পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে জটিল হিসাব-নিকাশ
মাথার ওপর ঝুলছিল আদালতের ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ। দেশে ফিরলেই ঢুকতে হবে লৌহকপাটের ভেতর। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ (৬৮) দেশে ফিরবেন ঘোষণা দেওয়ার পর অনেকেই তা বিশ্বাস করেননি। তাঁদের অবাক করে দিয়ে ১৩ জুলাই লন্ডন থেকে নিজ শহর লাহোরে ফেরেন নওয়াজ শরিফ।
দ্য ইকোনমিস্টের নিবন্ধে জানানো হয়, ২৫ জুলাই দেশটির জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে নওয়াজ শরিফের দেশে ফেরার বিষয়টি প্রভাব ফেলতে পারে।
পাকিস্তানের জবাবদিহি আদালত ৬ জুলাই অ্যাভেনফিল্ড দুর্নীতি মামলায় নওয়াজকে ১০ বছরের সাজা দেন। একই মামলায় নওয়াজের মেয়ে মরিয়ম নওয়াজকে সাত বছর ও তাঁর স্বামী ক্যাপ্টেন (অব.) সফদারকে এক বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। কারাদণ্ডাদেশের পাশাপাশি নওয়াজকে ৮০ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড ও মরিয়মকে ২০ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড জরিমানা করা হয়েছে। তিনজনই এখন কারাগারে। নওয়াজের স্ত্রী কুলসুম লন্ডনে চিকিৎসাধীন।
২০১৬ সালে পানামা পেপারসে লন্ডনের অভিজাত এলাকা পার্ক লেনে অ্যাভেনফিল্ড হাউসে নওয়াজ শরিফের চারটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট থাকার তথ্য ফাঁস হয়। আদালতের জিজ্ঞাসার জবাবে এ ব্যাপারে সন্তোষজনক কোনো জবাব দিতে পারেননি নওয়াজ। তিনি বলেছিলেন, কাতারের এক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান তাঁর বাবার কাছ থেকে নেওয়া ঋণের পরিবর্তে তাঁর পরিবারকে ওই চারটি ফ্ল্যাট দিয়েছে। তাঁর এই অস্পষ্ট জবাবের সমর্থনে কাতারের যুবরাজের চিঠিও এসেছিল, যদিও সেটাকে ‘কৌতুক’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খান।
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে হয় নওয়াজ শরিফকে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করেন। আদালত তাঁকে রাষ্ট্রীয় যেকোনো পদে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে আদালতের রায়ে দলীয় প্রধানের পদও ছাড়তে হয় নওয়াজকে।
১৬ জুলাই নওয়াজ, মরিয়ম ও সফদারের পক্ষে ইসলামবাদ হাইকোর্টে সোমবার সাতটি পৃথক আপিল আবেদন করা হয়। এর মধ্যে শুধু নওয়াজের পক্ষে তিনটি আবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া মরিয়ম ও সফদারের পক্ষে দুটি করে চারটি আবেদন করা হয়েছে।
নওয়াজের পক্ষে আইনজীবী খাজা হারিস আপিল আবেদন করেন। খাজা হারিস বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে পাকিস্তানের জাতীয় জবাবদিহি সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট্যাবিলিট ব্যুরো (এনএবি) নওয়াজ শরিফের শত্রুদের সুবিধা দিতে তড়িঘড়ি করে এই বিচার করেছে—এটা ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
নওয়াজ শরিফ অভিযোগ করেছেন, সেনাবাহিনীর ইন্ধনে বিচার বিভাগ তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে কাজ করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আইনজীবী বলেন, এনএবি সেনাবাহিনীর ‘হাতের পুতুল’ হিসেবে কাজ করছে। পাকিস্তানের বিচার বিভাগ নওয়াজ শরিফ ও তাঁর দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) নেতা-কর্মীদের ওপর খড়্গহস্ত। এ মাসে এনএবি তাঁর সাবেক ব্যক্তিগত সচিবকে গ্রেপ্তার করেছে। এটাকে তিনি ‘নওয়াজ শরিফকে আপসে বাধ্য করতে তাঁর একের পর এক নখ উপড়ে’ ফেলার সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, এ ছাড়া মাসের শুরুতে পিএমএল-এনের এক প্রার্থী সেনাবাহিনীর সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট চৌধুরী নিসার আলীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর গ্রেপ্তার হন। চৌধুরী নিসার আলীর সঙ্গে নওয়াজ শরিফের বৈরী সম্পর্ক রয়েছে।
নওয়াজের দেশে ফেরার কারণে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর দলের সম্পর্ক উন্নয়নের আশা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এমনিতেই পাকিস্তানে একটি দুর্বল বেসামরিক সরকার গঠিত হোক, তা সব সময় চায় সেনাবাহিনী। দেশটির সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নওয়াজের ছোট ভাই শাহবাজ সেনাবাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে দেনদরবার করেছিলেন। তিনি যৌথভাবে সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পিএমএল-এন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও যৌথ সরকার গঠন করবে।
দেশটির টেলিভিশন উপস্থাপক সৈয়দ তালাত হুসেইনের মতে, বড় ভাই নওয়াজ শরিফ উল্টো জেনারেলদের সঙ্গে আরও বিরোধে জড়িয়েছেন। ইমরান খানের দল পিটিআইকে নির্বাচনে জেতাতে সেনাশাসিত সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেছেন। আইএসআইয়ের এক জেনারেল পিএমএল-এনের বিরুদ্ধে পিটিআই প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন বলে তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। সাধারণভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে জেনারেলদের বিরুদ্ধে এমন খোলাখুলি অভিযোগ করার রেওয়াজ নেই। সেনাবাহিনীকে সেখানে তোয়াজ করেই চলেন রাজনীতিবিদেরা। সেনাবাহিনীকে সেখানে নামে না ডেকে ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ বলার চল রয়েছে।
এর আগে নওয়াজ শরিফের অনুপস্থিতিতে তাঁর দলের নির্বাচনী প্রচার ব্যাহত হচ্ছিল বলে মনে হয়েছে। গ্যালাপের জরিপ বলছে, পিএমএল-এনের সঙ্গে পিটিআইয়ের বেশ ফারাক ছিল। তবে এখন হিসাবের নানা গোঁজামিলে নওয়াজের দলের সঙ্গে প্রায় একই পর্যায়ে রয়েছে পিটিআই। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট সুসি মনে করে, নির্বাচনের পর যৌথ সরকার গঠনে ইমরানের দলের ৭৫ শতাংশ সুযোগ রয়েছে।
তবে নওয়াজের দেশে ফেরা সব হিসাব পাল্টে দিতে পারে। এগিয়ে যেতে পারে পিএমএল-এন। তাঁর গ্রেপ্তার হওয়া নিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারত। অনেকে অনুমান করেছিলেন, তাঁকে বহনকারী উড়োজাহাজকে লাহোরের পরিবর্তে অন্য কোথাও অবতরণ করানো হবে। তাঁকে উড়োজাহাজের ভেতরই হয়তো হাতকড়া পরানো হতো। বিমানবন্দরে সহিংসতা এড়াতে তা করা থেকে বিরত থেকেছে কর্তৃপক্ষ। নওয়াজ যেন এই ইস্যুতে লোকজনের সহানুভূতি না কাড়তে পারেন, সেটাও ছিল উদ্দেশ্য।
তবে ঘটনা যা-ই হোক না কেন, নওয়াজ ও তাঁর মেয়ে ‘আত্মদানের’ মর্যাদা পেতে পারেন। যদি তাঁর দল নির্বাচনে নাও জেতে, তাও কারাবরণ করে নওয়াজ তাঁর ভাবমূর্তি বদলানোর সুযোগ পেতে পারেন। কর ফাঁকিদাতা থেকে তিনি বনে যেতে পারেন গণতন্ত্রের জন্য আত্মদান করা মানুষের প্রতীকে। তবে এমনটা হোক, সেনাবাহিনী নিশ্চয়ই তা চাইবে না।