পশ্চিমবঙ্গের তিন আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলায় তদন্তে অখুশি সিবিআই কর্মকর্তা

ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইর বিশেষ কর্মকর্তা রাকেশ আস্থানা। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইর বিশেষ কর্মকর্তা রাকেশ আস্থানা। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তিনটি চাঞ্চল্যকর আর্থিক দুর্নীতি মামলার তদন্তে খুশি হতে পারেননি ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইর বিশেষ কর্মকর্তা রাকেশ আস্থানা। মামলা তিনটি হলো সারদা, নারদ এবং রোজভ্যালি আর্থিক কেলেঙ্কারি মামলা। দীর্ঘদিন আগে এসব মামলা হলেও সিবিআই এখনো এই মামলার তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দিতে পারেনি। এতেই অখুশি হন সিবিআইর কর্মকর্তা।

এই মামলার গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করার জন্য গত মঙ্গলবার বিকেলে দিল্লি থেকে কলকাতায় আসেন সিবিআইর বিশেষ কর্মকর্তা রাকেশ আস্থানা। গতকাল বুধবার তিনি কলকাতার নিজাম প্যালেসে এসব মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেখানেই তিনি মামলার অগ্রগতি দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দেওয়ার নির্দেশ দেন। বৈঠকে নারদ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রঞ্জিত কুমারের ভূমিকায়ও অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া তিনি সারদা কেলেঙ্কারি মামলায় দীর্ঘ সাড়ে চার বছরে চার্জশিট না দেওয়ায়ও সমালোচনা করেন। এরপরই তিনি নির্দেশ দেন দ্রুত এসব মামলার তদন্ত শেষ করার। যাতে এ বছরের মধ্যেই এসব মামলার চূড়ান্ত চার্জশিট দেওয়া যায়।

২০১৬ সালের মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়কদের অর্থ গ্রহণের এক চাঞ্চল্যকর ভিডিও তথ্য ফাঁস করে প্রচারের আলোতে উঠে এসেছিল দিল্লির নারদ নিউজ ডট কম নামের একটি ওয়েব পোর্টাল। সেদিন তারা তৃণমূল কংগ্রেসের ওই সব নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কদের গোপনে অর্থ গ্রহণের ফুটেজ ফাঁস করে দিয়েছিল। সেই ভিডিওটি আবার কলকাতার রাজ্য বিজেপির কার্যালয়েও সেদিন ফাঁস করে দিয়েছিল বিজেপি। ওই স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা ও মন্ত্রীদের ঘরে ঘরে, হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে টাকা। তাঁরা তা গ্রহণও করছেন।

এই স্টিং অপারেশনে যাঁদের বিরুদ্ধে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল, তাঁরা হলেন মুকুল রায় (সাবেক রেলমন্ত্রী ২০ লাখ টাকা), সুব্রত মুখোপাধ্যায় (পঞ্চায়েত মন্ত্রী ৫ লাখ), প্রয়াত সুলতান আহমেদ (তৃণমূল সাংসদ ৫ লাখ), সৌগত রায় (তৃণমূল সাংসদ ৫ লাখ), শুভেন্দু অধিকারী (তৃণমূল সাংসদ ৫ লাখ), কাকলি ঘোষ দস্তিদার (তৃণমূল সাংসদ ৫ লাখ), প্রসূন ব্যানার্জি (তৃণমূল সাংসদ ৫ লাখ), শোভন চ্যাটার্জি (কলকাতার মেয়র ৪ লাখ), মদন মিত্র (সাবেক পরিহনমন্ত্রী ৫ লাখ), ইকবাল আহমেদ (তৃণমূল সাংসদ ৫ লাখ), ফিরহাদ হাকিম (পুর ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী ৫ লাখ) এবং মহম্মদ আহমেদ মির্জা (সিনিয়র পুলিশ অফিসার ৫ লাখ টাকা)। এ নিয়ে সিবিআই বা ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা মামলা করলেও সেই মামলা চলেছে শ্লথ গতিতে।

এ ঘটনার আগে ২০১৩ সালের এপ্রিলে ফাঁস হয় সারদা অর্থ কেলেঙ্কারি। অভিযোগ ওঠে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পের ১৪ হাজার কোটি রুপি তোলা হয় ১৭ লাখ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। সেই অর্থ কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হয় সারদা কেলেঙ্কারি মামলায়। এ মামলায় জড়িয়ে সেদিন গ্রেপ্তার হন সারদা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান সুদীপ্ত সেনসহ তৃণমূল সাংসদ কুনাল ঘোষ ও সাংসদ সৃঞ্জয় বসু, রাজ্য পুলিশের সাবেক ডিজি রজত মজুমদারসহ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রসহ অন্য নেতারা। সেই মামলার তদন্তর দায়িত্ব পায় সিবিআই। সেই মামলার তদন্ত শেষ দিকে শ্লথ হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে ২০১৫ সালে আরেকটি অর্থ কেলেঙ্কারির কথা ফাঁস হয় পশ্চিমবঙ্গে। সেটি রোজভ্যালি আর্থিক কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিত। সেই কেলেঙ্কারি মামলায় ৬০ হাজার কোটি রুপির আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। এই মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার হন তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংসদ ও অভিনেতা তাপস পাল। এই মামলারও তদন্ত ভার পায় সিবিআই।

পশ্চিমবঙ্গের সাড়া জাগানো এই তিনটি আর্থিক কেলেঙ্কারি মামলার তদন্ত ভার দেওয়া হয় ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইর হাতে। আগামী আগস্ট মাসে এই মামলাগুলোর অগ্রগতি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে রিপোর্ট দেওয়ার কথা রয়েছে সিবিআইর।

এদিকে এই মামলা তিনটি শ্লথ গতিতে চললেও এবার ফের তৎপর হয়েছে সিবিআই। আগামী বছর ভারতের লোকসভা নির্বাচন। তার আগে ফের এই তিনটি মামলা নিয়ে সিবিআইর তৎপর হওয়ায় অশ্বস্তি বেড়েছে তৃণমূলের। যদিও গ্রেপ্তার হওয়া তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ এবং বিধায়কেরা উচ্চাদালতের নির্দেশে এখন জামিনে মুক্ত রয়েছেন।

এদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এবারও বিজেপির নেতারা এই মামলা নিয়ে ফের রাজনীতি গরম করতে চাইছেন। কারণ, এই তিনটি মামলায় জড়িয়ে আছেন পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূলের নেতা থেকে মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়কেরা। যদিও সিবিআইর পাশাপাশি সমান্তরালভাবে এই মামলার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টটরিয়েট বা ইডি।