হুয়াওয়েকে আটকে দিয়ে খাল কেটে কুমির আনছেন ট্রাম্প?

চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের নামে টেক জায়ান্ট হুয়াওয়েকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রযুক্তির দিক থেকে চাপে ফেলা হচ্ছে চীনকে। সি চিন পিংয়ের দেশ অনেক দিন ধরেই নিত্যনতুন প্রযুক্তি কবজা এবং প্রয়োজনে সেগুলো আরও উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ছবি: এএফপি
চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের নামে টেক জায়ান্ট হুয়াওয়েকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রযুক্তির দিক থেকে চাপে ফেলা হচ্ছে চীনকে। সি চিন পিংয়ের দেশ অনেক দিন ধরেই নিত্যনতুন প্রযুক্তি কবজা এবং প্রয়োজনে সেগুলো আরও উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ছবি: এএফপি

চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের নামে টেক জায়ান্ট হুয়াওয়েকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বেশ বিপদেও পড়েছে হুয়াওয়ে। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া কী হবে? চীনের প্রতি নিষেধাজ্ঞা এক জটিল প্রক্রিয়ায় পুরো বিশ্বের অর্থনীতি ও প্রযুক্তি জগতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তা থেকে রেহাই পাবে না আমেরিকাও। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি খাল কেটে কুমির আনছেন ট্রাম্প?

চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। প্রযুক্তির জগতেও চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্থান চমক জাগানিয়া। অ্যাপল থেকে গুগল—চীনের মক্কেলদের তালিকায় কেউ বাদ নেই। বড় বড় এই প্রতিষ্ঠানের কাছে চীন জনপ্রিয় সস্তা শ্রমের জন্য। বিশ্বের বেশির ভাগ শিল্পই কোনো না কোনোভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। নিজেদের মিত্রদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে একঘরে করতে চাইছে। তা আদৌ সম্ভব হবে কি না, সেটি অনিশ্চিত। কিন্তু চীনকে একঘরে করার চেষ্টাতেও বিপদে পড়তে চলেছে বৈশ্বিক অর্থনীতি, বিশেষ করে প্রযুক্তি ব্যবসা।

আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫ মে হুয়াওয়েকে যুক্তরাষ্ট্রে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করে ট্রাম্প প্রশাসন। সরকারি অনুমোদন ছাড়া মার্কিন সংস্থা থেকে প্রযুক্তিসেবা নেওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায় হুয়াওয়ের। এরপরই অবশ্য এই বিধিনিষেধ ৯০ দিনের জন্য শিথিল করে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ। ততক্ষণে গুগল জানিয়ে দিয়েছে, আর হুয়াওয়েকে সেবা দেবে না। একই পথ অনুসরণ করছে মাইক্রোসফট, চিপ ডিজাইনার কোম্পানি এআরএম, প্যানাসনিকসহ আরও অনেক কোম্পানি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, হুয়াওয়ের মোবাইল সেটগুলো স্রেফ খেলনায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

গত বছরের এপ্রিলে চীনের হার্ডওয়্যার প্রতিষ্ঠান জেডটিইর ওপর প্রথম আঘাত হেনেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় নিষেধাজ্ঞার চোট সামলাতে না পেরে প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল জেডটিই। পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হলো বাজার ও অর্থনীতির ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণের জানান দেওয়া এবং চীনকে দাবিয়ে রাখা। তবে জেডটিইর ক্ষেত্রে যে কৌশল কাজে দিয়েছিল, সেটি হুয়াওয়ের ক্ষেত্রেও কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য শুধু হুয়াওয়ের মোবাইল সেট নয়। সারা বিশ্বে ফাইভ–জি নেটওয়ার্ক বিস্তারের ক্ষেত্রে মূল যন্ত্রাংশ সরবরাহের কাজে এগিয়ে আছে হুয়াওয়ে। ফাইভ–জি মোবাইল নেটওয়ার্কের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পেটেন্ট আছে হুয়াওয়ের দখলে। এই জায়গাতেও নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বিপদে পড়েছে হুয়াওয়ে। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বিপদে পড়েছে হুয়াওয়ে। ছবি: রয়টার্স

ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলছে, আদতে বাণিজ্যযুদ্ধের নামে ‘প্রযুক্তিযুদ্ধ’ ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পেছনে আছে প্রযুক্তি খাতে চীনের ‘মহাশক্তি’ হয়ে ওঠার ভয়। প্রতীকী অর্থেই বেছে নেওয়া হয়েছে হুয়াওয়েকে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বশক্তিতে ‘গ্রেট’ হিসেবে দেখাতে চাইছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর প্রযুক্তির দিক থেকে চাপে ফেলা হচ্ছে চীনকে। সি চিন পিংয়ের দেশ অনেক দিন ধরেই নিত্যনতুন প্রযুক্তি কবজা এবং প্রয়োজনে সেগুলো আরও উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই জায়গায় বাধা দিতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে চীনের হাতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, রোবটিকস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র।

তবে শুধু হুয়াওয়ে কালো তালিকার একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ বলছে, এই তালিকা আরও লম্বা হবে। এতে যুক্ত হবে হাইকেভিশন। চীনে সংখ্যালঘু উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর নজরদারি চালানোর কাজে সি চিন পিংয়ের সরকারকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকে হাইকেভিশন। এর সঙ্গে সঙ্গে চীনের আরও কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকেও কালো তালিকাভুক্ত করার পরিকল্পনা আছে মার্কিন প্রশাসনের।

চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বিপদে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র নিজেও। ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন ফাউন্ডেশন নামের একটি থিংক ট্যাংক সম্প্রতি জানিয়েছে, রপ্তানির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কারণে আগামী পাঁচ বছরে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রি বিপুল পরিমাণে কমে যেতে পারে। অঙ্কের হিসাবে যা প্রায় ৫৬ বিলিয়ন ডলার। আরেক হিসাবে দেখা গেছে, চীনা প্রতিষ্ঠানের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার হারাতে পারে। চিপ ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশের লাইসেন্স ফি বাবদ চীনা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করত মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো। সারা বিশ্বের অসংখ্য হার্ডওয়্যার প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদনের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল। এই বিশাল বাজারের আর্থিক মূল্য প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। উদাহরণ হিসেবে অ্যাপলের কথা বলা যায়। এই মার্কিন প্রতিষ্ঠানটির লাভের এক-পঞ্চমাংশ আসে চীন থেকে। ট্রাম্পের প্রযুক্তিযুদ্ধে অ্যাপলের লাভের অঙ্ক তাই তরতর করে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

সারা বিশ্বে ফাইভজি নেটওয়ার্ক বিস্তারের ক্ষেত্রে মূল যন্ত্রাংশ সরবরাহের কাজে এগিয়ে আছে হুয়াওয়ে। ফাইভজি মোবাইল নেটওয়ার্কের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পেটেন্ট আছে হুয়াওয়ের দখলে। এই জায়গাতেও নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় আমেরিকা। ছবি: রয়টার্স
সারা বিশ্বে ফাইভজি নেটওয়ার্ক বিস্তারের ক্ষেত্রে মূল যন্ত্রাংশ সরবরাহের কাজে এগিয়ে আছে হুয়াওয়ে। ফাইভজি মোবাইল নেটওয়ার্কের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পেটেন্ট আছে হুয়াওয়ের দখলে। এই জায়গাতেও নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় আমেরিকা। ছবি: রয়টার্স

