ঘুষ কেলেঙ্কারিতে টালমাটাল ঘানার ফুটবল

ঘানা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কেউইসি নিয়ানতাকি। এএফপি ফাইল ছবি
ঘানা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কেউইসি নিয়ানতাকি। এএফপি ফাইল ছবি

একজন লোক টেবিলে ৬৫ হাজার মার্কিন ডলার রেখে বললেন, ‘বাজার করার জন্য।’ জবাবে আরেক ব্যক্তি বললেন, ‘ধন্যবাদ।’ এ কথা বলেই ডলারগুলো একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ফেললেন তিনি। ব্যক্তিটি আর কেউ নন, কেউইসি নিয়ানতাকি, ঘানা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। ঘুষটা ছিল সাজানো, নিজস্ব প্রাইভেট কোম্পানির মাধ্যমে মধ্যস্থতা করে স্পনসরশিপ ডিলের কমিশন। গোপনে ভিডিও ক্যামেরায় পুরো ঘটনা ধারণ করেন বিবিসির আন্ডারকাভার রিপোর্টার আনাস আরেমেইয়াও আনাস। ওটা দিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন তিনি।

চলচ্চিত্র নির্মাতারা শতাধিক কর্মকর্তাকে অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। যাঁদের বেশির ভাগই পশ্চিম আফ্রিকার ফুটবল কর্মকর্তা। এর মধ্যে চলতি বিশ্বকাপে দায়িত্ব পালনকারী কেনিয়ার একজন রেফারিও ছিলেন। মাত্র তিনজন কর্মকর্তা ওই অর্থ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

এই তথ্য ফাঁস হওয়ার পর ঘানার ফুটবল অঙ্গন টালমাটাল হয়ে পড়ে। মি. নিয়ানতাকি ঘুষ নেওয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে ঘরোয়া সব খেলা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়। এরই জের ধরে সরকার ৭ জুন দেশটির ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ভেঙে দিয়েছে।

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে ফুটবল-পাগল বলে প্রচলিত ঘানার সমস্যার ছবি ফুটে উঠেছে। দেশটির মানুষ ফুটবল খেলতে ও দেখতে বেশ পছন্দ করে। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে দেশটির ফুটবল অঙ্গনে বিরাজ করছে অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা। এরই কালো ছায়া পড়েছে সর্বত্র। দেশটির ফুটবলপ্রেমীরা এই অবস্থা দেখতে চান না। অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে ও নিরুপায় হয়ে বিকল্প কিছু খুঁজছেন।

১৯৭০-এর দশকে খেলার মাঠে ভক্ত-দর্শকদের ঢল নামত। ওই সময়ে ঘানার অন্যতম বড় ক্লাব আক্রা হার্টস অব ওকের গোলরক্ষক স্যাম সুপেইয়ের সুখ্যাতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আজকের দিনে ঘানায় অনেক দল ফুটবল খেলছে। কিন্তু মাঠে দর্শক নেই বললেই চলে। গত জানুয়ারি মাসে কুমাছি মহানগরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ফুটবল খেলা থেকে নগরের স্টেডিয়ামটি যে পরিমাণ অর্থ আয় করে থাকে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মাধ্যমে তার চেয়ে বেশি আয় করতে পারে।’

খাপছাড়া সূচি একটি বড় সমস্যা। নিয়ম উপেক্ষা করে একটি দলকে নিম্ন পদে নামিয়ে দেওয়ায় (রেলিগেশন) সেটি আইনি লড়াইয়ের জন্য আদালতে যায়। এ কারণে চলতি মৌসুমের খেলা শুরু করতে দেরি হয়। তারকা খেলোয়াড়দের ক্লাব ছেড়ে চলে যাওয়াও আরেকটি বড় সমস্যা। বিশেষজ্ঞ নানা ডার্কওয়া গিয়াসি বলেন, ‘একজন তারকা খেলোয়াড়কে এক মৌসুমই দেখা যায়। এরপর আর তাঁকে পাওয়া যায় না। তিনি চলে যান অন্যত্র।’ তাঁর মতে সেরা খেলোয়াড়েরা ইউরোপেই পাড়ি জমান বেশি। তবে বেশির ভাগ তারকাই প্রতিদ্বন্দ্বী আফ্রিকার লিগগুলোয় খেলতে চলে যান। সেখানে কঙ্গোর টিপি মাজেম্বের মতো বড় ক্লাবগুলো তাদের বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে থাকে।

এখন ঘানার দর্শকেরা আর মাঠে যান না। তাঁরা বিভিন্ন হলে বসে টেলিভিশনের পর্দায় ইউরোপের ক্লাবগুলোর খেলা দেখেন। শিশু বয়সে সিলভেস্টার আলী তাঁর দেশের বিভিন্ন দলের খেলা দেখার জন্য স্কুল থেকে দৌড়ে আসতেন। এখন তিনি আর্সেনালের মতো বড় বড় দলের খেলা দেখেন। আক্রার এক বারে বসে তিনি বলেন, ‘আমি এখন এখানে বসতেই বেশি পছন্দ করি। এক বোতল কোক নিয়ে পরিষ্কার পর্দায় ভালো মানের ফুটবল খেলা দেখতে বেশ ভালোই লাগে।’ তিনি জানান, প্রায় ২০ বছর হলো তিনি তাঁর দেশের স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যান না।

তবু এখনো দেশের সর্বত্র ফুটবলপ্রেমী আছে। আক্রা হার্টস অব ওকের আমেরিকান প্রধান নির্বাহী মার্ক নুনান বলেন, ঘানায় ফুটবল হচ্ছে কোকো কিংবা স্বর্ণের মতো। ‘এটি তাদের একটি জাতীয় সম্পদ।’

এই আবেগকে কাজে লাগাতে বিশ্বাসী কিছু লোক এগিয়ে এলে দেশটি ফুটবলে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এখনো ফুটবলপ্রেমীরা ঘরোয়া খেলায় কোনো দলের বিজয়ে উল্লাস করেন। সম্প্রতি বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আসান্তে কোতোকোর বিরুদ্ধে হার্টসের জয়ের পর ভক্তরা বাসে চড়ে শহরে সংগীত গাইতে গাইতে ও নানা স্লোগান দিতে দিতে উল্লাস প্রকাশ করে।