থাইল্যান্ডে অসাধ্যসাধনকারী তাঁরা

জন ভলানথেন (সামনের জন)। ছবি: রয়টার্স
জন ভলানথেন (সামনের জন)। ছবি: রয়টার্স

‘এটা কোনো অলৌকিক ঘটনা, নাকি বিজ্ঞানের সাফল্য, নাকি অন্য কিছু—আমরা বলতে পারব না। তবে গুহায় আটকা ১৩ জনের সবাই এখন মুক্ত। সবাই নিরাপদ। হুররে!’

অলৌকিক আর বিজ্ঞান, যা-ই হোক—অবিশ্বাস্য এক অভিযান শেষে গতকাল মঙ্গলবার এটাই ছিল থাই নেভি সিলের ঘোষণা। ফেসবুকে তাদের এই ঘোষণায় স্বস্তির শ্বাস ফেলেছে উদ্বেগে থমকে থাকা থাইল্যান্ড। উদ্বেগ ঝেড়ে মুহূর্তে উল্লাসে ভাসে পুরো দেশ। আর যাঁরা এই অসাধ্যসাধন করেছেন, দেশ-বিদেশের সেই ডুবুরিদের প্রশংসায় ভাসিয়েছে পুরো বিশ্ব।

গত ২৩ জুন চিয়াং রাই প্রদেশের থাম লুয়াং গুহায় প্রবেশের পর নিখোঁজ হয় মু পা (ওয়াইল্ড বোর) নামের ফুটবল দলের ওই ১২ খুদে ফুটবলার ও তাদের সহকারী কোচ। তারা গুহায় ঢোকার সময় আবহাওয়া ভালো ছিল। কিন্তু ঢোকার পরই প্রকৃতি হঠাৎ বিরূপ হয়ে ওঠে। শুরু হয় প্রবল বৃষ্টি। টানা বর্ষণে সৃষ্ট প্লাবন আর কাদার কারণে ভেতরে আটকে পড়ে সবাই। তাদের খোঁজে উদ্ধার অভিযানে থাইল্যান্ডের ডুবুরিদের পাশাপাশি যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, মিয়ানমার, লাওস, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ ডুবুরি ও উদ্ধারকর্মীরা।

টানা নয় দিন চেষ্টা চালানোর পর ২ জুলাই গুহার প্রবেশমুখ থেকে প্রায় চার কিলোমিটার ভেতরে খুদে ফুটবলারদের সন্ধান পান ব্রিটিশ ডুবুরি রিচার্ড স্ট্যানটন ও জন ভলানথেন। নতুন উদ্যমে শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। গুহার ভেতরে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের বোতল, খাবার ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠানো হয়। একই সঙ্গে সেচকাজও শুরু হয়। গত রোববার প্রথম দফায় চার কিশোরকে উদ্ধারের আগ পর্যন্ত প্রায় ২৪ কোটি ৩০ লাখ লিটার পানি সেচ করা হয় গুহা থেকে।

এই উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন মোট ৯০ জন ডুবুরি। এঁদের মধ্যে ৪০ জন থাইল্যান্ডের আর বাকিরা বিদেশি। তবে ঠিক কারা এবং কীভাবে এই উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন, সে সম্পর্কে খুব কমই জানা গেছে। কারণ, অনেকই এ নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন।

এরপরও উদ্ধার অভিযানে সরাসরি অংশ নেওয়া কয়েকজনের বিষয়ে জানিয়েছে বিবিসি।

রিচার্ড স্ট্যানটন (লাল গেঞ্জি পরিহিত)। ছবি: রয়টার্স
রিচার্ড স্ট্যানটন (লাল গেঞ্জি পরিহিত)। ছবি: রয়টার্স

