কত ক্ষমতা এরদোয়ানের?

ক্ষমতাসীন একে পার্টির সদর দপ্তরের সামনে সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও তাঁর স্ত্রী এমিনি এরদোয়ান। আঙ্কারা, তুরস্ক, ২৫ জুন। ছবি: রয়টার্স
ক্ষমতাসীন একে পার্টির সদর দপ্তরের সামনে সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও তাঁর স্ত্রী এমিনি এরদোয়ান। আঙ্কারা, তুরস্ক, ২৫ জুন। ছবি: রয়টার্স

আবারও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। দ্বিতীয় মেয়াদে এই দায়িত্ব পেলেন তিনি। তবে প্রথমবারের চেয়ে এবার অনেক বেশি ক্ষমতাধর এরদোয়ান। গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রেখে এক অদ্ভুত একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দরজায় তিনি।

নির্বাচনে এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন দল ইসলামপন্থী একে পার্টি ও এর জোট মিত্ররা পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এরদোয়ান ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মুহাররেম ইনজি পেয়েছেন ৩১ শতাংশ।

২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ১১ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এরদোয়ান। ২০১৬ সালে তাঁর বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর থেকে তুরস্কে জরুরি অবস্থা চলছে। পরে গত বছর বিতর্কিত এক গণভোটে জয়লাভ করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়ান এরদোয়ান। ওই গণভোটে প্রেসিডেন্ট শাসিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বাতিল হয়ে যায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। এরদোয়ান আবার দায়িত্ব পাওয়ায় এখন থেকে বিলুপ্ত হবে প্রধানমন্ত্রী পদ।

সংবাদ সংস্থা আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জনগণের রায় মেনে নিলেও নির্বাচন জঘন্য হয়েছে, প্রেস ব্রিফিংয়ে এমন মন্তব্য করে বিরোধী দলের নেতা মুহাররেম ইনজি বলেন, ‘এই সংবিধানের মাধ্যমে বিপজ্জনক একদলীয় শাসন কায়েম হলো।’ তিনি বলেন, ‘আমি এই ফলাফল মেনে নিলাম। আট কোটি মানুষের প্রতিনিধি এখন এরদোয়ান। এখন তিনি আমাদের সবার প্রেসিডেন্ট।’
বিজয়ী হওয়ার পর আজ সোমবার দলের কার্যালয়ের বারান্দা থেকে জনগণের উদ্দেশে এক ভাষণে এরদোয়ান বলেন, ‘আমার ৮ কোটি ১০ লাখ জনগণের প্রত্যেকে এই বিজয়ের অংশীদার।’

ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিসহ ইসলামিক দেশের নেতারা ইতিমধ্যেই নতুন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন পাওয়ায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও অভিনন্দন জানিয়েছেন তাঁকে।

ক্ষমতাসীন একে পার্টির সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। তুরস্ক, ২৪ জুন। ছবি: এএফপি
ক্ষমতাসীন একে পার্টির সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। তুরস্ক, ২৪ জুন। ছবি: এএফপি

তবে এই ফলাফলের মাধ্যমে রাজনীতির পটে কী পরিবর্তন এল? বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তুরস্কের নতুন সংবিধানের অধীনে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান নতুন ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। যে সিদ্ধান্ত গত বছরের গণভোটেই এসেছিল। কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৫১.৩ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পেয়ে কার্যত সেই সময়ই আরও ১২ বছর প্রেসিডেন্টের কুর্সি পাকা করে নিয়েছিলেন এরদোয়ান। মন্ত্রী, উপমন্ত্রীসহ উচ্চপর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ সরাসরি দেওয়ার ক্ষমতা, দেশের আইনি ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ ও দেশে জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা এবার পুরোপুরি তাঁর হাতে।

অর্থাৎ একজন ব্যক্তির হাতেই বেশির ভাগ ক্ষমতা কুক্ষিগত হচ্ছে। নতুন সংবিধান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্সের মতো গণতন্ত্রের ধারা থাকছে না। ৬৪ বছর বয়সী এরদোয়ান আধুনিক তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। শহুরে তরুণদের মধ্যে তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। সমর্থকেরা মনে করছেন, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা ও কুর্দি বিদ্রোহীদের দমনে এরদোয়ান তাঁর সর্বময় ক্ষমতা ব্যবহার করবেন। বিজয়ী ভাষণে এরদোয়ান বলেন, তুরস্ক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরও দৃঢ়ভাবে কাজ করবে। তুরস্কে অবস্থানরত ৩৫ লাখ সিরিয়ার শরণার্থী যেন নিরাপদে দেশে ফিরতে পারে, সেই লক্ষ্যে তুরস্কের বাহিনী ‘সিরিয়ার ভূমি মুক্ত করা’ অব্যাহত রাখবে বলেও ঘোষণা করেন তিনি।

