ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের পথে পুতিনের রাশিয়া

রাশিয়ায় এখন প্রতিদিন ১০-১২ হাজার করোনা রোগী শনাক্ত। ছবি: রয়টার্স
রাশিয়ায় এখন প্রতিদিন ১০-১২ হাজার করোনা রোগী শনাক্ত। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর এক-তৃতীয়াংশ এবং মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশ যুক্তরাষ্ট্রে। দুই দিক দিয়েই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশের ধারেকাছে কেউ নেই। কিন্তু সংক্রমণের ধারা দেখে মনে হচ্ছে পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যায় অন্যদের টপকে যুক্তরাষ্ট্রের পরের অবস্থানে চলে আসবে রাশিয়া। যদিও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দেশে মৃত্যু এখনো বেশ কম।

করোনায় ট্রাম্প-পুতিনের দেশ নিয়ে বিশ্বে ধারণা অবশ্য বিপরীতমুখী। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আজ এ কথা তো কাল সে কথা বলেন। সময় পেয়েও প্রস্তুতিতে হেলাফেলার অভিযোগ রয়েছে তাঁর প্রশাসনের বিরুদ্ধে। আর লকডাউনের বিধিনিষেধ মানতে মার্কিনদের অনীহা তো আছেই। এসবেরই মূল্য দিচ্ছে দেশটি।

কিন্তু রাশিয়া নিয়ে বিশ্বের ধারণা ছিল ভিন্ন। ইউরোপের অন্য দেশগুলোয় যখন সংক্রমণ, মৃত্যু লাফিয়ে বাড়ছিল, তখনো এই দেশে করোনার সংক্রমণ ছিল না বললেই চলে। বলা হচ্ছিল, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া, সংক্রমিত ব্যক্তিকে আলাদা করে ফেলা এবং মানুষকে বিধিনিষেধ মানাতে কর্তৃপক্ষের কঠোর মনোভাবের কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু সেই অবস্থা বেশি দিন টিকল না। এখন প্রতিদিন ১০-১২ হাজার রোগী শনাক্ত হচ্ছে দেশটিতে।

করোনা মহামারির সার্বক্ষণিক তথ্য প্রকাশ করছে ওয়ার্ল্ডোমিটারস ডট ইনফো। এই ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে করোনায় সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৪১ লাখ ৫২ হাজারের বেশি মানুষ। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৮২ হাজারের বেশি রোগীর। সুস্থ হয়েছেন ১৪ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি।

করোনা মহামারির শুরুতেই এটি প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিয়েছিল রাশিয়া। স্পুটনিকসহ দেশটির বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, গত ২৪ এপ্রিল রাশিয়া করোনা মোকাবিলায় দেশজুড়ে পরীক্ষা কর্মসূচি শুরু করে। এর আগের দিন ২৩ জানুয়ারি চীনের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয় রাশিয়া। এক সপ্তাহ পর গত ৩০ জানুয়ারি দেশটিতে প্রথম দুজন করোনা রোগী শনাক্ত হন। তাঁরা অবশ্য দুজনই চীনা নাগরিক। এর পরদিন ৩১ জানুয়ারি থেকে চীনা নাগরিকদের রাশিয়া ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। আর ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে তো চীনা নাগরিকদের রাশিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধই করা হয়। প্রথম শনাক্ত হওয়া দুই রোগীকে দ্রুত আলাদা করে চিকিৎসা শুরু করে রুশ কর্তৃপক্ষ। এর ফলে গত মার্চ পর্যন্ত দেশটিতে আর রোগীর সংখ্যা বাড়েনি। কিন্তু ২ মার্চ থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে দেশটিতে। ২৩ মার্চ থেকে পুরো বিশ্বের সঙ্গে আকাশপথে যাত্রী পরিবহন বন্ধ করে দেয় রাশিয়া। এর আগে ১৫ মার্চ থেকে নরওয়ে ও পোল্যান্ডের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয় দেশটি। এই সময় থেকে রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে ট্রেন চলাচলও বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। মার্চের মধ্যেই মস্কোসহ রাশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন আরোপ করা হয়, জারি করা হয় ঘরে থাকার নির্দেশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বন্ধ করে দেওয়া হয় বিনোদনকেন্দ্রগুলো।

করোনা মোকাবিলায় রাশিয়া পরীক্ষা কর্মসূচির ওপর ব্যাপক জোর দিয়েছিল। গত শনিবার পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি মানুষের দেশটিতে পরীক্ষা করা হয়েছে ৫৪ লাখ ৪৮ হাজারের বেশি মানুষকে। অর্থাৎ জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি ১০ লাখে পরীক্ষা করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৩৩৫ জনকে।

এত কিছুর পরও শেষ রক্ষা হয়নি। গতকাল সোমবার রাশিয়ায় শনাক্ত হওয়া করোনা রোগীর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, গতকাল দেশটিতে শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ১২ জন রোগী। এ নিয়ে টানা ৮ দিন রাশিয়ায় দৈনিক ১০ হাজারের বেশি সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। দেশটিতে মোট রোগী রয়েছেন ২ লাখ ৯ হাজার ৬৮৮ জন। রাশিয়ার বেশির ভাগ রোগীই মস্কো বা এর আশপাশের এলাকার। এ কারণে দেশটিতে এরই মধ্যে কিছু এলাকায় লকডাউন শিথিল করা শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।

রুশ কর্তৃপক্ষ গতকাল আরও জানায়, পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় রাশিয়ায় করোনায় মারা গেছেন ৮৮ জন। এ নিয়ে দেশটিতে ১ হাজার ৯১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে সরকারি হিসাবের চেয়ে রাশিয়ায় করোনায় মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি বলে দাবি করেছে দেশটির বিরোধী দলসমর্থিত চিকিৎসকদের একটি সংগঠন।

উল্টো দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন শুরুর দিকে করোনা মহামারিকে গুরুত্বই দেয়নি। এর ফলও ভোগ করতে হচ্ছে দেশটিকে। সিএনএন জানায়, রোববার যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মারা গেছেন আরও ১ হাজার ৪২২ জন। সব মিলিয়ে দেশটিতে মৃত্যু ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে। রোববার নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন সাড়ে ২৫ হাজারের বেশি। এ নিয়ে রোগীর মোট সংখ্যা সাড়ে ১৩ লাখ ছুঁই ছুঁই ছিল।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, করোনায় সংক্রমিত রোগীর সংস্পর্শে আসায় এই মহামারি মোকাবিলায় হোয়াইট হাউসের টাস্কফোর্সের তিন সদস্য কোয়ারেন্টিনে গেছেন। এই তিনজনের অন্যতম হলেন অ্যান্থনি ফাউসি, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক।

বিবিসি জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা করোনা মহামারি মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় তাঁর উত্তরসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের কড়া সমালোচনা করেছেন। ব্যক্তিগত এক কনফারেন্স কলে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে এই মহামারি মোকাবিলার চেষ্টা করেছে, তা এককথায় ‘লেজেগোবরে অবস্থা’।

তবে চীনের বাইরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর যে দেশগুলো নাকাল হয়ে পড়েছিল, সেগুলোর পরিস্থিতির উন্নতি এখনো অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ইতালি ও স্পেন। যুক্তরাজ্যেও মৃত্যু কমে এসেছে। তবে সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে ব্রাজিলে। দেশটিতে রোববার মারা গেছেন ৬৬৪ জন। এ নিয়ে মৃত্যু ১০ হাজার ছাড়িয়েছে ব্রাজিলে। সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে দেড় লাখের বেশি।