জন ভলানথেন ও রিচার্ড স্ট্যানটন
গুহায় থাকা অবস্থায় নয় দিন পর এই কিশোর দল ও তাদের কোচ প্রথম বাইরে থেকে যার গলার আওয়াজ পান তিনি হলেন জন ভলানথেন। এই কিশোরদের খুঁজতে ব্রিটিশ ডুবুরি জন ভলানথেন, রিচার্ড স্ট্যানটন ও রবার্ট হারপারকে ডেকে আনে থাই কর্তৃপক্ষ। কিশোর দলটি নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর এই তিনজন থাইল্যান্ডে আসেন। ২ জুলাই গুহার প্রবেশমুখ থেকে প্রায় চার কিলোমিটার ভেতরে খুদে ফুটবলারদের সন্ধান পান ব্রিটিশ ডুবুরি রিচার্ড স্ট্যানটন ও জন ভলানথেন।
আইটি কনসালট্যান্ট ভলানথেন ও সাবেক ফায়ারফাইটার স্ট্যানটন সাউথ অ্যান্ড মিড ওয়েলস কেইভ রেসকিউ টিমের সদস্য। তাঁরা নরওয়ে, ফ্রান্স ও মেক্সিকোসহ বিভিন্ন দেশে গুহায় আটকে পড়াদের উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন।

রিচার্ড হ্যারিস
রিচার্ড হ্যারিস

রিচার্ড হ্যারিস
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডের এই ডুবুরি চিকিৎসকের রয়েছে কয়েক দশকের ডাইভিং অভিজ্ঞতা। তিনি ঝুঁকি নিয়ে ওই গুহার ভেতরে আটকে পড়া ব্যক্তিদের অভিযান শুরুর আগেই জরুরি চিকিৎসা দিতে যান এবং উদ্ধার অভিযানকে এগিয়ে নিতে সবুজসংকেত দিয়েছেন।

গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ডা. হ্যারিস অস্ট্রেলিয়া, চীন, ক্রিসমাস আইল্যান্ডস ও নিউজিল্যান্ডে ডাইভিং অনুসন্ধানে অংশ নিয়েছেন। তাঁর অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার প্রশিক্ষণ ছিল। তিনি একই সঙ্গে একজন এক্সিপিডিশন মেডিসিন এবং উদ্ধার অভিযানে অভিজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞ।

২০১১ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় খুবই ভয়ংকর এক অভিযানে গিয়ে অক্সিজেনের অভাবে মারা গিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু আগনেস মিলোওকা। হ্যারিস সেখান থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, ব্রিটিশ ডুবুরিরা তাঁকে এ কারণেই এ উদ্ধার অভিযানে অংশ নিতে বিশেষ অনুরোধ করেছিল।

দ্য নেভি সিলসের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
দ্য নেভি সিলসের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

থাই নেভি সিলস
থাইল্যান্ডের অনেকগুলো বিশেষ বাহিনী এই উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছে। গুহায় কিশোরদের সন্ধান পাওয়ার পর চিকিৎসক হাক লোহানথুন ও আরও তিনজন তাদের সঙ্গে গুহায় ছিল। গত সপ্তাহে নেভি সিলসের ফেসবুক পেজে প্রকাশ করা এক ভিডিওতে দেখা গেছে, হাক সামান্য আঘাত পাওয়া এক কিশোরকে ওষুধ দিচ্ছেন। গতকাল সব কিশোর ও কোচকে বের করে আনার পর বেরিয়ে আসেন নেভি সিলসের এই চার সদস্য।
নেভি সিলস ইউনিটের নেতৃত্বে ছিলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল নারংসাক ওসোত্তানাকর্ন। ডুবুরিরা যখন কিশোরদের সন্ধানে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি উদ্ধারকাজের সর্বশেষ সংবাদ দিয়ে সহায়তা করেছেন।

সামান গুনানের ছবি হাতে একজন। ছবি: এএফপি
সামান গুনানের ছবি হাতে একজন। ছবি: এএফপি

সামান গুনান
উদ্ধার অভিযানের একপর্যায়ে গত শুক্রবার কিশোরদের অক্সিজেনের বোতল দিয়ে ফেরার পথে নিজের অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে প্রাণ হারান থাই নৌবাহিনীর সাবেক ডুবুরি সামান গুনান। তাঁর পাশে থাকা অন্যরা তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তাঁর স্ত্রী বিবিসিকে বলেন, ‘নিজের কৃতকর্মের জন্যই সামান আজ নায়ক। তিনি সব সময়ই অপরকে সাহায্য করতে পছন্দ করতেন। দাতব্য সহায়তা করতেন।
রিয়ার অ্যাডমিরাল নারংসাক ওসোত্তানাকর্ন বলেন, পেটি অফিসার গুনানের জীবন নিরর্থক হতে দেব না। আমরা আমাদের বন্ধুর এই আত্মত্যাগকে বৃথা যেতে দেব না।’

