূমপানবিরোধী প্রচারের জন্য নির্মিত বিজ্ঞানে ‘উই ডোন্ট স্মোক’ লেখা টি-শার্ট ব্যবহার করে। এরপর যুক্তরাজ্যে ১৯৭০-এর দশকে জনসচেতনতা তৈরি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবি আদায়ের আন্দোলনে টি-শার্ট হয়ে ওঠে সিগনেচার পোশাক। একই সময়ে রক সংগীতের গায়কদের গায়েও ফ্যাশনপণ্য হিসেবে টি-শার্ট শোভা পায়। এসবে থাকত তাঁদের নিজেদের পছন্দের বিভিন্ন ছবি ও বার্তা। বহুমুখী ব্যবহার আর জনপ্রিয়তা দেখে ১৯৭৩ সালে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ টি-শার্টকে ‘বার্তা বহনের মাধ্যম’ (মিডিয়াম ফর দ্য মেসেজ) হিসেবে আখ্যায়িত করে। ১৯৭৭ সালে নিউইয়র্ক শহরের প্রচারে বাজারে আসে ‘আই লাভ নিউইয়র্ক’ টি-শার্ট।

প্রচারণা বা প্রতিবাদী স্লোগানের পাশাপাশি ব্যক্তির অনুভূতিও ফুটে ওঠে টি-শার্টে। কেবল অক্ষর নয়, টি-শার্টে আঁকা নকশা বলে দেয় ব্যক্তির মনের কথা। ফ্যাশন অ্যান্ড টেক্সটাইল মিউজিয়ামের প্রদর্শনীতে সেটিও তুলে ধরা হয়েছে। মার্কিন চিত্রশিল্পী সুজান বার্নেট বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দুই হাজারের বেশি ব্যক্তির টি-শার্টের পেছনের বার্তা ক্যামেরাবন্দী করেছেন। সেসবের কিছু নির্বাচিত ছবি স্থান পায় প্রদর্শনীতে।

সুজান বার্নেট প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সাল থেকে তিনি ‘নট ইন ইউর ফেস’ নামে একটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভিড়ের মধ্যে টি-শার্ট পরিহিত লোকদের খুঁজে বেড়াই, যার পিঠে ব্যতিক্রমী কোনো বার্তা রয়েছে। এটি লেখা ও চিত্র বা ছবির সমন্বয় হতে পারে, যা পরিধানকারীর পরিচয় বহন করে। আমি ছোট্ট এই সাধারণ পোশাকের কথা বলার ক্ষমতাকে তুলে ধরতে চেয়েছি।’