বিলাওয়াল পারবেন পিপিপির পুনরুত্থান ঘটাতে?

আগামী নির্বাচনে দল কেমন ফল করবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে পিপিপির চেয়ারম্যান ভুট্টো পরিবারের তরুণ নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির ওপরই। ছবি: রয়টার্স
আগামী নির্বাচনে দল কেমন ফল করবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে পিপিপির চেয়ারম্যান ভুট্টো পরিবারের তরুণ নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির ওপরই। ছবি: রয়টার্স

উপমহাদেশে জলপাই শাসনে জেরবার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পাকিস্তান। মাত্র দুটি নির্বাচিত সরকার মেয়াদ শেষ করতে পেরেছে। আগামী মাসের দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীকে সব সময় দেশটিতে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে দেখা যায়। এখন শুরু হয়েছে মাঠে ভোটের রাজনীতির হিসাব। কোনো দল কেমন করবে, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি নির্বাচনে কেমন করবে, ভুট্টো পরিবারের তরুণ নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি কি পারবেন পিপিপির পুনরুত্থান ঘটাতে। নাকি সেই পুরোনো খেলোয়াড় মিস্টার টেন পার্সেন্ট জারদারিই মূল খেলোয়াড় রয়ে যাবেন। এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে অপেক্ষা করতে হবে। তবে আঁচ করা যেতে পারে, কী হতে যাচ্ছে ভবিষ্যতে পিপিপির ভাগ্য।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির বর্তমানে নেতৃত্বে আছেন ভুট্টো পরিবারের তরুণ নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। আসন্ন নির্বাচনে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও সমর্থকদের মধ্যে আকর্ষণ বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে পাকিস্তানের একমাত্র প্রধান বামপন্থী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। নতুন করে পুনরুত্থানের চেষ্টা চালাচ্ছে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল। বর্তমানে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভুট্টো পরিবারের তরুণ নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। দলটির পুনরুত্থান নিয়ে একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্সসহ কয়েকটি গণমাধ্যম।

কয়েক সপ্তাহ পর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে নিজেদের জায়গা দখলের চেষ্টায় নেমেছে বেনজির ভুট্টোর দল। পিপিপির নেতা হিসেবে বিলাওয়ালের প্রথম নির্বাচনী প্রচার এটি। তার মা ও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর সময়ে পিপিপি যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, তা পুনরায় অর্জনের চেষ্টা করছেন বিলাওয়াল। পারবেন কি না, তা সময়ই বলবে।

২০০৭ সালে বেনজির নির্বাসন থেকে ফিরে আসার পর আততায়ীর হাতে খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত পিপিপির জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়।

মায়ের মতো বিলাওয়ালও অক্সফোর্ডের সাবেক শিক্ষার্থী। দলের কর্মীদের বিশ্বাস, ২৯ বছর বয়সী এ তরুণ নেতা দলের ভেতর প্রাণসঞ্চার করেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই এগিয়ে যাবে পিপিপি। ২৫ জুলাইয়ের নির্বাচনের আগে দলটি তাদের পুনর্জীবিত করতে পারবে বলে প্রত্যাশা করছেন নেতা-কর্মীরা।
পিপিপির সিনেটর শেরি রহমান রয়টার্সকে বলেন, ‘আমাদের প্রচারের নেতৃত্বে বিলাওয়াল থাকায় তরুণদের একটি বিশাল অংশ আমাদের যাত্রায় সঙ্গী হবে বলে প্রত্যাশা করছি। চরমপন্থা, অব্যবস্থাপনা ও গণতন্ত্রবিরোধী ধারা পাল্টে দিতে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে।’