নির্বাচনে এই জয়ের মাধ্যমে আরও পাঁচ বছর তুরস্ক শাসন করার সুযোগ পেলেন তিনি। তুরস্কের নতুন সংবিধান অনুসারে তিনি ২০২৩ সালের পর ফের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পাবেন, তখন জয়ী হলে ২০২৮ পর্যন্ত তিনিই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট থাকবেন।

আসলে কতটা শক্তিশালী শাসক হলেন এরদোয়ান। নির্বাচনের আগে বিবিসির এক প্রতিবেদনে তুরস্কের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার বিষয়ে একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী পদটি বাদ হয়ে যাবে এবং নির্বাহী ক্ষমতা পুরোপুরি চলে যাবে প্রেসিডেন্টের হাতে। অর্থাৎ প্রেসিডেন্টই হবে ‘হেড অব দ্য স্টেট’ এবং ‘হেড অব দ্য গভর্নমেন্ট’। প্রেসিডেন্ট নিজের পছন্দমতো সরাসরিই মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, বিচারক ও আমলা নিয়োগ দিতে পারবেন। কোনো নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট আসবেন না। এর আগে জাতীয় বাজেট পার্লামেন্টের মাধ্যমে পাস হতো। তবে এখন এর খসড়া তৈরি করবেন প্রেসিডেন্ট স্বয়ং। যদি পার্লামেন্ট নতুনটা গ্রহণ না করে, তবে আগের বাজেটের বাস্তবায়ন হবে। দুই-তৃতীয়াংশের মতে পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্টের অভিশংসন করতে পারবে তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে সাংবিধানিক আদালত, যার বেশির ভাগ সদস্যই নির্বাচিত হবে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক। সংবিধানের এই সংস্কার নিয়ে ইতিমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কাউন্সিল অব ইউরোপ মানবাধিকার গোষ্ঠীর ভেনিস কমিশন।

গত বছর তুরস্কের সংবিধান পরিবর্তনের বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্টের হাতে সর্বাধিক নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, যা সংসদীয় নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে দেবে।

তবে এরদোয়ানের ক্ষমতাসীন একে পার্টি সে সময় পদক্ষেপগুলো প্রগতিশীল বলে জোর দেয়। বলা হয়, সামরিক আদালত বিলুপ্ত হচ্ছে এবং আইন প্রেসিডেন্টের ডিক্রির ওপরই পাস হবে। তারা এই বলে জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে যে নতুন পদক্ষেপের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে।

একে পার্টির বোর্ড সদস্য জেইনেপ জেন কান্দুর বলেন, প্রেসিডেন্ট জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন এবং তিনি ব্যালট বক্সের ব্যাপারে সরাসরি দায়বদ্ধ থাকবেন। এতে গণতন্ত্রকে দুর্বল করা হচ্ছে না বরং গণতন্ত্রের ভিত্তি জোরদার হচ্ছে কারণ প্রেসিডেন্ট সরাসরি জনগণের ভোটে আসছেন। তারা জানায়, পশ্চিমের অন্যান্য রাষ্ট্রপতি-ব্যবস্থার সঙ্গে এর তুলনা করা যায়।

তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্সের সঙ্গে যেই তুলনাটা আসছে, তা সঠিক নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্বাহী, আইনি এবং বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা পুরোপুরি আলাদা। কংগ্রেস যদি বাজেট প্রত্যাখ্যান করে, তবে নতুন করে আবার সংশোধন না করা পর্যন্ত ফেডারেল সরকার তা বাস্তবায়ন বন্ধ রাখে। প্রেসিডেন্ট বিচারপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের মনোনীত করেন, তবে কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন হয়।

ফ্রান্সের ক্ষেত্রে যা দেখা যায় তা হলো সরকারপ্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট একই দলের হতে হবে, এমন প্রয়োজনীয়তা নেই। প্রায়ই আলাদা দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নয়জন বিচারকের মধ্যে তিনজনের নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট। যেখানে তুরস্কে ১৫ জনের মধ্যে ১২ জন বিচারক নিয়োগ দেবেন প্রেসিডেন্ট।
এরদোয়ান হয়তো নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে জরুরি অবস্থার অবসান ঘটাবেন। কিন্তু এমন মনে করার কারণ খুব কম যে তিনি বিরোধীদের ধরপাকড় করবেন না বা ২০১৬ সালের পর আটক করা হাজার হাজার রাজবন্দীকে ছেড়ে দেবেন বা গণমাধ্যমের ওপর নজরদারি বন্ধ করবেন। এরদোয়ান জানেন, একমাত্র এভাবেই তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন। তাঁর প্রিয় স্লোগান: ‘এক জাতি, এক পতাকা, এক রাষ্ট্র’। রোববারের নির্বাচনের পর এর সঙ্গে আরও একটি শব্দ জুড়ে দেওয়া যায়: এক ব্যক্তি।