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সবচেয়ে বড় বিপদে পড়তে চলেছে এশিয়ার অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। মার্কিন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয় বলে ট্রাম্পের দেশের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের মিত্রতার সম্পর্ক আছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের বলছে যে চীনকে বয়কট করতে হবে। ওদিকে এসব প্রতিষ্ঠানের অন্যতম বড় মক্কেল হলো চীন। যেমন: তাইওয়ানের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টিসিএমসি ও ফক্সকন পড়েছে শাঁখের করাতে। আমেরিকা ও চীন—এই দুই দেশেই তাদের মক্কেল আছে। একই অবস্থায় আছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান স্যামসাং। চীনকে ছেড়ে দিলে তাদের গুনতে হবে বিশাল অঙ্কের লোকসান, আর চীনকে ধরে রাখলে ভুরু কোঁচকাচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। অর্থাৎ বিশ্বের অর্থনৈতিক সাপ্লাই চেইনেই একটি বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে যাচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, এর জবাবে কী করবে চীন? অনেক আগ থেকেই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে আসছে চীন। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে চীন প্রযুক্তিগত গবেষণায় নিজেদের পরিস্থিতির উন্নয়নে অধিকতর মনোযোগ দেবে। এই জায়গায় চীনের ব্যাপক ঘাটতি আছে। হয়তো আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে এগিয়ে আসবে চীন। তবে চলমান প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞার তাৎক্ষণিক জবাব দেওয়া যে চীনের জন্য কঠিন, তা সবাই স্বীকার করছেন।

‘ওয়াশিংটন পোস্ট’–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকৃতিতে পাওয়া বিরল ধাতুর উৎপাদনে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে আছে চীন। স্মার্টফোন, ব্যাটারি, ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য প্রযুক্তিপণ্য তৈরিতে প্রয়োজন হয় এই সব বিরল ধাতু। এগুলোর বৈশ্বিক উৎপাদনের ৯০ শতাংশই চীনের অবদান। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার জবাবে বিরল ধাতুর সরবরাহে রাশ টানতে পারে চীন। সে ক্ষেত্রে পুরো প্রযুক্তি খাত ও সামরিক উৎপাদনেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

নিজেদের মিত্রদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে একঘরে করতে চাইছে। তা আদৌ সম্ভব হবে কিনা—সেটি অনিশ্চিত। কিন্তু চীনকে একঘরে করার চেষ্টাতেও বিপদে পড়তে চলেছে বৈশ্বিক অর্থনীতি, বিশেষ করে প্রযুক্তি ব্যবসা। ছবি: রয়টার্স
নিজেদের মিত্রদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে একঘরে করতে চাইছে। তা আদৌ সম্ভব হবে কিনা—সেটি অনিশ্চিত। কিন্তু চীনকে একঘরে করার চেষ্টাতেও বিপদে পড়তে চলেছে বৈশ্বিক অর্থনীতি, বিশেষ করে প্রযুক্তি ব্যবসা। ছবি: রয়টার্স

‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’–এর এক বিশ্লেষণে অবশ্য বলা হয়েছে, প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে চীনের উত্থান সহজ হবে না। কারণ, গবেষণায় এখনো ঢের পিছিয়ে আছে দেশটি। চেষ্টা করলে হয়তো এগিয়ে আসতে পারবে। তবে তার জন্য ১০ থেকে ২০ বছর সময় লেগে যেতে পারে। এখনো নিজস্ব মোবাইল চিপ তৈরিতেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি চীন। হুয়াওয়ে হাইসিলিকন চিপ তৈরি করলেও এটি তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজে অন্য কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল। এমন নির্ভরশীলতা কমানো সহজ কথা নয়। এই উদাহরণ অন্যান্য চীনা প্রযুক্তি কোম্পানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

আদতে প্রযুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে যুক্তরাষ্ট্র, তাতে করে চীনের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার বিকল্প নেই। ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন, এভাবেই বিশ্বে আধিপত্য ধরে রাখা যাবে। কিন্তু এই ধাক্কায় যদি সত্যিই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পথে দৌড়ানো শুরু করে চীন? তখন আমেরিকার ছড়ি ঘোরানো পড়ে যাবে হুমকিতে। শক্তি দেখাতে গিয়ে না আবার আছাড় খেতে হয় ট্রাম্পকে!