পশ্চিমবঙ্গে সারদা, রোজভ্যালি ও নারদ কেলেঙ্কারি মামলার তদন্তে ঢিলেমি, কর্মকর্তাকে বদলি

ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিবিআই) বিশেষ কর্মকর্তা রাকেশ আস্থানা। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিবিআই) বিশেষ কর্মকর্তা রাকেশ আস্থানা। ছবি: সংগৃহীত

চাঞ্চল্যকর অর্থ দুর্নীতির তিন মামলার তদন্তে ঢিলেমির কারণে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিবিআই) যুগ্ম অধিকর্তা অভয় সিংহকে কলকাতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অভয় সিং ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে দায়ের করা সারদা, রোজভ্যালি ও নারদ আর্থিক দুর্নীতি মামলার পরিদর্শক কর্মকর্তা।

মূলত, দিল্লি থেকে আসা সিবিআইয়ের বিশেষ পরিচালক রাকেশ আস্থানা গত বুধবার কলকাতার নিজাম প্যালেসে এই তিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও আধিকারিকদের সঙ্গে এক বৈঠকের পর বুঝতে পারেন, দীর্ঘদিনের এই মামলার তদন্তে ঢিলেমি রয়েছে। তিনি এই মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করে চার্জশিট দেওয়ার নির্দেশও দেন।

দুদিনের সফর শেষে সিবিআইয়ের এই কর্মকর্তা দিল্লিও ফিরে যান। এরপর খবর আসে, অভয় সিংকে কলকাতা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ওডিশায়। এখানে সিবিআইয়ের এক আইপিএস মর্যাদার কর্মকর্তা নিয়োগ করা হচ্ছে।

জানা গেছে, এই মামলার তদন্ত নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল তদন্তকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে। ফলে সম্মিলিতভাবে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি সিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তারা। একেক কর্মকর্তা একেক মত প্রকাশ করায় তদন্ত শ্লথ হয়ে পড়ে। এতেই অসন্তোষ প্রকাশ করেন রাকেশ আস্থানা। বিশেষ করে নিজাম প্যালেসে আয়োজিত বৈঠকে এই মামলার সঙ্গে যুক্ত তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আধিকারিকদের মতবিরোধের চিত্র ধরা পড়ে রাকেশ আস্থানার কাছে। দীর্ঘদিন আগে এসব মামলা করা হলেও সিবিআই এখনো এই মামলার তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দিতে পারেনি। এতেই অখুশি হন রাকেশ আস্থানা।

এই মামলাগুলোর গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করার জন্য গত মঙ্গলবার বিকেলে কলকাতায় আসেন রাকেশ আস্থানা। বুধবার তিনি কলকাতার নিজাম প্যালেসে এসব মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেখানেই তিনি মামলার ধীরগতি দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দেওয়ার নির্দেশ দেন। বৈঠকে নারদ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রঞ্জিত কুমারের ভূমিকায়ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। সারদা কেলেঙ্কারি মামলায় দীর্ঘ সাড়ে চার বছরেও চার্জশিট না দেওয়ায়ও সমালোচনা করেন। এরপরই তিনি নির্দেশ দেন দ্রুত এসব মামলার তদন্ত শেষ করার। যাতে করে এ বছরের মধ্যেই এসব মামলার চূড়ান্ত চার্জশিট দেওয়া যায়।

২০১৬ সালের মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়কদের অর্থ নেওয়ার এক চাঞ্চল্যকর ভিডিও তথ্য ফাঁস করে দিল্লির নারদ নিউজ ডটকম নামের একটি ওয়েব পোর্টাল। তৃণমূল কংগ্রেসের ওই সব নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কদের গোপনে অর্থ নেওয়ার ফুটেজ ফাঁস করে দিয়েছিল তারা। ওই ওয়েব পোর্টালের ভিডিওটি আবার কলকাতার রাজ্য বিজেপির কার্যালয়েও সেদিন ফাঁস করে দিয়েছিল বিজেপি। ওই স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা ও মন্ত্রীদের ঘরে-ঘরে, হাতে-হাতে পৌঁছে যাচ্ছে রুপি (ভারতীয় মুদ্রা)। তাঁরা তা গ্রহণও করছেন।

ওই স্টিং অপারেশনে যাঁদের বিরুদ্ধে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল, তাঁরা হলেন মুকুল রায় (সাবেক রেলমন্ত্রী, ২০ লাখ রুপি), সুব্রত মুখোপাধ্যায় (পঞ্চায়েত মন্ত্রী, পাঁচ লাখ রুপি), প্রয়াত সুলতান আহমেদ (তৃণমূল সাংসদ, পাঁচ লাখ রুপি), সৌগত রায় (তৃণমূল সাংসদ, পাঁচ লাখ রুপি), শুভেন্দু অধিকারী (তৃণমূল সাংসদ, পাঁচ লাখ রুপি), কাকলি ঘোষ দস্তিদার (তৃণমূল সাংসদ, পাঁচ লাখ রুপি), প্রসূন ব্যানার্জি (তৃণমূল সাংসদ, পাঁচ লাখ রুপি), শোভন চ্যাটার্জি (কলকাতার মেয়র, চার লাখ রুপি), মদন মিত্র (সাবেক পরিবহনমন্ত্রী, পাঁচ লাখ রুপি), ইকবাল আহমেদ (তৃণমূল সাংসদ, পাঁচ লাখ রুপি), ফিরহাদ হাকিম (পুর ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী, পাঁচ লাখ রুপি) এবং মহম্মদ আহমেদ মির্জা (জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা, পাঁচ লাখ রুপি)। এ নিয়ে সিবিআই মামলা করলেও সেই মামলা চলেছে শ্লথগতিতে।

এই ঘটনার আগে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে ফাঁস হয় সারদা অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা। অভিযোগ ওঠে, ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পের ১৪ হাজার কোটি রুপি তোলা হয় ১৭ লাখ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। একই সঙ্গে ২০১৫ সালে আরেকটি অর্থ কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হয় পশ্চিমবঙ্গে। সেটি রোজভ্যালি কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিত। সেই কেলেঙ্কারি মামলায় ৬০ হাজার কোটি রুপি দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এই মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার হন রোজভ্যালির কর্ণধার গৌতম কুণ্ড, তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংসদ ও অভিনেতা তাপস পাল প্রমুখ। এই মামলারও তদন্ত ভার পায় সিবিআই।

আগামী আগস্ট মাসে এই মামলাগুলোর অগ্রগতি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে সিবিআইয়ের। তবে সিবিআইয়ের পাশাপাশি এই মামলার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডাইরেকটরেট (ইডি)।