সাদা আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়েছেন, লড়েছেন কালোর বিরুদ্ধেও

কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছেন ম্যান্ডেলা, পাশে স্ত্রী উইনি। রোবেন দ্বীপ, ১৯৯০। ছবি: রয়টার্স
কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছেন ম্যান্ডেলা, পাশে স্ত্রী উইনি। রোবেন দ্বীপ, ১৯৯০। ছবি: রয়টার্স

দক্ষিণ আফ্রিকার বন্ধু, কমরেড এবং সঙ্গীরা,
আপনাদের সবাইকে শান্তি, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার শুভেচ্ছা জানাই। আপনাদের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি কোন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নবী হিসেবে নয়, জনগণের নিতান্ত একজন সেবক হিসেবে। আপনাদের অক্লান্ত বীরোচিত ত্যাগের কারণেই আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে। আর ঠিক এই কারণেই জীবনের বাকি বছরগুলোও আপনাদের হাতেই সমর্পণ করছি।

আমার মুক্তির এই দিনে, আমার দেশের লাখ লাখ মানুষ এবং পৃথিবীর আনাচকানাচে আমার মুক্তির জন্য ক্লান্তিহীন প্রচার চালিয়ে গেছেন যাঁরা, তাঁদের প্রতি আন্তরিক উষ্ণতম কৃতজ্ঞতা। বিশেষ কৃতজ্ঞতা কেপটাউনের অধিবাসীদের, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এ আমার নিজের শহর। আপনাদের সম্মিলিত অগ্রযাত্রা এবং সমস্ত সংগ্রাম রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য সার্বক্ষণিক শক্তির এক উৎস হয়ে ছিল।

স্যালুট আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে। স্বাধীনতার মহান লড়াইয়ের নেতৃত্বে আমাদের প্রত্যাশিত প্রতিটি ভূমিকা সে পূরণ করেছে। আমাদের প্রেসিডেন্ট কমরেড অলিভার ট্যাম্বোকে আমার স্যালুট, এএনসিকে কঠিনতম সময়ে পথ দেখানোর জন্য। স্যালুট এএনসির প্রতিটি কর্মীকে। এই লড়াইয়ের মহত্তম লক্ষ্যের প্রশ্নে আপনারা শরীর এবং জীবন উৎসর্গ করেছেন। উমকোনতো ওই সিজওয়ে (এএনসির সশস্ত্র শাখা, আক্ষরিক অর্থ‍জাতির ধনুক)-এর সলোমন মালাঙ্গু আর অ্যাশলি ক্রিয়েলের মতো যোদ্ধাদের, যাঁরা সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তির জন্য চুকিয়েছেন চরম মূল্য।

স্যালুট জানাই দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টিকে, স্বাধীনতাসংগ্রামে যে চড়া দাম তাঁকে দিতে হয়েছে তার জন্য। ৪০ বছর ধরে অবিরত নিধনের শিকার হয়েও টিকে আছেন আপনারা। মোজেস কোতেন, য়ুসুফ, ব্রাম ফিশার আর মোজেস মাভিদার মতো মহান কমিউনিস্টদের স্মৃতি অনাগত প্রজন্ম লালন করে যাবে। আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমী সাধারণ সচিব জো স্লোভোকে স্যালুট জানাই। পার্টির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সব সময়ের মতোই মজবুত রয়েছে—এই ব্যাপারটি আনন্দিত করে।

স্যালুট জানাই ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, ন্যাশনাল এডুকেশন ক্রাইসিস কমিটি, সাউথ আফ্রিকান ইয়ুথ কংগ্রেস, ট্র্যান্সভ্যাল অ্যান্ড নেটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেসসমূহ ও কোসাটু এবং মাস ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের সব স্তরকে। ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকান স্টুডেন্টস আর ব্ল্যাক স্যাশকেও স্যালুট জানাই। গর্বের সঙ্গে আমরা লক্ষ করেছি যে তোমরা নিষ্পাপ দক্ষিণ আফ্রিকার বিবেক হিসেবে কাজ করেছ। আমাদের সংগ্রামের ইতিহাসের ক্রূরতম দিনগুলোতেও তোমরা স্বাধীনতার পতাকাকে ওপরে তুলে ধরেছ। আমাদের সংগ্রামের চূড়ান্ত অধ্যায়ের উন্মোচনের দিকে নিয়ে যেতে গত কয়েক বছরের ব্যাপক জন-উদ্যোগ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

দেশের শ্রমজীবী মানুষদের আমি অভিনন্দন জানাই। আপনাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি আমাদের আন্দোলনের গর্ব। শোষণ আর নির্যাতন বন্ধ করার এই সংগ্রামে আপনারাই ছিলেন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শক্তি। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই সেই সব ধর্মীয় সংঘকে, যারা ন্যায়ের জন্য প্রচারণাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে, যখন জনতার সংগঠনগুলোর কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়েছিল।

