ম্যান্ডেলা যা হারিয়েছেন

রবেন দ্বীপের এই কারাগারে ম্যান্ডেলাকে বন্দী করে রাখা হয়। কারাগারের উঠানে কারাবন্দীদের এভাবে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে পাথর ভাঙানো হতো। ডেইলি এক্সপ্রেসে ছবিটি প্রকাশ করা হয়
রবেন দ্বীপের এই কারাগারে ম্যান্ডেলাকে বন্দী করে রাখা হয়। কারাগারের উঠানে কারাবন্দীদের এভাবে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে পাথর ভাঙানো হতো। ডেইলি এক্সপ্রেসে ছবিটি প্রকাশ করা হয়

জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়, তরুণ বয়সটি, কারাগারের প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন তিনি। স্ত্রী, সন্তান, প্রিয়জনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হয়েছে। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতেন, সব মানুষের সমান অধিকার চাইতেন। কারাগার থেকে লেখা তাঁর চিঠিতে উঠে এসেছে অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ এবং পরিবারের প্রতি ভালোবাসার কথা। একেকটি শব্দ যেন পরিবারকে স্পর্শ করার অনুভূতিতে ভরা, পরিবারের মানুষের কথা ক্ষণে ক্ষণে মনে হওয়ার আকুতি মেশানো। মানুষটি হচ্ছেন বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা।

ম্যান্ডেলার আবেগময় সেসব চিঠির কিছু অংশ ও এর অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে ৮ জুলাই দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে ‘হোয়াট ম্যান্ডেলা লস্ট (ম্যান্ডেলা যা হারিয়েছেন) শিরোনামে নিবন্ধটি লেখা হয়।

নিবন্ধে বলা হয়, ১৯৬২ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ২৭ বছর নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকায় রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কারাগারে ছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কারণে আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেসের এই নেতাকে কারাবরণ করতে হয়। কারামুক্ত হওয়ার চার বছর পর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পাঁচ বছর আগে ৯৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে সম্মানিত ও প্রভাবশালী মুক্তিকামী নেতাদের একজন হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হয়। এরপরও মহান মানুষটির অনেক কিছু্‌ই লোকজনের অজানা রয়ে গেছে।

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের কারাবন্দীর মতো নেলসন ম্যান্ডেলাও চিঠি লিখেছেন। ওই সময়ে তাঁর লেখা শত শত চিঠি রয়েছে। একেকটি চিঠি যেন একেকটি আত্মজীবনী। এসব চিঠি নিয়ে ‘দ্য প্রিজন লেটারস অব নেলসন ম্যান্ডেলা’ নামের বইয়ের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। বইটির প্রকাশক লাইভরাইট। এতে ২৫০টি চিঠি রয়েছে। এর অর্ধেকই আগে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯০ সালে তিনি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এসব চিঠি তাঁর ভাবমূর্তিকে আরও শক্ত অবস্থানে নিয়ে যায়। এসব চিঠিতে উঠে আসে তাঁর জটিল মানবতাবোধ। বোঝা যায়, তাঁর বিশ্বাসের ভিত্তিতে এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অঙ্গীকারে কখনো চিড় ধরেনি।

কারাবন্দীদের কারাগারে আরামদায়ক বিছানা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা, চলাচলের স্বাধীনতা নেই। যাঁরা কখনো কারাবন্দী হননি, তাঁরা বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবেন না। সহিংসতার দায়ে তাঁরা সাজাপ্রাপ্ত হন, এই সাজা তাঁদের আইনি সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারকেও অকার্যকর করে দেয়। যখন এসব গুরুতর বৈষম্যের বিষয়গুলো হৃদয়গ্রাহী হয়ে পড়ে, তখন ম্যান্ডেলার কারাবন্দী থাকার সময়ের চিঠি অন্য রকম সহিংসতার এক চিত্র তুলে ধরে, আমরা উপলব্ধি করি, কারাবন্দী ব্যক্তিরাও পরিবারের একটি অংশ।

