সন্তানের মৃত্যুতে স্ত্রীকে চিঠি

বড় ছেলে থেম্বির সঙ্গে ম্যান্ডেলা।
বড় ছেলে থেম্বির সঙ্গে ম্যান্ডেলা।

১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই। ছেলের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলাকে বিশেষ চিঠি লেখেন ম্যান্ডেলা।

ম্যান্ডেলা লেখেন:

আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না আমি আর কোনো দিন থেম্বিকে দেখতে পাব না।
এ বছরেই সে চব্বিশে পা দিল। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর জন্মদিন। ৬২-এর জুলাইয়ে আমি তাকে শেষ দেখেছিলাম। আমি সবে বিদেশ থেকে ফিরেছি। থেম্বি তখন সতেরোর টগবগে তরুণ। মৃত্যুর মতো ভয়ংকর ব্যাপারের সঙ্গে তাকে কিছুতেই মেলানো যায় না।

থেম্বি সেদিন আমার একটা ট্রাউজার পরেছিল। সেটা ছিল যেমন ঢিলে, তেমন লম্বা। ঘটনাটা আমার মনে বেশ দাগ কেটেছিল। তুমি তো জানোই, থেম্বি পোশাকের ব্যাপারে বেশ শৌখিন ছিল। তার নিজেরই অনেক জামাকাপড় ছিল। আমার ট্রাউজার পরার কোনো দরকারই ছিল না তার; তবুও সে পরেছিল। আমার পোশাক পরার পেছনে তার যে আবেগ কাজ করছিল, তা সে মুখে না বললেও আমি টের পেয়েছিলাম।

এরপর থেকে আমি প্রতি মুহূর্ত অনুধাবন করেছি, আমার অনুপস্থিতি আমাদের ছেলেমেয়েদের ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছে।

আমার এখনো মনে আছে, ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে অপেক্ষাধীন বন্দী হিসেবে আমি জোহানেসবার্গ দুর্গে আছি। কগাথোর বয়স তখন মাত্র ছয়। সে তখন পূর্ব অরল্যান্ডোতে ছিল। সে জানত আমি কারাগারে আছি, এরপরও সে তার দাদির কাছে পশ্চিম অরল্যান্ডোতে গিয়েছিল। সেই রাতে সে আমার বিছানায় ঘুমিয়েছিল। কগাথো তার দাদিকে বলেছিল, সে আমাকে খুব মিস করছে।

আবার ফিরছি থেম্বির কথায়। বোর্ডিং স্কুলের যাওয়ার আগে সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছিল। সেদিন সে শক্ত করে আমার হাত ধরে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল।

এরপর একসঙ্গে বসে আমরা অনেক বিষয়ে কথা বলেছিলাম। স্বভাবতই আমাদের আলোচনা তার পড়াশোনার দিকেই মোড় নিচ্ছিল। এ সময় শেক্‌সপিয়ারের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটক নিয়ে তার গভীর পর্যালোচনা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তার বয়সে এমন গভীর বোধশক্তি সত্যি অনুপ্রেরণাদায়ক।

ম্যাটাটিয়েল থেকে ওডহাউস, থেম্বির স্কুলজীবনের পুরো সময়টাতেই আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হতো।
১৯৬০ সালের ডিসেম্বরে বেশ খানিকটা রাস্তা গাড়ি চালিয়ে আমি থেম্বির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ১৯৬২ সালের আগ পর্যন্ত আমি থেম্বিকে শিশু ভাবতাম; তেমনই ব্যবহার করতাম তার সঙ্গে। কিন্তু ৬২’র পর আমার দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বদলে যায়। আমি বুঝতে পারি, থেম্বি এখন আর শিশুটি নেই। ওর নিজস্ব একটা জীবনদর্শন গড়ে উঠেছে।
আমার ছেলে তখন আমার বন্ধু হয়ে উঠছিল। হ্যাঁ, বন্ধুই বটে! আমার ওপর থাকা আইনি নিষেধাজ্ঞার কারণে আমি তাকে বিদায় জানাতে বাসস্ট্যান্ড কিংবা রেলস্টেশনে যেতে পারতাম না। থেম্বি একাই এই বন্ধুর পৃথিবীতে নিজের জায়গা করে নিচ্ছিল। বন্ধু না হলে তা কি সম্ভব হতো? এমন এক পৃথিবীতে তাকে একাই খাপ খাওয়াতে হচ্ছিল, যেখানে তার বাবা হয়েও আমাকে গোপনে তার সঙ্গে দেখা করতে হতো, তা-ও আবার কালেভদ্রে একবার।

আমি জানি, তুমি থেম্বিকে জামাকাপড় কিনে দিতে, টাকাপয়সাও দিতে। আমার সেই সুযোগ হয়নি। এক হতভাগ্য পলাতক বাবা হয়ে আমি ওর জন্য কিছুই করতে পারিনি।

রোভোনিয়া মামলার শুনানির সময় একদিন সে আমার ঠিক পেছনে বসেছিল। আমি বারবার পেছনে তাকাচ্ছিলাম আর ওর দিকে মাথা নেড়ে হাসছিলাম। থেম্বি জানত বেশ বড়সড় শাস্তিই দেওয়া হবে আমাকে। এরপরও সে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ছিল—যদিও একবারও হাসেনি সে।

পাঁচ বছর আগের সেই দিনে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আমি তাকে আর দেখতে পাব না।

আজকের আগে আর কখনো তোমার কথা এত করে মনে পড়েনি আমার। জীবনের সবচেয়ে দুর্বিষহ এবং তিক্ততম দিনে একটা গল্প মনে পড়ছে...
পি জে শ্যুম্যান লেখেন, আফ্রিকার এক কমান্ডার ইন চিফ তার সেনাবাহিনী নিয়ে গেলেন শিকারে। শিকারের একপর্যায়ে কমান্ডারের ছেলে সিংহের আক্রমণে নিহত হয়, কমান্ডার নিজেও মারাত্মক জখম হন। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে ঘা শুকিয়ে আসতে থাকে। একদিন শ্যুম্যান কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কেমন আছেন।

জবাবে কমান্ডার বলেন, বাইরের ব্যথার থেকে ভেতরের অদৃশ্য ব্যথা বেশি পীড়াদায়ক!
এখন আমি জানি, কমান্ডার ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন।