হিন্দু বিরোধী হওয়ায় গৌরীকে প্রাণ দিতে হয়েছে

গৌরী লঙ্কেশ
গৌরী লঙ্কেশ

‘তাঁকে আমি চিনতাম না। ধর্ম রক্ষার জন্যই তাঁকে গুলি করেছিলাম।’ কথাগুলো বলেছেন ভারতীয় সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকারী পরশুরাম ওয়াঘমোরে। বিশেষ তদন্তকারী দল এসআইটি-এর কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে এ কথা বলেছেন তিনি, যা ভারতে ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় কট্টরবাদের ভয়াবহতাকেই শুধু তুলে ধরে।
এসআইটি-এর সূত্র উল্লেখ করে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, ২০১৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে হত্যার উদ্দেশ্যে শ্রীরাম সেনার সদস্য পরশুরামকে নিয়ে আসা হয় বেঙ্গালুরুতে। তারপর দুই দিনের প্রশিক্ষণ। ৫ সেপ্টেম্বর পরশুরামের বন্দুক থেকে চারটি গুলি ছুটে যায় গৌরী লঙ্কেশকে লক্ষ্য করে। অথচ তার কিছুক্ষণ আগেও পরশুরাম জানতেন না যে, গৌরী লঙ্কেশ কে? এমনকি তিনি নারী না পুরুষ তাও জানতেন না তিনি। তিনি শুধু এসেছিলেন একজন সম্পূর্ণ অপরিচিতকে হত্যা করে ‘ধর্ম রক্ষা’র মহান দায়িত্ব নিয়ে!
এই হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হয়েছে নবীন কুমার নামে আরেক ব্যক্তি। তিনি জানিয়েছেন, ‘‘হিন্দু বিরোধী হওয়ায় গৌরীকে প্রাণ দিতে হয়েছে।’’
কর্ণাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরুর আরআর নগরের নিজ বাড়ির ফটকে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর রাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন গৌরী লঙ্কেশ। সাপ্তাহিক লঙ্কেশ পত্রিকার এই সম্পাদক কট্টর হিন্দুত্ববাদের কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আর এ কারণেই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে। অন্তত তাঁর আততায়ী পরশুরামের স্বীকারোক্তির পর এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকে না।
২৬ বছর বয়সী পরশুরামের বরাত দিয়ে এসআইটি জানায়, গৌরী লঙ্কেশকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরশুরামকে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে আসা হয়েছিল। ৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে বেঙ্গালুরুতে আনার আগেই অবশ্য এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ৫ সেপ্টেম্বর গৌরীকে গুলি করার সময়ও এমনকি তিনি জানতেন না কাকে গুলি করছেন।
পরশুরাম বলেন, ‘মে মাসে আমাকে জানানো হয়, ধর্ম রক্ষার জন্য কোনো একজনকে আমার হত্যা করতে হবে। আমি রাজি হই। কাকে হত্যা করতে হবে, জানতাম না আমি। যদি জানতাম, একজন নারীকে খুন করতে হবে, তাহলে হয়তো রাজি হতাম না। এখন মনে হচ্ছে ওই নারীকে হত্যা করা আমার উচিত হয়নি।’
জিজ্ঞাসাবাদে পরশুরাম জানিয়েছে, ৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে আসা হয়। তারপর বেলাগাভিতে এয়ারগান দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বেঙ্গালুরুতে পৌঁছানোর পর প্রথমে তাঁকে একটি বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। দুই ঘণ্টা পর একটি মোটরসাইকেল করে তাঁকে গৌরীর বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর বেঙ্গালুরুর আরেকটি বাসায় নেওয়া হয় তাঁকে। পরদিন আরেকটি লোক তাঁকে মোটরসাইকেলে করে গৌরীর বাড়িতে নিয়ে যায়। একইভাবে ওই রাতেই আবার ওই বাড়িতে নেওয়া হয়। কথা ছিল ওই দিনই হত্যা করা হবে। কিন্তু পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। পরদিন সময়ে আর ভুল হয়নি। পরশুরামে ছোড়া গুলিতে নিহত হন গৌরী লঙ্কেশ। তারপর দ্রুততার সঙ্গে বেঙ্গালুরু ত্যাগ করেন তিনি।
এসআইটি বলছে, হত্যার সময় পরশুরামের সঙ্গে অন্তত তিনজন ছিল। এদের কারও বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে পারেনি পরশুরাম। তাঁর ভাষায়, ‘পরিচয় জানতে চাওয়াটা নিষিদ্ধ।’ তবে এটুকু বলেছে যে, ওই দিন তাঁর সঙ্গে যিনি ছিলেন তিনি লম্বা ও কালো। তবে সেই ব্যক্তি এই মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া ছয়জনের মধ্যে কেউ কিনা, তা সম্পর্কে কোনো তথ্য দেননি পরশুরাম।
গৌরী লঙ্কেশকে হত্যার সময় পরশুরামদের দেখে ফেলেছিল দুজন। এর একজন সাংবাদিকতার ছাত্র। আরেকজন শ্রমজীবী মানুষ, যিনি থাকতেন গৌরীর বাড়ির উল্টোদিকের এক নির্মাণাধীন ভবনের বারান্দায়। গৌরীর আসার জন্য অপেক্ষায় থাকার সময় পরশুরাম কয়েকবার তাঁর মাথার হেলমেটটি খোলেন। আর তাতেই তাঁরা পরশুরামের চেহারা দেখতে পান, যার বর্ণনা অনুযায়ী ছবি আঁকা হয় পরশুরামের। পরে উত্তর কর্ণাটকের বিজয়পুর থেকে পরশুরামকে গ্রেপ্তারের পর তাঁকে শনাক্তের জন্য ওই দুই প্রত্যক্ষদর্শীকে যাকে এসআইটি।