জনগণের মুক্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি

নেলসন ম্যান্ডেলা। এএনসির সম্মেলনে। ছবি: ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে
নেলসন ম্যান্ডেলা। এএনসির সম্মেলনে। ছবি: ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে

দশকের পর দশক ধরে আমরা যে লড়াই করেছি, সে কারণেই শক্তির ভারসাম্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। শাসক দল ন্যাশনাল পার্টি সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের শাসন চিরস্থায়ী করার যে চিন্তাভাবনা করেছিল, আমাদের চাপের মুখে বুঝতে বাধ্য হয়েছে যে বর্ণবাদী ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার মতো শক্তিসামর্থ্য আর তাদের নেই। জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় তাদের বসতেই হবে। আলোচনায় বসাতে পারাটাই আমাদের সংগ্রামের একটা বড় বিজয়। আর শাসক দলের জন্য তা একটা পরাজয়। এই শাসক দল চিরদিনের জন্য একতরফাভাবে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে মরিয়া হয়েছিল।

আত্মসমর্পণ ও দাসত্বের কাছে নিজেদের সঁপে দেওয়ার একমাত্র বিকল্প হিসেবে আমরা অস্ত্র হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খুব সহজে এবং হালকাভাবে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিইনি। শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমাদের জনগণের মুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমরা যেকোনো প্রকৃত সুযোগ নিতে সদা প্রস্তুত ছিলাম, এখনো আছি।

এই শাসকদের সঙ্গে আলোচনার শুরু থেকেই আমরা সদা সতর্ক ছিলাম। আমরা জানি যে এই আলোচনার প্রক্রিয়া খুব সহজ ও মসৃণ হবে না। কারণ, এই শাসকেরা বর্ণবাদ, সহিংসতা ও নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আমরা এমন একদল রাজনীতিকের সঙ্গে আলোচনা করছি যারা নিজেদের ক্ষমতা ছাড়া কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চান না। দেশটির প্রতিনিধিরাও গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে শঙ্কিত।

>আন্দোলন করতে গিয়ে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছি যে দেশে আমাদের ছাড়া আরও রাজনৈতিক সংগঠন আছে। তারাও আমাদের মতোই বিদ্যমান। নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন এবং ওই সব নীতি ও সংগঠনের পক্ষে কথা বলা ও প্রতিযোগিতা করার অধিকার তাদেরও আছে। এদের সবার সঙ্গে আলোচনা করতে আমরা সম্মত হয়েছি এবং ইতিমধ্যে তাদের বেশির ভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। এর কারণ অন্যদের ওপর আমাদের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই।

একটা বিষয় পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে, আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি। তাদের সঙ্গে আলোচনা আমাদের সংগ্রামের একটি নাটক, সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটি বিষয় এবং সংগ্রামের একটি ভিন্ন রূপ।

আমাদের বীরোচিত নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমরা সরকারকে পরাজিত করতে পারিনি। তবে আমাদের মূল লক্ষ্য জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সংগ্রামের ধারাবাহিকতা হিসেবে আমরা এই আলোচনাকে দেখছি। আলোচনার বাইরেও আমাদের বেশ কিছু দাবি আছে। এসবের মধ্যে রয়েছে, একজনের এক ভোট, একটি সংযুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকা, নারী মুক্তি ও মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা নিশ্চিত করা।

আন্দোলন করতে গিয়ে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছি যে দেশে আমাদের ছাড়া আরও রাজনৈতিক সংগঠন আছে। তারাও আমাদের মতোই বিদ্যমান। নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন এবং ওই সব নীতি ও সংগঠনের পক্ষে কথা বলা ও প্রতিযোগিতা করার অধিকার তাদেরও আছে। এদের সবার সঙ্গে আলোচনা করতে আমরা সম্মত হয়েছি এবং ইতিমধ্যে তাদের বেশির ভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। এর কারণ অন্যদের ওপর আমাদের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই।
আমাদের জ্ঞানগরিমা ও বিচক্ষণতাই একচ্ছত্র অগ্রাধিকার পাবে এবং শুধু আমাদের মতামত ও নীতিমালাই আইনগত বৈধ—এ কথা আমরা কখনো দাবি করিনি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সব সময় সবার চিন্তার স্বাধীনতা, সমবায় ও সংগঠন করার অধিকার রক্ষার চেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকবে। এটা আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান। কারণ, আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতি দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।

আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রস্তুতি হিসেবে আমরা এসব কথা বলছি। ওই আলোচনায় অদূর ভবিষ্যতের জন্য আমাদের দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করা হবে। আমরা কী অর্জন করতে চাই, আমরা কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করব এবং আলোচনার ধরন কেমন হবে, সে ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা নিয়েই এসব প্রক্রিয়ায় আমাদের অংশ নিতে হবে।

*এএনসির ৪৮তম জাতীয় সম্মেলনে ম্যান্ডেলার উদ্বোধনী ভাষণের নির্বাচিত অংশ, ডারবান, ২ জুলাই ১৯৯১