মাদিবার দল এএনসি কোন পথে?

নেলসন ম্যান্ডেলা, থাবো এমবেকি, জ্যাকব জুমা ও সিরিল রামাফোসা।
নেলসন ম্যান্ডেলা, থাবো এমবেকি, জ্যাকব জুমা ও সিরিল রামাফোসা।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ১০০তম জন্মদিন আজ। সারা বিশ্ব সোৎসাহে তাঁর জন্মদিন পালন করছে। একই সঙ্গে তাঁর অবদান স্মরণ করছে। আজীবন সংগ্রামী ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকায় নেতৃত্বের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। এখন কোন পথে তাঁর দল, আর নেতৃত্বেরই-বা কী হাল—এসব মূল্যায়নের দিনও আজ।

১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই কেপটাউনের কুনু গ্রামে জন্ম ম্যান্ডেলার। তরুণ বয়সেই ম্যান্ডেলার মুক্তির সংগ্রাম শুরু। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের একনিষ্ঠ সৈনিকের খাতায় নাম লেখান তিনি। কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তি সংগঠন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগ দেন ১৯৪৪ সালে। পরের ইতিহাস সংগ্রাম, ত্যাগ, সমঝোতা ও শান্তির।

৯৫ বছরের জীবন ম্যান্ডেলার। ২৭ বছরই কেটেছে কারাগারে। তবে শেষ পর্যন্ত বিজয় ধরা দিয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে। সর্বজনীন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৬২ সালে ম্যান্ডেলার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়। ১৯৬৪ সালে হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ম্যান্ডেলাকে রবেন দ্বীপের কারাগারে পাঠানো হয়। কারাবন্দী ম্যান্ডেলা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। বিপুল জনসমর্থন পান তিনি। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন।

ম্যান্ডেলার শক্তি সরকারও টের পায়। চাপের মুখে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ কারাভোগের পর ম্যান্ডেলা ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান।

মুক্ত ম্যান্ডেলার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। ম্যান্ডেলার জনপ্রিয়তা তাঁকে নিজ দল এএনসির চালকের আসনে নিয়ে যায়। এএনসিও ম্যান্ডেলার নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করে। ১৯৯১ সালে ম্যান্ডেলা সর্বসম্মতভাবে এএনসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

ম্যান্ডেলা ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এএনসির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি এএনসির ১১তম প্রেসিডেন্ট। দলের নেতা হয়ে ম্যান্ডেলা শান্তি ও সমঝোতার পথ বেছে নেন। বর্ণবাদের অবসান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তৎকালীন ডব্লিউ ডি ক্লার্কের শ্বেতাঙ্গ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।

ম্যান্ডেলার পথ মোটেই সহজ ছিল না। সামনে বারবার বাধা এসেছে। শান্তি আলোচনা ব্যাহত হয়েছে। সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ম্যান্ডেলা ধৈর্যের সঙ্গে সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এগিয়ে গেছেন। তিনি আলোচনা-সমঝোতার পথে থেকেছেন। অস্থিরতার লাগাম টেনে ধরতে উদ্যোগী হয়েছেন। নিরাপত্তা ও ন্যায্য অধিকার প্রশ্নে সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের পাশে থেকেছেন। অবশেষে শান্তি। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ম্যান্ডেলার সবচেয়ে বড় অবদান। স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৩ সালে ম্যান্ডেলা ও ক্লার্ক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পান।

১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতান্ত্রিকভাবে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ম্যান্ডেলা। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও ম্যান্ডেলা তাঁর মৌলিক সংগ্রাম চালিয়ে যান। বিশ্বের কাছে আদর্শ রাষ্ট্রনায়কের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

এএনসির প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের আবেগের মূলে রয়েছে একটি নাম—মাদিবা (ম্যান্ডেলা)। কারণ, তাঁর নেতৃত্বেই দক্ষিণ আফ্রিকায় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্র আসে। মুক্ত ও সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্ণবাদের অবসান ঘটে। কিন্তু ম্যান্ডেলা-পরবর্তী এএনসির ইতিহাস হতাশার। এখন দেশটির অনেকের প্রশ্ন, এএনসি কোথায় যাচ্ছে?

ম্যান্ডেলার শততম জন্মদিন সামনে রেখে দ্য সাউথ আফ্রিকান এক প্রতিবেদনে বলছে, ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল এএনসি নিশ্চিতভাবে তাদের অধিকাংশ শুদ্ধতা হারিয়েছে। বিশেষ করে জ্যাকব জুমার দুই মেয়াদ (২০০৭-১৭) দেশ ও দলের জন্য ছিল এক ধ্বংসাত্মক অধ্যায়। তবে এই সর্বনাশের জন্য তিনি এককভাবে দায়ী নন। অন্যদেরও দায় আছে।

ম্যান্ডেলার পর এএনসির নেতৃত্বে আসেন থাবো এমবেকি। তাঁর উত্তরসূরি জ্যাকব জুমা। তাঁরা দেশটির সব মানুষের নেতা হয়ে উঠতে ব্যর্থ হন। উল্টো দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মে জড়ান। তাঁরা ম্যান্ডেলার মূল্যবোধ ভুলে পথ হারান। একই সঙ্গে দেশ ও দলের বড্ড ক্ষতি করেন। গত বছরের ডিসেম্বরে এএনসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সিরিল রামাফোসা। তিনি বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পরিচিত মুখ। এএনসিতে ম্যান্ডেলা আমলের গৌরব ফিরিয়ে আনার গুরুদায়িত্ব এখন রামাফোসার।