স্কুল পালানো ছেলের ইতিহাস!

স্কুলব্যাগে বইয়ের সঙ্গে যত্ন করে তুলতেন গুলতি আর মার্বেল। আর টি-শার্ট। স্কুলড্রেসে স্কুল পালালে যে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি! তাই টিফিন পিরিয়ডেই পোশাক পাল্টে স্কুল থেকে দে ছুট। তারপর গুলতি নিয়ে পাখির পেছনে ছোটা আর দিনভর মেতে থাকা মার্বেল খেলায়।

বৃষ্টির মৌসুমে আবার চলত কাঁদায় মাখামাখি হয়ে ফুটবল খেলা। ঘুড়ির মৌসুমে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো। নীল আকাশে লাল ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়ে তিনিও কল্পনার ডানা মেলে দিতেন। লাল ছিল তার প্রিয় রং। স্কুলের ব্যাগ হোক বা গায়ের পোশাক— রং লাল হওয়া চাই। এমনকি ক্রিকেট ব্যাটও!

তখনো সোহাগ গাজী হয়ে ওঠেন নি
তখনো সোহাগ গাজী হয়ে ওঠেন নি

বাবার কাছে আবদার করেছিলেন একটা ব্যাটের জন্য। পুলিশ কর্মকর্তা বাবার পোস্টিং তখন জেলখানায়। কয়েদিদের দিয়ে ছেলের জন্য ব্যাট বানিয়ে নিলেন শাহজাহান গাজী। ছেলের প্রিয় রঙে রাঙিয়েই উপহার দিলেন তাকে। লাল টুকটুকে সেই ব্যাট হাতে পাওয়ার পর স্কুল পালিয়ে ব্যাট-বলের ঠোকাঠুকিই হয়ে গেল সবচেয়ে প্রিয় কাজ। স্মৃতির ডানায় শৈশবের দিনগুলোয় ফিরে গিয়ে গিয়ে লাজুক হাসিতে আজ তাঁর সরল স্বীকারোক্তি, ‘স্কুলে সব ক্লাস করেছি খুব কম দিনই!’

খুলনা শহরে তাঁদের বাসার খুব কাছেই ছিল মঞ্জুরুল ইসলামদের বাড়ি। অভিষেক টেস্টে ছয় উইকেট নেওয়া মঞ্জুরুল তখন তারকা ক্রিকেটার। একবার খবর পেলেন ছুটিতে বাড়ি এসেছেন মঞ্জুরুল। জাতীয় তারকাকে একনজর দেখার জন্য দেয়াল টপকে ঢুকলেন বাড়িতে। কিন্তু দেখা না পেয়ে ফিরলেন হতাশ মনে। খুলনাতেই একবার অনুশীলনে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে পেয়ে সে কী উত্তেজনা তার! সেদিনের সেই কিশোর আজ নিজেই দেশের ক্রিকেটভুবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকাদের একজন। আজ তাঁকে একনজর দেখতে পটুয়াখালীর কলাতলা বাজারের বাড়িতে হাজার লোকের ভিড়। শুধু পটুয়াখালী কেন, সাড়া ফেলে দিয়েছেন সারা দেশে, পুরো ক্রিকেটবিশ্বে। ২০১২ সালের নভেম্বরে টেস্ট ও ওয়ানডে অভিষেকে গড়েছেন দেশের হয়ে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। কয়েক দিন আগে অনন্য এক কীর্তিতে স্থায়ী জায়গা পেয়ে গেছেন ক্রিকেট ইতিহাসে। একই টেস্টে করেছেন হ্যাটট্রিক ও সেঞ্চুরি, যা করতে পারেননি টেস্ট ক্রিকেটের ১৩৬ বছরের ইতিহাসে মাঠে নামা দুই হাজার ৭২৮ জনের আর কেউ। স্কুলপালানো সোহাগ গাজী আজ ক্রিকেট ইতিহাসের অভিজাত এক অধ্যায়ের রচয়িতা!