ম্যান্ডেলার লেখা চিঠি। ছবি: দ্য এস্টেট অব নেলসন রলিহলাহলা ম্যান্ডেলা ও দ্য নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে
ম্যান্ডেলার লেখা চিঠি। ছবি: দ্য এস্টেট অব নেলসন রলিহলাহলা ম্যান্ডেলা ও দ্য নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, মহাত্মা গান্ধীসহ যেসব নেতা বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, বন্দী হিসেবে ম্যান্ডেলা ছিলেন তাঁদের মতো। অথচ তিনি কারাগারে আন্তর্জাতিকভাবে উল্লেখযোগ্য নন এমনকি তাঁর পথের অনুসারী নন এমন ব্যক্তিদের সঙ্গেও মেলামেশা করতেন।

ঘনিষ্ঠ সম্পর্কগুলো থেকেই মানবতা আহৃত হয়। ম্যান্ডেলার বন্দী সময়ের চিঠি, বিশেষ করে যেগুলো তাঁর পরিবারকে লেখা, সেসব চিঠি থেকে বোঝা যায়, কাউকে বন্দী করার সবচেয়ে সঠিক ও যথাযথ কারণও যদি থাকে, তাও স্বজন থেকে দূরে থাকার মর্মবেদনায় তা কোনো যুক্তি দিয়ে প্রলেপ দিতে পারে না। ম্যান্ডেলার কাছে দর্শনার্থী আসার সুযোগ পেতেন কম। খুব সীমিতভাবে স্ত্রী উইনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। ১৬ বছর বয়স হওয়ার পর তাঁর মেয়েরা তাঁকে দেখতে যেতে পারতেন। অল্প সময়ের জন্য হলেও প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ ছিল অনেক মূল্যবান একটি বিষয়। তবে তিনি যে চিঠিগুলো পেতেন, তা জমিয়ে রাখতেন। প্রত্যেকবার সেসব চিঠি পড়ার সময় প্রিয়জনকে স্পর্শ করার এক অনুভূতি তাঁর মধ্যে কাজ করত। ভাঁজ করে রাখা এই কাগজগুলোতে তিনি সান্ত্বনা খুঁজে পেতেন, শক্তি পেতেন। এটা বিস্ময়কর ছিল যে কর্তৃপক্ষ যেকোনো চিঠির ব্যাপারে তাঁকে অনুমতি দিতেন।

তবে চিঠি লেখার জন্য কাগজ ও কলমের সীমাবদ্ধতা ছিল। ম্যান্ডেলার ছেলে থেম্বি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ম্যান্ডেলাকে ছেলের শোকযাত্রাতেও থাকার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাঁর কম বয়সী মেয়েদের জীবনের এক সংকটময় সময়েও তিনি পাশে থাকতে পারেননি। বন্দিজীবন তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল সেসব অধিকার। মেয়ে জেনামির ১২তম জন্মদিনে মেয়েকে কারাগার থেকে চিঠি লেখেন ম্যান্ডেলা। এক দশক আগে গ্রেপ্তার এড়াতে বাড়ি থেকে পালিয়ে গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছিলেন ম্যান্ডেলা। ওই সময় অল্প সময়ের জন্য মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি লিখেন, ‘একটা কোনায় আমার ঝুলিয়ে রাখা পোশাক দেখতে পেয়েছিলে তুমি। সেটা তুমি আমার হাতে দিয়ে বাসায় রওনা হতে বলেছিলে। তুমি ওই সময় কিছুক্ষণ আমার হাত ধরে রেখেছিলে, আমাকে জোরে টানছিলে আর বাসায় ফিরে যেতে আকুতি জানাচ্ছিলে।’

বেদনাময় এই চিঠিগুলোর অন্য আরেকটি দিক ম্যান্ডেলা ওই সব স্মৃতিকে বাস্তব করে রাখতে চেয়েছিলেন। ১২ বছর বয়সী মেয়ের প্রতি শুধু তাঁর ভালোবাসাই নয়, সেই ভালোবাসার সন্তানের হৃদয় ভেঙে যাওয়ার স্মৃতিও তিনি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। মাত্র দুই বছর বয়স থেকে বাবার কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শিশুটি তাঁর বাবার প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছে, তা তিনি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। জেনামি গর্ভে থাকা অবস্থায় মা উইনি ম্যান্ডেলাকে কিছুদিন জেল খাটতে হয়েছে। ম্যান্ডেলা তাঁর মেয়েকে সেই কথাও মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, জন্মের আগেই তাঁর (জেনামি) জেল খাটার ঘটনা বিরল।

