যুবরাজ সালমানকে যেভাবে দেখেছেন শিক্ষক রশিদ

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের শিক্ষক রশিদ সেকাই। ছবি: বিবিসি
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের শিক্ষক রশিদ সেকাই। ছবি: বিবিসি

সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যা, নারীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপের কারণে আলোচিত-সমালোচিত সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। প্রথম দিকে ইতিবাচকভাবে বিশ্বে নামটি আলোচিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাঁকে নিয়ে নেতিবাচক আলোচনাই বেশি। সেই সালমানকে ছোটবেলা পড়িয়েছেন শিক্ষক রশিদ সেকাই। ১১ বছর বয়সে মোহাম্মদ বিন সালমান ইংরেজির শিক্ষক রশিদ সেকাইয়ের কাছে কিছুদিন পড়েছিলেন। রশিদ সেকাই এখন যুক্তরাজ্যে থাকেন। তিনি জানালেন বিন সালমানের বেড়ে ওঠার নানান কথা। তাঁর মুখেই শোনা যাক সালমান সম্পর্কে।

জেদ্দার আল-আনজেল স্কুলে শিক্ষকতা করতেন রশিদ সেকাই। ১৯৯৬ সালে একদিন হঠাৎ রাজপরিবার থেকে তাঁর ডাক এল, রাজপরিবারের সন্তানদের ইংরেজি পড়াতে হবে। ডেকে পাঠান তৎকালীন যুবরাজ (বর্তমান বাদশাহ) সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ। তিনি তখন রিয়াদের গভর্নর। সৌদের সন্তানদের প্রাসাদে গিয়ে পড়ানোর জন্যই তলব করা হয় রশিদ সেকাইকে। সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ সে সময় জেদ্দায় থাকতেন। যুবরাজের প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের ইংরেজি পড়ানোর ভার পড়ল রশিদের ওপর। তাঁরা হলেন প্রিন্স তুর্কি, প্রিন্স নায়েফ, প্রিন্স খালিদ ও প্রিন্স মোহাম্মদ।

রশিদ সেকাই বলেন, ‘আমি রিয়াদের একটি ফ্ল্যাটে থাকতাম। একটি গাড়ি এসে আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে যেত। প্রিন্সদের পড়া শেষে দুপুরের পর আমাকে আমার বাসায় আবার রেখে যেত ওই গাড়িতে করে। প্রাসাদে সব সময় অনেক নিরাপত্তাকর্মী সজাগ থাকতেন। আশপাশে অনেকেই সাদাপোশাক পরে থাকতেন। আমি সেখানে জীবনে প্রথমবারের মতো দামি গাড়ি দেখি। গোলাপি রঙের একটি ক্যাডিলাক দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই।’

যুবরাজ সালমানের ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে রশিদ বলেন, ‘রাজপ্রাসাদের পরিচালক মধ্যবয়স্ক মনসুর আল শাহারি প্রিন্সদের পড়ানোর ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন। তখন দেখেছি, ১১ বছরের সালমান তাঁর খুব কাছের ছিল। প্রিন্স মোহাম্মদ ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়। তাই তাকে শাসন করা হতো খুব কম। পড়াশোনার চেয়ে খেলাধুলাতেই মন বেশি ছিল তার। সে পড়াশোনার চেয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করত। নিজে ধরা না দিলে তাকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল ছিল। শিক্ষার্থীদের মাঝেমধ্যে ওয়াকিটকি ব্যবহার করে পড়াতে হয়েছিল। ওয়াকিটকিতে মোহাম্মদ তার ভাই ও প্রহরীদের শুনিয়ে প্রায়ই শিক্ষকের সম্পর্কে তামাশা করত। প্রাসাদের চারদিকে সিসি ক্যামেরা ছিল। সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরসূরির নিরাপত্তায় কোনো অবহেলা ছিল না। অনেকেই নজর রাখছে বলে গুটিসুটি হয়েই পড়াতাম। আমি প্রিন্সদের পড়াচ্ছি, এটা ভেবে কিছুটা নার্ভাস থাকতাম।’ তবে কিছুদিন পরই মোহাম্মদ ও তাঁর ছোট ভাই তাঁকে পছন্দ করতে শুরু করেন।

সেই সালমানের বয়স এখন ৩৩। তিনি দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সৌদির ভবিষ্যৎ শাসক। গত বছর রাজসিংহাসনের পরবর্তী উত্তরসূরি ঘোষণা করা হয় সালমানকে। এর আগ পর্যন্তও যুবরাজ সালমান সম্পর্কে বিশ্ব কিছুই জানত না।

রশিদ সেকাই বলেন, ‘পড়ানোর ফাঁকে একদিন মোহাম্মদ বলল, তার মা বলেছে সে নাকি “সত্যিকারের ভদ্রলোক”। তবে কোনো দিনই রাজপ্রাসাদের কোনো নারীর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কারণ সৌদি নারীরা কখনোই অপরিচিত কারও সামনে আসেন না।’

জামাল খাসোগি হত্যার পরই মোহাম্মদ বিন সালমানকে নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা বেশি। ছবি: বিবিসি
জামাল খাসোগি হত্যার পরই মোহাম্মদ বিন সালমানকে নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা বেশি। ছবি: বিবিসি

মনসুর আল-শাহারি একদিন জানান, ভবিষ্যতের বাদশাহ সন্তানদের পড়াশোনায় কার কী অগ্রগতি তা জানতে সব শিক্ষকের সঙ্গে বসতে চান। রশিদ ভাবলেন, এটাই সুযোগ, তিনি মোহাম্মদের অমনোযোগিতার কথা তাঁর বাবাকে বলবেন। আর শিক্ষকের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই তিনি যে বেয়াদবি করেন, সেই নালিশও জানাবেন। তবে যুবরাজ সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই পরিস্থিতি পুরো বদলে গেল। সব গৃহশিক্ষক মাথা নত করে উঠে দাঁড়ালেন। একে একে সব শিক্ষক তাঁকে কুর্নিশ করলেন। রাজকীয় রীতি মেনে তাঁর হাতে চুম্বন করলেন। রশিদ বলেন, ‘সেদিন কুর্নিশ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণের জন্য আমি মূর্তির মতো হয়ে গেলাম। যুবরাজের হাতে চুম্বন না করে তার সঙ্গে করমর্দন করি। সেও সৌহার্দ্যের হাসি হেসে আমার সঙ্গে কথা বলে।’ তবে সেদিন মোহাম্মদের বিষয়ে নেতিবাচক কিছুই বলতে পারেননি শিক্ষক রশিদ। পরে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রাজকীয় রীতি না মানার কারণে মনসুর আল শাহারি পরে রশিদকে কিছুটা ভর্ৎসনা করেছিলেন।

প্রিন্স মোহাম্মদ ছাড়াও প্রিন্স খালেদকেও পড়িয়েছেন শিক্ষক রশিদ। খালেদ এখন যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত। তথ্যসূত্র: বিবিসি