বেন রেমেন্যান্টস (বায়ে)। তাঁর ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া ছবি
বেন রেমেন্যান্টস (বায়ে)। তাঁর ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া ছবি

বেন রেমেন্যান্টস
এই বেলজিয়ান নাগরিক মূলত থাইল্যান্ডের ফুকেটে একটি ডুবুরির সরঞ্জামের দোকান পরিচালনা করেন। বলা হয়, সোমবার যে দলটি প্রথম ওই কিশোরদের দেখা পায়, তাদের একজন ছিলেন তিনি।

ক্লস রাসমুসেন। ছবিটি মিকো পাসির ফেসবুক থেকে নেওয়া
ক্লস রাসমুসেন। ছবিটি মিকো পাসির ফেসবুক থেকে নেওয়া

ক্লস রাসমুসেন
ডেনমার্কের নাগরিক ক্লস রাসমুসেন অনেক বছর ধরেই থাইল্যান্ডের বাসিন্দা। বিভিন্ন ডাইভ স্কুলে কাজ করেন তিনি। বর্তমানে তিনি বেন রেমেন্যান্টের সঙ্গে ফুকেটের ব্লু লেভেল ডাইভিং স্কুলে কাজ করেন। তিনি এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ডাইভিংয়ের কাজ করেছেন।

মিকো পাসি। তাঁর ফেসবুক থেকে নেওয়া
মিকো পাসি। তাঁর ফেসবুক থেকে নেওয়া

মিকো পাসি
আরেকজন এসেছেন ফিনল্যান্ড থেকে। তার নাম মিকো পাসি। তিনি থাইল্যান্ডের ছোট্ট দ্বীপ কোহ তাও-য়ে একটি ডাইভিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছেন। টেকনিক্যাল ডাইভিংয়ে বিশেষজ্ঞ তিনি। এই উদ্ধার অভিযানে স্বেচ্ছাসেবক ডুবুরি হিসেবে কাজ করছেন।
২ জুলাই যেদিন ওই কিশোর দল ও তাদের কোচের দেখা মিলল, সেদিন মিকোর স্ত্রী ফেসবুকে লিখেছিলেন, সেদিন ছিল তাদের অষ্টম বিবাহবার্ষিকী। অথচ তিনি তাঁর স্বামীকে ওই কিশোরদের উদ্ধারে অংশ নিতে চিয়াং রাই শহরে পাঠিয়েছেন।

ইভান কারাজিচ। ছবি: রয়টার্স
ইভান কারাজিচ। ছবি: রয়টার্স

ইভান কারাজিচ
আরেক স্বেচ্ছাসেবক ডুবুরি ডেন ইভান কারাজিচ। তিনি ডেনমার্কের নাগরিক। মিকো পাসির সঙ্গে তিনি থাইল্যান্ডের ছোট আইল্যান্ড কোহ তাওতে একটি ডু্বুরি বা ডাইভিংয়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করেন। তাঁরা দুজনই মূলত ডুবুরির প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে একটি হলো কেইভ ডাইভিং বা গুহার ভেতরে ডুব দিয়ে চলা।

এরিক ব্রাউন (বায়ে), মিকো পাসি (মাঝে) ও ক্লস রাসমুসেন (ডানে)। ছবিটি মিকো পাসির ফেসবুক থেকে নেওয়া
এরিক ব্রাউন (বায়ে), মিকো পাসি (মাঝে) ও ক্লস রাসমুসেন (ডানে)। ছবিটি মিকো পাসির ফেসবুক থেকে নেওয়া

এরিক ব্রাউন
কানাডিয়ান নাগরিক এরিক ব্রাউন ভ্যানকোভারের একজন টেকনিক্যাল ডাইভিং ইনস্ট্রাক্টর। এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি ডাইভিং শুরু করেন। একই সঙ্গে তিনি মিসরে টেকনিক্যাল ডাইভিং স্কুল টিম ব্লু ইমারশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা। গতকাল মঙ্গলবার রাতে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন নয় দিনে থাম লুয়াং গুহায় তিনি সাতটি ডাইভিং মিশন চালিয়েছেন, সময়ের হিসেবে যা ৫৯ ঘণ্টা।