কেরালায় নারী বিক্রয়কর্মীদের বসতে দিতে আইনে সংশোধন আনা হচ্ছে

দোকানে থাকা অবস্থায় একবারও বসার অধিকার পান না বলে অভিযোগ করেছেন নারী বিক্রয়কর্মীরা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
দোকানে থাকা অবস্থায় একবারও বসার অধিকার পান না বলে অভিযোগ করেছেন নারী বিক্রয়কর্মীরা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

সারা দিন একদণ্ড দম ফেলার ফুরসত নেই, আর তো বসা! একেবারে থাকতে হয় খাড়া। এই খাড়া থেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা চালিয়ে যেতে হয় বেচাবিক্রি। কেউ বসার চেষ্টা করেছে তো চাকরি নট। এমন দুর্গতি ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কেরালার নারী বিক্রয়কর্মীদের। পোশাক, অলংকারসহ বাণিজ্যিক পণ্য বিক্রির দোকানে কাজ করেন তাঁরা। এত দিনে তাঁদের এই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার দুর্গতি থেকে একটুখানি বসার ফুরসত মিলতে যাচ্ছে। 

‘বসার অধিকার’ চেয়ে দীর্ঘ আন্দোলনের সুফল পেতে যাচ্ছেন এসব নারী। কর্মীদের কাজের ফাঁকে বসতে দিতে দোকানের মালিকদের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা আসছে। এ লক্ষ্যে শ্রম আইন সংশোধনের ঘোষণা দিয়েছে রাজ্য সরকার।

আজ সোমবার বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, নারী কর্মীদের ‘বসার অধিকার’-এর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে শ্রম আইনে সংশোধন আনার ঘোষণা দিয়েছে কেরালা রাজ্য সরকার।
কেরালায় চার বছর আগে কাপড়ের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন মায়া দেবী। তাঁর কাজ ছিল শাড়িসহ কাপড়ের রোল নামিয়ে ক্রেতাদের দেখানো। তিনি অভিযোগ করেন, কর্মক্ষেত্রে তিনি কখনোই বসার সুযোগ পেতেন না। তিনি বলেন, ‘আমাদের বসার কোনো অনুমতি ছিল না। দোকানে ক্রেতা না থাকলেও আমরা বসতে পারতাম না।’ এমনকি তিনি শৌচাগারে যাওয়ারও সুযোগ পেতেন না বলে জানিয়েছেন।
মায়া দেবীর একারই শুধু এ অভিজ্ঞতা নয়। কেরালায় পোশাক, অলংকার ও অন্যান্য বাণিজ্যিক পণ্য বিক্রির দোকানে নারী বিক্রয়কর্মীদের সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতেও দেন না দোকানের মালিকেরা। এমনকি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা কোনো কর্মী দেয়ালে হেলানও দিতে পারেন না। এসব মেনে না চললে প্রায়ই বেতন কেটে নেওয়া হয়।

‘বসার অধিকার’-এর দাবিতে নারীদের ট্রেড ইউনিয়ন ‘পেনকুটাম’-এর একটি সভা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
‘বসার অধিকার’-এর দাবিতে নারীদের ট্রেড ইউনিয়ন ‘পেনকুটাম’-এর একটি সভা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

এই নিয়ম এত বেশি প্রচলিত সেখানে যে কেরালার নারী ইউনিয়ন ‘বসার অধিকার’ চেয়ে লড়াইয়ে নামে। শেষ পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলনের সুফল পেতে যাচ্ছে। কেরালা সরকার ৪ জুলাই ঘোষণা দেয়, কর্মীদের বসার অনুমতি দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট শ্রম আইনে সংশোধন আনা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে শ্রম বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আর ঘটতে দেওয়া যায় না। তাই এটাকে আইনি কাঠামোয় আনা হচ্ছে। এতে নারীকে অবশ্যই বসতে দিতে হবে এবং টয়লেটে যেতে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।’ এ নিয়ম ভঙ্গ করলে দোকানের মালিকদের জরিমানার বিধান রাখা হচ্ছে আইনে।

পাশের কর্ণাটক রাজ্যের ট্রেড ইউনিয়নের নেতা মৈত্রেয়ী বলেন, এটা শুধু কেরালা নয়, অন্য রাজ্যগুলোতেও একই অবস্থা। তিনি বলেন, এটা এতটাই মৌলিক ব্যাপার যে একজন মানুষকে কখন বসতে হবে বা কখন টয়লেটে যেতে হবে বা কখন পানি খেতে হবে—এ জন্য আইনের প্রয়োজন হওয়ারই কথা নয়।