আমাদের দেশের প্রথাগত নেতাদের শুভেচ্ছা জানাই‍। আপনাদের অনেকেই হিনৎসা আর শেখুখুনির মতো মহান বীরদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। তরুণেরা, এই যে যুবক সিংহের দল, তোমাদের অশেষ বীরত্বকে আমি শ্রদ্ধা জানাই। আমাদের মা, স্ত্রী এবং বোনদেরকে শ্রদ্ধা জানাই। আমাদের সংগ্রামের দৃঢ় প্রস্তর ভিত্তি আপনারা। বর্ণবৈষম্য আর যে-কারও চেয়ে আপনাদের যন্ত্রণার কারণ হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

আজকের এই উপলক্ষে, বিশ্ব সম্প্রদায়কে বর্ণবৈষম্যবিরোধী সংগ্রামে তাদের বিশাল অবদানের জন্য ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের সমর্থন ছাড়া এই সংগ্রাম এতখানি এগিয়ে যেতে পারত না। দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণ এই অগ্রবর্তী রাষ্ট্রসমূহের ত্যাগ কখনোই ভুলবে না।

আর কিছু বলার আগে বলে নেওয়া ভালো যে এই পর্যায়ে শুধু কিছু প্রাথমিক মন্তব্যই আমি করতে পারি। একটা পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য শুধু আমার কমরেডদের সঙ্গে আলাপ করার পরই তৈরি করা সম্ভব।

আজ দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের অধিকাংশই, সাদা অথবা কালো—বুঝতে পারছে যে বর্ণবৈষম্যের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের নিজেদেরই বিপুল কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এর শেষ হতে হবে—শান্তি ও নিরাপত্তা গড়ে তোলার প্রশ্নে। আমাদের সংগঠন এবং জনগণের প্রতিরোধ ও অন্যান্য আন্দোলনই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পরিণতি পেতে পারে। আমাদের উপমহাদেশে বর্ণবৈষম্যের ধ্বংসযজ্ঞ অপরিমেয়। লাখো পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষ হয়েছে ঘরছাড়া, বেকার। অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে, আমার দেশের মানুষ জড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক বিবাদে। সশস্ত্র সংগ্রামের আশ্রয় নিয়ে বেছে নিয়ে ১৯৬০ সালে এএনসির মিলিটারি শাখা উমকোনতো ওই সিজওয়ে গঠন ছিল শুধু বর্ণবৈষম্যের সহিংসতার বিরুদ্ধে একটি আত্মরক্ষার কার্যক্রম। যেসব কারণে সশস্ত্র সংগ্রাম অনিবার্য ছিল, সেগুলো আজও বিদ্যমান আমরা এই আশা প্রকাশ করি যে আলোচনাভিত্তিক বোঝাপড়া খুব দ্রুতই গড়ে উঠবে, তাতে সশস্ত্র সংগ্রামের আর প্রয়োজন থাকবে না।

আমি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অনুগত এবং সুশৃঙ্খল একজন সদস্য। সে জন্যই আমি এর উদ্দেশ্য, রণনীতি ও কৌশলের সঙ্গে পুরোপুরি একমত। আগের যেকোনো সময়ের মতোই দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা এখনো ভীষণ প্রয়োজনীয়। কোনো একক নেতাই এই বিপুল কাজ একা করতে সক্ষম নয়। নেতা হিসেবে আমাদের কাজ সংগঠনের সামনে আমাদের মতামতগুলো উপস্থাপন করা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলোর ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার ছেড়ে দেওয়া। গণতান্ত্রিক চর্চার প্রশ্নে উল্লেখ করা কর্তব্য মনে করি যে জাতীয় সম্মেলনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন ব্যক্তিই আন্দোলনের নেতা। কোনো ব্যত্যয় ছাড়া এই নীতি পালন করতে হবে।

>

আমি সাদা আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়েছি এবং লড়েছি কালো আধিপত্যের বিরুদ্ধেও। আমি সেই গণতান্ত্রিক আর মুক্ত সমাজের আদর্শই স্বপ্ন দেখেছি, যেখানে সমস্ত মানুষের সহাবস্থান এবং প্রত্যেকে সমান সুযোগ পায়। এটা এমন এক আদর্শ, যার জন্য আমি বেঁচে থাকতে চাই এবং যাকে অর্জন করতে চাই। কিন্তু যদি প্রয়োজন হয়, এটা হলো সেই আদর্শ‍ যার জন্য আমি মৃত্যুকেও বরণ করতে প্রস্তুত।

আজ আমি আপনাদের জানাতে চাই যে সরকারের সঙ্গে আমার আলোচনাসমূহের লক্ষ্য ছিল দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা। এখন পর্যন্ত আমরা এই সংগ্রামের মৌলিক দাবি নিয়ে কোনো আলোচনা শুরু করিনি। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, আমি কখনোই এএনসির সঙ্গে সরকারে বসার বিষয় ছাড়া দেশের ভবিষ্যৎ বিষয়ে কোনো আলোচনাই যাইনি।

পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে মিস্টার ডি ক্লার্ক অন্য যেকোনো জাতীয়তাবাদী প্রেসিডেন্টের চেয়ে অনেক এগিয়ে। যা-ই হোক, হারারে ঘোষণায় দেওয়া আরও পদক্ষেপ রয়েছে, যেগুলো আমাদের জনগণের মৌলিক দাবিগুলোর বিষয়ে আলোচনার আগেই পূরণ করা যায়। অনতিবিলম্বে জরুরি অবস্থার অবসান এবং সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্ত করে দিতে আমাদের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করছি। স্বাধীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্ভব শুধু এমন একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই একটি ম্যান্ডেট পাওয়ার প্রশ্নে জনগণের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হতে পারে।

কে মধ্যস্থতা করবে এবং এ রকম মধ্যস্থতার বিষয়বস্তু কী হবে—এই বিষয়ে জনগণের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। লোকজনের মাথার ওপর দিয়ে অথবা তাদের আড়ালে সমঝোতা হতে পারে না। এটা আমাদের বিশ্বাস যে দেশের ভবিষ্যৎ কেবল এমন একটি কর্তৃপক্ষ দিয়ে নির্ধারিত হতে পারে, যারা বর্ণবৈষম্যহীনতার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত। বর্ণবাদ ভাঙার আলোচনাকে গণতান্ত্রিক, বর্ণবৈষম্যহীন এবং একক দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে আমাদের জনগণের বিপুল চাওয়াকে পূরণ করতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতায় সাদাদের একক আধিপত্যের অবসান হতে হবে এবং বর্ণবৈষম্যের অসাম্যগুলো ঘোচাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক পুনর্গঠন ও সমাজের সার্বিক গণতন্ত্রায়ণ নিশ্চিত করতে হবে।

বলা দরকার, মিস্টার ডি ক্লার্ক নিজে একজন সৎ মানুষ এবং তিনি সম্যক অবহিত একজন জনপ্রিয় ব্যক্তির নেওয়া উদ্যোগগুলোকে সম্মান না দিলে কী কী বিপদ ঘটতে পারে। কিন্তু একটি সংগঠন হিসেবে আমাদের কর্মপন্থা আর কৌশলগুলো আমরা যে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি, তার ওপর ভিত্তি করেই করি। আর সেই বাস্তবতাটা হলো, জাতীয়তাবাদী সরকারের নীতির জন্য আমরা আজও ভুগছি।

আমাদের সংগ্রাম একটা চূড়ান্ত মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি জনগণকে এই মুহূর্তটিকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানাই, যাতে গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা নির্বিঘ্ন আর দ্রুতগামী হয়। স্বাধীনতার জন্য অনেক তো প্রতীক্ষা হলো। আর আমরা অপেক্ষায় থাকতে পারি না। সময় এসেছে সমস্ত দিকে সংগ্রামকে জোরদার করার। এমন এক সময়ে আমাদের প্রচেষ্টা কমিয়ে দেওয়া হবে এমন এক ভুল—আগামী প্রজন্মের কাছে যা হবে ক্ষমার অযোগ্য। দিগন্তে মুক্তির দিশা আমাদের প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ করার উদ্যম দিক।

সম্মিলিত সুশৃঙ্খল ভূমিকাই আমাদের বিজয়ের নিশ্চয়তা। নতুন দক্ষিণ আফ্রিকাকে গড়ে তুলতে আমাদের শ্বেতাঙ্গ দেশপ্রেমীদের আহ্বান জানাই। স্বাধীনতার আন্দোলন আপনাদেরও রাজনৈতিক ঠিকানা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাই বর্ণবাদী রাজত্বকে একঘরে করার প্রচারণা চালিয়ে যেতে। নিষেধাজ্ঞা এখন তুলে নেওয়ার মানে হলো বর্ণবাদের সম্পূর্ণ বিলোপকরণ প্রক্রিয়াকে বন্ধ করার ঝুঁকি নেওয়া।

স্বাধীনতার পথে আমাদের যাত্রা অপরিবর্তনীয় ভয়কে কোনোভাবেই জায়গা দেওয়া যাবে না। ঐক্যবদ্ধ, গণতান্ত্রিক এবং বর্ণবাদহীন দক্ষিণ আফ্রিকায় সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ভোটারদের সার্বিক ভূমিকা শান্তি আর বিভিন্ন বর্ণের সহাবস্থান অর্জনে একমাত্র উপায়।

সব শেষে, ১৯৬৪ সালে আমার বিচার চলাকালে আমি যা বলেছিলাম, সেটুকু বলতে চাই। সেগুলো আজও সমান সত্য, যেমন ছিল সেদিনও:

আমি সাদা আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়েছি এবং লড়েছি কালো আধিপত্যের বিরুদ্ধেও। আমি সেই গণতান্ত্রিক আর মুক্ত সমাজের আদর্শই স্বপ্ন দেখেছি, যেখানে সমস্ত মানুষের সহাবস্থান এবং প্রত্যেকে সমান সুযোগ পায়। এটা এমন এক আদর্শ, যার জন্য আমি বেঁচে থাকতে চাই এবং যাকে অর্জন করতে চাই। কিন্তু যদি প্রয়োজন হয়, এটা হলো সেই আদর্শ‍ যার জন্য আমি মৃত্যুকেও বরণ করতে প্রস্তুত।
* জেল থেকে মুক্তির পর ম্যান্ডেলার ভাষণ। কেপটাউন, ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০