মূর্তি নিয়ে আবার জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া বিরোধ

‘চিরস্থায়ী প্রায়শ্চিত্ত’ নামের একটি যুগল মূর্তি নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্ক। ছবি: সংগৃহীত
‘চিরস্থায়ী প্রায়শ্চিত্ত’ নামের একটি যুগল মূর্তি নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্ক। ছবি: সংগৃহীত

ভালো যাচ্ছে না জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্ক। দুই দেশের অমীমাংসিত কিছু সমস্যা নতুন করে আবার সামনে চলে আসায় সাম্প্রতিক এই মনোমালিন্যের সূচনা। জাপানের পক্ষ থেকে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কঠোর করে নেওয়া এবং পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠনে টোকিওকে অভিযুক্ত করে দক্ষিণ কোরিয়ার দাখিল করা আবেদন এই সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটিয়েছে।

গত বছরের শুরুর দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় কোরীয় জনগণকে বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োগ করার জন্য জাপানের কয়েকটি কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বোচ্চ আদালত। জাপান সেই আদেশ মেনে নিতে রাজি হয়নি। তাঁদের ভাষ্য, ১৯৬৫ সালে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সময় স্বাক্ষরিত চুক্তিতে অতীতের সব রকম সমস্যার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এর বাইরে ক্ষতিপূরণের অর্থও জাপান তখন পরিশোধ করেছে। তবে দক্ষিণ কোরিয়া সেই যুক্তি মেনে নিতে নারাজ।

দুই দেশের মধ্যে চলমান বিরোধের আরেকটি কারণ হচ্ছে, যুদ্ধকবলিত জাপানের রাজকীয় সামরিক বাহিনীকে বিনোদন সেবা দেওয়ার নামে কোরীয় তরুণীদের বাধ্যতামূলক যৌন সেবা প্রদানে নিয়োগ করা। সেই নারীদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন। কমফোর্ট উইমেন বা যৌনদাসী নামে সাধারণভাবে তাঁরা পরিচিত। দক্ষিণ কোরিয়ার অভিযোগ, জাপান কখনো অতীতের সেই অপকর্মের জন্য ক্ষমা চায়নি এবং সেই নারীদের ক্ষতিপূরণ দেয়নি। অন্যদিকে জাপান বলছে, এই বিষয়টির নিষ্পত্তি করে নিতে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে মিলে কিছু পদক্ষেপ জাপান গ্রহণ করেছে, যা সমস্যার নিষ্পত্তি করে নিতে জাপানের সদিচ্ছার প্রমাণ তুলে ধরে। তবে দক্ষিণ কোরিয়া তা মনে করছে না।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জটিল একটি বিষয় হলো ইতিহাস। ১৯১০ সাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের সময় পর্যন্ত কোরীয় উপদ্বীপ ছিল জাপানের উপনিবেশ। এতে ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে কোরিয়ায় বেশ কিছু নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ জাপান যে সে সময় নিয়েছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে যুদ্ধোত্তর সময়ে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া উভয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একই প্রভাব বলয়ে চলে এলে অতীতের সেসব বিষয় সাময়িকভাবে চাপা পড়ে যায়। এর বাইরে দক্ষিণ কোরিয়া দীর্ঘকাল ধরে সামরিক শাসনাধীনে থাকায় সামরিক একনায়কেরা নিজেদের স্বার্থে জটিল সেসব বিষয় আড়ালে রেখে দিয়েছিলেন। তবে গত শতকের আশির দশকের শেষ দিকে দক্ষিণ কোরিয়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার পর চাপা দিয়ে রাখা সে রকম অনেক সমস্যা আবারও আলোচনায় উঠে আসতে শুরু করে। সেই সূত্রে দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কে নতুন টানাপোড়েন দেখা দেয়। যৌনদাসী সমস্যা হচ্ছে সেই ধারাবাহিকতার ফসল।