বাণিজ্যিক এই খুচরা দোকানগুলোতে নারী বিক্রয়কর্মীর সংখ্যাই বেশি। অথচ তাঁদের আইনি সুরক্ষা নেই। কাজের জায়গাও বেহাল। নগণ্য বেতন। সুযোগ-সুবিধাও সীমিত। মাত্র ৭ শতাংশ ভারতীয় কর্মক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা পান।

৪৩ বছর বয়সী মায়া দেবী জানান, তিনি চাকরি করার সময় স্বাস্থ্যবিমা বা পেনশনের মতো কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাননি। বেতন বাড়ানো ও সুযোগ-সুবিধার দাবি নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে তিনি ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টা করেন। এ কারণে ২০১৪ সালে তাঁকে চাকরি হারাতে হয়।
মায়া দেবী জানান, ‘রাইট টু সিট’ বা বসার অধিকার আন্দোলনের নেতা ভিজি পালিথোড়ি (৪৮) ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা। তাঁকে দেখেই নিজের অধিকার লড়াইয়ে নেমেছিলেন।

ভিজি পালিথোড়ির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘বসার অধিকার’ আন্দোলন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
ভিজি পালিথোড়ির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘বসার অধিকার’ আন্দোলন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ভিজি পালিথোড়ি ১৬ বছর বয়সে দরজির দোকানে কাজ শুরু করেন। নারী কর্মীদের এমন যাতনার কথা শুনে তিনি কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০০ সালের শুরুতে তিনি এমন কর্মীদের নিয়ে সভা করা শুরু করেন।
নারী কর্মীদের কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে পালিথোড়ি বলেন, গরমের সময়েও একটু পানি পান করারও সুযোগ পান না বলে জানিয়েছিলেন নারীরা। টয়লেটে যেতে না পেরে তাঁদের নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগতে হতো। এসব কষ্টের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়তেন ওই নারীরা। অনেক নারী অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের বসতে দেওয়া হয় না।
তিনি বলেন, ক্লোজড সার্কিট (সিসি) টিভি ক্যামেরার মাধ্যমে দোকানের ব্যবস্থাপকেরা নজরদারি করতেন। ক্যামেরায় কোনো নারীকে বসতে দেখা গেলে তাঁর বেতন কেটে নেওয়া হতো। এমনকি দোকানে ওই মুহূর্তে কোনো ক্রেতা না থাকলেও তা করা হতো। কিছু নারী এমন অভিযোগও করেছিলেন, দোকানের ব্যবস্থাপক ও মালিকেরা তাঁদের এমনও বলতেন, টয়লেটে যাওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন হলে আন্ডারওয়্যারের সঙ্গে প্লাস্টিকের ব্যাগ যেন তাঁরা বেঁধে নেন। ছোট পানির বোতল নিয়ে দোকানে এলে কোনো কোনো পুরুষ সহকর্মী টিপ্পনী কেটে বলতেন, মূত্র ত্যাগের জন্য হয়তো তাঁরা বোতল নিয়ে আসেন।

পালিথোড়ি বলেন, ‘এসব কথা শুনে নারী কর্মীরা কষ্ট পেতেন। এসব অপমানজনক পরিস্থিতির কারণে ইউনিয়ন গঠনের চিন্তাভাবনা করি আমরা।’

২০০৯ সালে তিনি স্থানীয় ভাষায় ‘পেনকুটাম’ বা ‘নারীদের সমাবেশ’ নামে একটি গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। এটাই পর্যায়ক্রমে ট্রেড ইউনিয়নে রূপ নেয়। এখন এটি কেরালার কয়েকটি জেলায় বিস্তৃত হয়েছে।
পেনকুটাম এখন ‘রাইট টু সিট’ বা ‘বসার অধিকার’ আন্দোলনের সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি ভালো বেতন ও কাজের পরিবেশ নিয়ে লড়াই করছে পেনকুটাম।

পালিথোড়ি জানান, আগে দোকানে একজন নারী বিক্রয়কর্মী দিনে ৮-১০ ঘণ্টা কাজ করে এক ডলারেরও কম মজুরি পেতেন। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর কয়েক বছর আগে এটা বেড়ে দৈনিক মজুরি আট ডলার হয়েছে।
তিনি বলেন, বসার অধিকারের বিষয়টিও আইনে অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে ‘মালিক ও কর্মকর্তাদের উদ্ধতপূর্ণ আচরণের কারণে’। এসব নিয়ে অভিযোগ করলে তাঁরা বলতেন, ‘আইনের কোথাও বসতে দেওয়ার কথা লেখা নেই।’

পালিথোড়ি বলেন, শিগগিরই আইনিভাবে কর্মীরা বসার অধিকার পাবেন। তবে এ লড়াই এখনই শেষ হওয়ার নয়। আইনটি কার্যকর হওয়ার পর দেখতে হবে, তা সব জায়গায় বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না। তা না হলে আন্দোলন আবার শুরু হবে।