ম্যান্ডেলার চিঠিগুলো তাঁদের নিজস্ব শব্দ ছাপিয়ে যেন গল্প বলে গেছে। প্রকাশিত সংকলনে বেশ কিছু ছবিও যুক্ত করা হয়েছে। ম্যান্ডেলার হাতে লেখায় যত্নের ছাপ থাকলেও তা ছিল ঘিজিঘিজি। এক পাতায় যতখানি শব্দ আঁটানো যায়, সে চেষ্টা ছিল। হয়তো কাগজ ও কলমের কালি সাবধানে খরচ করতেও এভাবে লিখেছেন তিনি। তিনি শব্দ দিয়ে এমন সেতু বানানোর চেষ্টা করতেন, যা তাঁকে কারাগার থেকে বাড়িতে অপেক্ষারত স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে পৌঁছে দিত। যখন শব্দগুলো চিঠির পাতার বাইরে উপচে পড়তে চাইত, সেখানেও এমন কিছু ভাবনা থেকে যেত, যা লেখায় প্রকাশ করা হয়নি। ম্যান্ডেলা জানতেন, তাঁর চিঠি কারা কর্তৃপক্ষ সেন্সর করে। যেসব চিঠি নষ্ট করে ফেলা হতো, সেসব নিয়ে প্রায়ই জানতে চাইতেন তিনি। ১৯৭০ সালের ১ আগস্ট একবার উইনিকে তিনি লিখেছিলেন, ‘১ জুলাই আমার পাঠানো চিঠি কী তুমি পাওনি? যখন আমাদের দুজনের যোগাযোগ করা এত গুরুত্বপূর্ণ, তখন তোমার এমন অদ্ভুত নীরবতার কী ব্যাখ্যা করব আমি?’

ম্যান্ডেলা নিশ্চয় জানতেন, একদিন সারা বিশ্বের লোকজন তাঁর এসব চিঠি পড়বেন। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হারিয়ে যাওয়ার মানে হচ্ছে হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের সম্পর্কগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও হারিয়ে যাওয়া। তিনি খেদোক্তি করে বলেছিলেন, ‘জীবনের কোনো সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষ থাকলে, তাঁরা যে-ই হোন না কেন, তাঁদের এর ভেতরে থাকতে দেওয়া উচিত নয়।’ কিন্তু তিনি জানতেন, কীভাবে না বলা হাজারো শব্দের মধ্যে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ানো যায়। তিনি উইনিকে লিখেছিলেন, ‘আমার সন্দেহ হয় তুমি হয়তো বিশেষ বার্তা পাঠানোর জন্য অভীষ্ট কিছু চিত্র আঁকা শিখে গেছ, যা কখনো কোনো শব্দ দিয়েও প্রকাশ করা সম্ভব না। নিশ্চিত থাকো যে আমি তা ধরে ফেলেছি।’

ছেলেকে লেখা চিঠিতে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘পৃথিবী থেকে যাঁরা দারিদ্র্য নির্মূল করতে চান, তাঁদের অবশ্যই অন্য কোনো হাতিয়ার ব্যবহার করতে হবে, দয়া দেখানো ছাড়া অন্য কোনো হাতিয়ার।’ এর মাধ্যমে তিনি বুঝিয়েছিলেন, সামাজিক অবিচারের কাঠামোর বিরুদ্ধে কঠোর লড়াই করার প্রয়োজনীয়তার কথা। তিনিই সত্য ছিলেন। যাঁরা এই সংকলন পড়বেন, তাঁরাও কাগজে লিপিবদ্ধ করে খামে ভরা চিঠিগুলোর ক্ষমতা আবিষ্কার করতে পারবেন। এর ক্ষমতা সম্পর্কে ম্যান্ডেলা লিখেছিলেন, ‘লোহার শক্ত দরজা ও পাথরের দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেঙে বসন্ত সময়ের জৌলুশ ও উষ্ণতা কারাকক্ষে নিয়ে আসার’ মতো।