চেহারার অভিব্যক্তি দেখে মনের অবস্থা ধরতে পারার দাবি কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের

অ্যাফেক্টিভা দাবি করেছে, তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে চেহারায় কোন আবেগ লুকানো আছে, তা ধরা যাবে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
অ্যাফেক্টিভা দাবি করেছে, তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে চেহারায় কোন আবেগ লুকানো আছে, তা ধরা যাবে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

আনন্দ ও বেদনা—এই বিপরীতধর্মী দুই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাননি, এমন মানুষ খুব কমই আছেন। কখনো কখনো এ অবস্থা চেহারায় ছাপ ফেলে তাদের অবস্থান জানান দেয়। আনন্দের বিষয় হলে তা লুকানোর চেষ্টা করেন না কেউ। চেহারায় ধরা দেয় সুখের ঝলকানি। তবে বেদনায় থাকলে তা লুকানোর চেষ্টায় থাকেন বেশির ভাগ মানুষ। কারও বিষণ্ন মুখ বলে দেয় তিনি ভালো নেই। আবার এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা কষ্টকে মনের গভীরে ধামাচাপা দিয়ে রাখেন—তাঁদের দেখে কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পান না কী বেদনা নিয়ে তাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেকে আবার ‘ভালো মানুষের’ মতো চেহারার অন্তরালে ‘বিপজ্জনক ভাবনা’ নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। তবে প্রযুক্তি এখন মানুষের মনের গহিনে চলাফেরা করতে চাইছে, তুলে আনতে চাইছে একজন মানুষ কী ভাবছেন, কেমন আছেন।

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাফেক্টিভার দাবি, তাদের অ্যালগরিদম কারও চেহারার অভিব্যক্তি দেখে বলে দেবে তিনি কেমন আছেন। চেহারায় কোন আবেগ লুকানো আছে, তা জানিয়ে দেবে ক্যামেরা।
আজ মঙ্গলবার বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়েছে, চেহারা শনাক্ত করার প্রযুক্তি দিনে দিনে আরও আধুনিক হচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠান দাবি করছে, তারা আবেগ পড়তে পারে এবং সন্দেহজনক আচরণ শনাক্ত করতে পারে। তবে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়িত হলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কী হবে, তেমনটাও সমান্তরালভাবে ভাবা হচ্ছে।

আইফোন এক্স চেহারা শনাক্ত করার মাধ্যমে আনলক করা যায়। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
আইফোন এক্স চেহারা শনাক্ত করার মাধ্যমে আনলক করা যায়। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

প্রযুক্তিবিদদের মতে, চেহারা শনাক্ত করার প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটেছে গত এক দশকে। কল্পনাশক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) বিকাশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। এই প্রযুক্তি এখন সীমান্তে কাউকে শনাক্ত করা, স্মার্টফোন আনলক করা, অপরাধের স্থান শনাক্ত করা এবং প্রকৃত ব্যাংকিং লেনদেনে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান দাবি করছে, তারা মানুষের আবেগ পরিস্থিতিও জানাতে পারে।
সত্তর দশকের পর থেকে মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ছবিতে বা ভিডিওতে কারও চেহারা দেখে লুকানো আবেগ তাঁরা শনাক্ত করতে পারেন। অতি ক্ষুদ্র অভিব্যক্তি বা ‘মাইক্রো এক্সপ্রেশন’ পর্যালোচনার মাধ্যমে তাঁরা এটা করতে সক্ষম হন।

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, অ্যালগরিদম ও হাই ডেফিনিশন ক্যামেরা এ পদ্ধতিতে দ্রুত ও নিখুঁতভাবে কাজটি করতে পারে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক বৈশ্বিক তথ্য সরবরাহ প্রতিষ্ঠান আইএইচএস মার্কিটের ভিডিও সার্ভিল্যান্স বিশেষজ্ঞ অলিভার ফিলিপ্পোও বলেন, ইতিমধ্যে এটা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সুপারমার্কেটগুলো তা ব্যবহার করছে, তবে তা মানুষ শনাক্তকরণে ব্যবহৃত হচ্ছে না। মূলত তারা কী ধরনের পণ্য কাদের কাছে বিক্রি করবে, তা নির্ধারণের জন্য এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে মার্কেটে আসা ব্যক্তিদের বয়স ও লিঙ্গের পাশাপাশি তাঁদের মানসিক অবস্থার বিশ্লেষণ করা হয়।

সানগ্লাসে চেহারা শনাক্ত করার প্রযুক্তি যুক্ত করেছে চীনের পুলিশ। ছবি: এএফপি
সানগ্লাসে চেহারা শনাক্ত করার প্রযুক্তি যুক্ত করেছে চীনের পুলিশ। ছবি: এএফপি

বাজার গবেষণা সংস্থা কান্টার মিলওয়ার্ড ব্রাউন মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাফেক্টিভার সহায়তায় টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন দেখে ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়া যাচাই করে।
অনুমতি নিয়ে অ্যাফেক্টিভা কিছু মানুষের মুখ ভিডিও করে। এরপর কোডের মাধ্যমে মুখের বিভিন্ন ভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন ফ্রেমে সাজিয়ে মানসিক অবস্থা পর্যালোচনা করে।
কান্টার মিলওয়ার্ড ব্রাউনের ‘প্রস্তাব ও প্রবর্তন’ শাখার ব্যবস্থাপনা পরিচালক গ্রাহাম পেজ বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন লোকজনের সাক্ষাৎকার নিই। প্রতি মুহূর্তে তাদের মুখের পাল্টে যাওয়া প্রতিটি প্রতিক্রিয়া আমরা খেয়াল করি। বিজ্ঞাপনের ঠিক কোন অংশটি কাজে লাগছে এবং কীসে তারা সাড়া দিচ্ছে, তা বোঝা যায়।’

তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিতর্কের বিষয় হচ্ছে, নিরাপত্তা ইস্যুতে ‘আবেগ শনাক্ত’ করার বিষয়টি।
যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান উইসি দাবি করেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সাধারণভাবে ধরা পড়ে না, চোখের এমন অব্যক্ত ভাষা শনাক্ত করে সন্দেহজনক আচরণের ব্যাপারটি ধরতে পারে।
সন্দেহ ও রাগের মতো লুকানো আবেগও ধরতে পারে।
উইসি বলছে, সাক্ষাৎকার নেওয়া ব্যক্তিদের বিশ্লেষণের জন্য তারা ‘উচ্চপর্যায়ের’ এক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কাজ করছে।

উইসির প্রধান নির্বাহী ডেভিড ফুলটন বলেন, ‘নিম্নমানের ভিডিও চিত্র ব্যবহার করেও আমাদের প্রযুক্তি একজন ব্যক্তির মনের অবস্থা, তাদের অভিব্যক্তি, ভাবভঙ্গি ও নড়াচড়া থেকে ধরতে পারে। ভবিষ্যতে, টিউব স্টেশনে ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্দেহজনক আচরণ ধরা সম্ভব হবে এবং সম্ভাব্য সন্ত্রাসীর হুমকি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ সতর্ক হতে পারবে।’

তবে আইএইচএস মার্কিটের ভিডিও সার্ভিল্যান্স বিশেষজ্ঞ অলিভার ফিলিপ্পোও আবেগ শনাক্তকরণের এই প্রক্রিয়ার শতভাগ কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। তিনি বলেন, সাধারণভাবে চেহারা শনাক্ত করার সময় সামান্য কিছু ত্রুটি থেকে যায়। কাজটি ৯০-৯২ শতাংশ নিখুঁত হয়। কিন্তু যখন আবেগ যাচাই করার চেষ্টা করা হয়, তখন এই ত্রুটি আরও বড় আকারে ধরা দেয়।

এর ফলে চেহারা অভিব্যক্তি দেখে একটি মানুষকে সঠিকভাবে যাচাই করতে না পেরে একপেশে ভুল মতামত দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার দাবিতে আন্দোলনকারীরা।

সার্ভিল্যান্স ক্যামেরা ব্যবহার করে সাউথ ওয়েলস পুলিশ চেহারা স্ক্যান করতে পারে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
সার্ভিল্যান্স ক্যামেরা ব্যবহার করে সাউথ ওয়েলস পুলিশ চেহারা স্ক্যান করতে পারে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

গত মে মাসে বিবিসি রেডিও ১-এর এক অনুষ্ঠানে সাউথ ওয়েলস পুলিশ নিরাপত্তা প্রহরা অভিযানের অংশ হিসেবে আগত ব্যক্তিদের অজান্তে তাদের চেহারা স্ক্যান করেছে। পুলিশের ওই বাহিনী স্বয়ংক্রিয় চেহারা শনাক্তকরণ (এএফআর) পদ্ধতি মোতায়েন করে সেখানে। ওই প্রক্রিয়ায় ক্লোজড সার্কিট টিভি (সিসিটিভি) আকারের ক্যামেরা ও এনইসি প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়।
ওই অনুষ্ঠানে এভাবে এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করে ১০ মিনিটের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়। মানবাধিকার সংগঠন লিবার্টি অভিযোগ করেছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রযুক্তির ভুলের কারণে বিপুলসংখ্যক নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশেষ করে গত বছর কার্ডিফে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলায় প্রযুক্তির ভুলের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন কয়েকজন।

এ ব্যাপারে গত জুলাই মাসে কার্ডিফের বাসিন্দা এড ব্রিজেস লিবার্টির হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নেমেছেন। এএফআর পদ্ধতি লোকজনের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ করা হয় এতে।

চেহারা শনাক্তকরণের গবেষণায় যুক্ত মার্কিন ফেডারেল সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজির বায়োমেট্রিক টেস্টিংয়ের প্রধান প্যাট্রিক গ্রোথারের মতে, প্রযুক্তি আরও নির্ভরযোগ্য হচ্ছে। তিনি বলেন, এই অ্যালগরিদমগুলো কম্পিউটারে ভিন্ন স্কেল ও অ্যাঙ্গেল থেকে ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে। এতে আরও যথাযথভাবে চেহারা শনাক্ত করা যায়। কারও চেহারা সানগ্লাস ও স্কার্ফের কারণে কিছু অংশ ঢেকে থাকলেও তা শনাক্ত করা যায়। ত্রুটি কমে আসছে। তবে কোনো অ্যালগরিদমই নির্ভুল নয় বলে স্বীকার করেছেন তিনি।