দক্ষিণ কোরিয়ার জনমত শক্তভাবে জাপানি অবস্থানের বিরোধী। আর তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত কোনো সরকারের পক্ষেই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ না নেওয়ার সুযোগ নেই। সরকার এখানে অনেকটাই যেন জনমতের হাতে জিম্মি। দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ যৌনদাসী সমস্যা নিয়ে জাপানের অবস্থান নিয়ে এতটাই বিরক্ত যে কয়েক বছর আগে, একটি নাগরিক গ্রুপ সিউলের জাপানি দূতাবাসের বাইরে যৌনদাসীদের প্রতিনিধিত্বকারী এক বালিকার প্রতীকী এক মূর্তি বসালে নিয়মিতভাবে সেখানে ফুল নিয়ে লোকজনকে আসতে দেখা যায়।

অন্যদিকে জাপানি কর্তৃপক্ষ এটাকে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ পেশ করে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বুসানের জাপানি কনস্যুলেট ভবনের উল্টো দিকের খোলা জায়গায়ও চেয়ারে উপবিষ্ট এক বালিকার মূর্তি বসানো হয়। জাপান এসব পদক্ষেপকে উসকানিমূলক হিসেবে দেখলেও দক্ষিণ কোরিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তা মনে করছে না।

দক্ষিণ কোরিয়ায় মূর্তি বসিয়ে প্রতিবাদ জানানোর প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ‘চিরস্থায়ী প্রায়শ্চিত্ত’ নামের একটি যুগল মূর্তি। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর পিওয়েংচাংয়ের কোরীয় বোটানিকাল উদ্যানে কিছুদিন আগে যা বসানো হয়েছে। এখানেও এক বালিকাকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। তবে বালিকার সামনের একটু দূরে বসানো আছে আরেকটি মূর্তি। একজন পুরুষ যেখানে নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। আপাতদৃষ্টিতে নিষ্পাপ মূর্তি হিসেবে এটাকে দেখা গেলেও পুরুষের দিকে ভালোভাবে চোখ মেলে তাকালে পরিষ্কার হয়ে ওঠে, সেই ব্যক্তি অন্য কেউ নন, বরং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে।

বেসরকারি মালিকানায় পরিচালনাধীন সেই উদ্যানের ব্যবস্থাপক অবশ্য সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, জাপানি নেতার কথা মনে রেখে মূর্তিটি নির্মাণ করা হয়নি। এটি এমন এক শিল্পকর্ম, দক্ষিণ কোরিয়ার অতীতের বেদনাদায়ক একটি অধ্যায় সেখানে ফুটিয়ে তোলা হলেও কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এর পেছনে নেই। তবে জাপান সরকার এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে নারাজ।

দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম অবশ্য বলছে, শিল্পী সেখানে জাপানের প্রধানমন্ত্রীকেই তুলে ধরেছেন। একজন ভাস্করের উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়, তিনি বলেছেন সেই মূর্তিতে যা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, তা হলো জাপান প্রায়শ্চিত্ত প্রত্যাশা করলেই কেবল ক্ষমা প্রদর্শন সম্ভব।

জাপানের চিফ কেবিনেট সেক্রেটারি ইয়োশিহিদে সুগা গতকাল বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ‘চিরস্থায়ী প্রায়শ্চিত্ত’ নামের সেই মূর্তির খবর সঠিক হলে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষতি তা করতে পারে। ফলে সৌজন্যের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য মানের আওতায় দক্ষিণ কোরিয়ার সেই পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার বলছে, বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া কোনো উদ্যোগে হস্তক্ষেপ গণতান্ত্রিক সরকারের অবস্থানের পরিপন্থী, যদিও বিদেশি নেতৃবৃন্দের বেলায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সৌজন্যবোধ মেনে চলার বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হচ্ছে না। তাই ব্যাখ্যাগত বিশ্লেষণ নিয়ে দুই দেশের ভিন্ন অবস্থান জটিলতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং ইতিমধ্যে চিড় ধরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এই মূর্তির বিষয়টি হয়তো আরও বেশি জটিল করে তুলবে। করোনাকালে অঞ্চলজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এটা কারও কাম্য নয়।