বিলাওয়ালের বাবা, আসিফ আলী জারদারি পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট। তিনি পিপিপির জন্য সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য বয়ে আনবেন, সেটা নিয়ে অবশ্য অনেক বিতর্ক রয়েছে।
দেশটির কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং পিপিপির কর্মীদের ধারণা, জারদারির নেতিবাচক ভাবমূর্তির কারণে দলটির কিছু দুর্নীতির অভিযোগের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে করে ২৫ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পিপিপি বিপদে পড়তে পারে। আর এটা ঘটলে তা ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) পক্ষেই যাবে সবকিছু।

আবার অনেকের মধ্যে এ ধারণাও আছে, পুনরায় শীর্ষ দল হিসেবে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পিপলস পার্টির সামনে একটা পথই খোলা—আর তা হচ্ছে ইমরান খানের দলের সঙ্গে জোট করা। কেননা গত পাঁচ বছরে পিটিআইয়ের জনপ্রিয়তা পিপিপিকে ছাড়িয়ে গেছে। জোট গঠনের জন্য আসিফ আলী জারদারি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।

একসময় পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল ছিল পিপলস পার্টি। তবে বর্তমানে দলটির আকর্ষণ মানুষের কাছে অনেক কমে গেছে। জাতীয় পর্যায়ে দলটির প্রভাব আগের মতো নেই। রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা বলছেন, জোট গঠনের জন্য পিপিপির সবচেয়ে মোক্ষম ব্যক্তি হচ্ছেন বিলাওয়ালের বাবা জারদারি।

দেশটির রাজনৈতিক ভাষ্যকার আমির আহমেদ খান বলেন, জারদারি নিজেকে একজন নির্বাচন-পূর্ববর্তী মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখছেন; প্রকৃত নির্বাচনী শীর্ষ খেলোয়াড় হিসেবে নয়। পিপিপি ও পিটিআই, উভয় দলের কর্মকর্তারাই কোনো জোট গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে বেশ অনিচ্ছুক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তবে কোনো দলই সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি।

‘মি. টেন পার্সেন্ট’
হত্যা ও দুর্নীতির অভিযোগে ১১ বছর কারাগারে ছিলেন জারদারি। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল এবং ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জারদারি কারাগারে ছিলেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। তিনি নির্দোষ হিসেবে তাঁর অবস্থান ধরে রেখেছেন। ২০০৪ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান। তিন বছর নির্বাসনে থাকার পর ২০০৭ সালে বেনজির ভুট্টোর সঙ্গে দেশে ফেরেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জারদারি।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সমর্থকদের উল্লাস। ইসলামাবাদ, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭। ছবি: রয়টার্স
পাকিস্তান পিপলস পার্টির ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সমর্থকদের উল্লাস। ইসলামাবাদ, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭। ছবি: রয়টার্স

বেনজির আর জারদারির উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সামরিক শাসনের সমাপ্তি ঘটানো। কিন্তু পরবর্তী সময় নির্বাচনী প্রচারণার সময় আততায়ীর হাতে খুন হন বেনজির। এ ঘটনায় ভুট্টো পরিবারের অবস্থান ভারতের গান্ধী পরিবার ও যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি পরিবারের সমপর্যায়ে চলে আসে।

১৯৭৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের পর বেনজিরের বাবা পিপিপির প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ দেন জেনারেল জিয়াউল হক। বেনজিরের ভাই মুর্তজাকে ১৯৯৬ সালে করাচিতে নিজের অফিসে গুলি করে হত্যা করা হয়। মুর্তজা হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল জারদারির বিরুদ্ধে। কিন্তু আদালত তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করে।

বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানে ফেরার পর পিপিপির জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর পরও সেই জনপ্রিয়তার বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেন জারদারি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হন তিনি।

জারদারির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর একটিতেও তিনি দোষী প্রমাণিত হননি। তবে, ওই যে বিশ্বাস। মানুষ ভাবে সব দায় তাঁরই। তাঁর ভাবমূর্তিতে লেগে যায় কলঙ্কের দাগ। আর বিভিন্ন কাজে শতকরা হিসেবে ১০ শতাংশ করে ঘুষ বা উপরি নেওয়ায় জারদারিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অনেকে ‘মি. টেন পার্সেন্ট’ বলেও ডাকা শুরু করে দেন।