জাতীয় দলের দরজা পর্যন্ত আসতে পেরোতে হয়েছে বন্ধুর এক পথ। বিকেএসপি বা বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে জাতীয় দলে আসার প্রথাগত স্রোতে ভাসতে পারেননি তিনি, বরং সাঁতার কাটতে হয়েছে প্রতিকূল স্রোতে। সম্ভাবনাময় প্রতিভার তকমায় নয়, জাতীয় দলে আসতে হয়েছে তাঁকে ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্সের জোরে। অনুর্ধ্ব-১৩ থেকে শুরু করে ১৫, ১৬, ১৭—কোনো বয়সভিত্তিক দলেই মূল স্কোয়াডে জায়গা হয়নি তার। সব সময়ই রাখা হয়েছে শুধু স্ট্যান্ড বাই করে। একবার শুধু মালয়েশিয়া সফরের অনূর্ধ্ব-১৭ দলে জায়গা হলো। কিন্তু প্রস্ত্ততি ম্যাচে চোট পেয়ে হতে লাগল ছয়টি সেলাই। পাসপোর্ট-ভিসা হয়ে যাওয়ার পরও হলো না প্রথম বিদেশ সফর। সোহাগসহ পুরো পরিবারের সবার তখন সে কী মন খারাপ! অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আগে প্রস্ত্ততি ম্যাচগুলোয় দারুণ পারফরম্যান্সের পরও যখন বিশ্বকাপ দলে জায়গা হলো না, ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। তবে দ্রতই সেই হতাশা পরিণত হয় জেদে। পণ করেছিলেন, ক্রিকেটের শেষ দেখে ছাড়বেন। সেই জেদের ফলটা আজ দেখতে পাচ্ছে সবাই।

জন্ম পটুয়াখালীতে। বাবার চাকরি সূত্রে ছেলেবেলা কেটেছে খুলনা ও বরগুনায়। বরগুনা জিলা স্কুল, খুলনা কম্বাইন্ড প্রি-ক্যাডেট ও জিলা স্কুলে পড়েছেন। ছাত্র হিসেবে খুব খারাপ ছিলেন না। রোল সব সময় নয়-দশের আশপাশেই থাকত। কিন্তু পড়াশোনা তাঁকে একদমই টানত না। টানা এক-দেড় ঘণ্টা বই নিয়ে বসে থাকাটা তাঁর কাছে ছিল রীতিমতো জুলুম মনে হতো! তাঁকে টানত সবুজ মাঠ, খোলা প্রান্তর। তিন-ভাইবোনের সবচেয়ে ছোট বলে আদর-প্রশ্রয়টাও সব সময় পেয়ে আসছেন সোহাগ।

মা-বাবার সমর্থনটা সব সময় পেয়ে আসছেন ক্রিকেটেও। যখন বারবার বয়সভিত্তিক দলগুলোতে উপেক্ষিত থেকেছেন, যখন ভবিষ্যৎকে মনে হয়েছে অন্ধকার এক সুড়ঙ্গ, তখনো মা-বাবা বলেননি ক্রিকেট ছাড়তে। বরং উৎসাহ দিয়ে গেছেন। আজ তাই মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এখনো প্রতিটি ম্যাচের আগের রাতে ফোনে দোয়া চেয়ে নেন মা-বাবার কাছ থেকে, নইলে বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগে। নিজের জীবনে চাওয়ার খুব বেশি নেই, শুধু বাকি জীবনটা সুখে রাখতে চান মা-বাবাকে। তাঁদের জন্যই পাঁচতলা বাড়ি গড়ে তুলছেন পটুয়াখালীতে। আর সোহাগকে ঘিরে স্বপ্নের সৌধ গড়ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। স্কুলপালানো ছেলেটি না জানি ক্রিকেট-বিশ্বের জন্য জমা রেখেছে আরও কত বিস্ময়!