পিপিপি সিনেটর ফারাতুল্লাহ বাবার বলেন, ‘আমি মনে করি আসিফ আলী জারদারি ব্যাপক নেতিবাচক অপপ্রচারের শিকার। এসব অপপ্রচারের একটিও যদি সত্য হতো, তাহলে তিনি দোষী সাব্যস্ত না হয়েও ১১ বছর কারাগারে কাটাতেন না।

‘কিংমেকার’ বা মূল খেলোয়াড়
পাকিস্তানের আসন্ন নির্বাচন ঘিরে একটি আলোচনা দেশটির রাজনীতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল কিছুদিন আগে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজকে (পিএমএল-এন) অস্থিতিশীল করে ইমরান খানের জন্য ক্ষমতার মসনদে বসার পথ খুলে দিচ্ছে।

পিপিপি সিনেটর ফারাতুল্লাহ বাবার বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের আগে অনেক ধরনের কৌশলের ব্যবহার দেখতে পাচ্ছি। অনেক দলের কর্মীরা একটি নির্দিষ্ট দলে যোগ দিচ্ছেন।’

তবে সামরিক বাহিনী বরাবরই রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। ইমরান খানও সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের সঙ্গে কোনো ধরনের পরিকল্পনা করার কথা অস্বীকার করেছেন। পাকিস্তানের ইতিহাসের অর্ধেকের বেশি সময় সামরিক বাহিনী দেশটি শাসন করেছে।

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি। ছবি: রয়টার্স
পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি। ছবি: রয়টার্স

পিপিপি নেতারা বলছেন যে বিলাওয়াল ভুট্টোর নেতৃত্বে তাঁরা নির্বাচনের প্রচার শুরু করেছেন। ইসলামপন্থী জঙ্গিবাদ সহিংসতার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে চরমপন্থী ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে পিপিপি লড়াই করে যাবে।

সিনেটর আইজাজ আহসান বলেন, ‘পিপলস পার্টি দৃঢ়ভাবে নিজেকে এমন দল হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তারা বিশ্বাস করে যে পাকিস্তানকে রাষ্ট্রের জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। এখানে কোনো ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পার্থক্য বা বৈষম্য করা উচিত নয়। আমরা এ বিষয়গুলো তুলে ধরব।’

ভুট্টো-জারদারি পরিবারের নেতৃত্বাধীন দল হওয়ায় পিপিপি একধরনের জনপ্রিয়তা ও সমর্থন পাবে। তবে সম্প্রতি সে বিষয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটনা দেখা গেছে। পিপিপির শক্ত ঘাঁটি সিন্ধু প্রদেশে পিটিআইয়ের কাছে মার্চ মাসের নির্বাচনে হেরেছে দলটি। সেখানে পিপিপি পেয়েছে ১৭ শতাংশ ভোট, পিটিআই পেয়েছে ২৪ শতাংশ ভোট ও পিএমএল-এন পেয়েছে ৩৬ শতাংশ ভোট।

এই হিসাব থেকে এটা বোঝা যায় যে পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো যদি ক্ষমতায় আসতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাদেরকে জোট গঠন করতে হবে। ইসলামাবাদের কেউ কেউ মনে করেন, জারদারি গোপনে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছেন। মার্চ মাস থেকে এ সন্দেহ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা সে সময় পিপিপির কাছে সিনেটের নেতৃত্বের সুযোগ থাকলেও দলটি সে সুযোগ ব্যবহার করেনি। তার বদলে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন প্রার্থীকে সিনেট চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে সহায়তা করেছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আমির আহমেদ খান বলেন, জারদারির বিশ্বাস, যখন জোট সরকার গঠনের সময় আসবে, তখন দলগুলোর তাঁর মতো একজনকে দরকার হবে। আর তখন তিনি হবেন ‘কিংমেকার’।