বিদায় ক্রিকেটের মহানায়ক!

 মারাঠি ভাষার জনপ্রিয় কবি ও সাহিত্যির রমেশ টেন্ডুলকার তাঁর ছেলের নাম রেখেছিলেন প্রিয় এক সুরকারের নামে। কে জানে, কবিমনের অলক্ষ্যে হয়তো স্বপ্ন ছিল, ছেলে একদিন বড় হয়ে সুরের ছন্দ তুলবে। বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ঠিকই। তবে কলম হাতে নয়। পিয়ানোতেও নয়। কবির ছেলে বড় হয়ে কবি হয়েছে সবুজ ঘাসের মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপের মতো ২২ গজের একটা উইকেটে।

সুর-ছন্দ সবই তুলেছে ব্যাট হাতে। শচীনদেব বর্মনের নাম নিয়ে বড় হওয়া সেই ছেলের নাম শচীন টেন্ডুলকার!

শুরুটা যেখানে হয়েছিল, শেষটাও হয়েছে সেখানেই। মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দান কিংবা শিবাজি পার্কের ধুলো মেখে বড় হওয়া টেন্ডুলকারের শেষটা হলো মুম্বাইয়েরই ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে শুরু আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। ২০১৩ সালের নভেম্বরে হলো শেষ। শুরু আর শেষের বিন্দুটা এভাবেই মিলে গিয়ে পূর্ণ হলো বৃত্ত। ১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল নির্মল নার্সিং হোমে জন্মানো মানুষটা পুরো ক্যারিয়ার এক রকম নির্মল-নিষ্কলুষ রেখেই শেষটা টেনে দিলেন।

দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সমান দাপটের সঙ্গে ছড়ি ঘুরিয়েছেন। টেস্ট-ওয়ানডে দুই ধরনের ক্রিকেটেই সবচেয়ে বেশি রান আর সেঞ্চুরির মালিক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি। ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ২০০ টেস্ট খেলার কীর্তি...।

ক্যারিয়ারে শুধু একটাই শূন্যতা ছিল। সেই আজন্ম আরাধ্য বিশ্বকাপটাও জিতে নিয়েছেন গতবার। পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়েই তাই বিদায় জানাতে পারছেন। কিন্তু টেন্ডুলকারের বিদায় কি বিরাট এক শূন্যতার জন্ম দেবে না ক্রিকেটে? ক্রিকেট তাঁর গতিপথ মেনেই চলবে। মাঠে ঠিকই আবার খেলবে ভারত। কিন্তু আর দেখা যাবে না টেন্ডুলকারের ব্যাটিং! ভাবা যায়!

ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান ডন ব্র্যাডম্যান নাকি তাঁর শেষ ইনিংসে এতটাই আবেগের স্রোতে ভেসে গিয়েছিলেন, চোখে বাষ্পরুদ্ধ আবেগ জমা হয়েছিল বলে এরিক হলিসের গুগলিটা বোঝেননি। আউট হয়ে গিয়েছিলেন শূন্য রানে! ব্র্যাডম্যান নিজে এ কথা স্বীকার না করলেও ক্রিকেটীয় গাথায় অমর হয়ে আছে গল্পটা।

ব্র্যাডম্যানের বিদায়ের সঙ্গে টেন্ডুলকারের বিদায়ে মিল থাকল। দুই কালের দুই মহানায়কের যে বিদায় হলো। টেন্ডুলকারের বিদায়েও থাকল একটু আক্ষেপের আঁচ। না, শূন্য নয়, আক্ষেপ অন্য কারণে। একটুর জন্য যে সেঞ্চুরিটা পেলেন না!

টেনিস কিংবদন্তি জন ম্যাকেনরোর ভক্ত ছিলেন। টেনিসটাও খেলতেন ভালোই। তবে বড় ভাই অজিত তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন শিবাজি পার্কে। সেখানকার ক্রিকেট কোচ রমাকান্ত আচরেকারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ছোট ভাইকে। সেই গল্পটা তো এখন ক্রিকেটীয় কিংবদন্তিই হয়ে আছে। রমাকান্ত আচরেকার নেটে ব্যাটিংয়ের সময় স্টাম্পের ওপর এক রুপির একটি কয়েন রেখে দিতেন। যদি কোনো বোলার তাঁকে আউট করতে পারত, সেই কয়েন পেত বোলারটিই। নেটে নট আউট থাকলে কয়েনটি পেত কিশোর টেন্ডুলকার। এভাবে ১৩টি কয়েন জমেছিল তাঁর। একসময় বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রীড়াবিদ হয়ে গেলেও টেন্ডুলকারের কাছে সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল তাঁর এই ১৩টি কয়েনই।

বন্ধু বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে কিশোর শচীন
বন্ধু বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে কিশোর শচীন

এই রমাকান্তের দুই শিষ্য স্কুল ক্রিকেটে বাজিমাত করে দিয়েছিল। টেন্ডুলকার ও বিনোদ কাম্বলি মিলে স্কুল ক্রিকেটে গড়েছিলেন ৬৬৪ রানের জুটি। সেই ইনিংসে ৩২৬ রান করা টেন্ডুলকার বন্ধু কাম্বলিকে নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন। কেঁদেকেটে একসা বোলাররা আর বলই করতে রাজি হয়নি। কাঁহাতক আর এভাবে বল করে করে শুধু মার খাওয়া যায়!

স্কুল ক্রিকেটেই নিজের আগমনী জানান দেওয়া টেন্ডুলকার ১৯৮৮ সালের সেই বিখ্যাত জুটির পরের বছরেই খেলেছেন টেস্ট। মাত্র ১৬ বছর বয়সে টেস্টের কঠিন পরীক্ষায় নেমে পড়েছিলেন। করাচি টেস্টে। সেই সিরিজেই অভিষেক হয়েছিল ওয়াকার ইউনুসের। তরুণ ওয়াকারের বল থেকে যে আগুনের গোলা ছুটে বেরোয়। ওই সফরে ওয়াকারের একটা বাউন্সারে ভূপাতিত হয়েছিলেন টেন্ডুলকার। নাক দিয়ে ঝরেছিল রক্ত। ওয়াকার যেন বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, ‘ওয়েলকাম টু দ্য টেস্ট ক্রিকেট।’ সেই বাউন্সারে আহত হওয়ার পরের বলটাই চার মেরে টেন্ডুলকারও পাল্টা উত্তর যেন দিয়েছিলেন, ‘থ্যাংক ইউ!’

ব্যাট হাতে শিশু শচীন
ব্যাট হাতে শিশু শচীন

সেই কিশোরটাই একদিন বিখ্যাত হয়েছেন ‘লিটল মাস্টার’ নামে! আধুনিক ক্রিকেটের ব্র্যাডম্যান বলে ডাকা হয়েছে তাঁকে। খোদ ব্র্যাডম্যান টেলিভিশনে টেন্ডুলকারের ব্যাটিং দেখে স্ত্রী জেসিকে ডেকে বলেছিলেন, ‘দেখো তো, ছেলেটা মনে হয় আমার মতোই ব্যাট করে!’

শুরুটা অবশ্য আহামরি হয়নি। প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি পেতেও অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৪টি ইনিংস। ওয়ানডের শুরুটা তো হয়েছিল একেবারেই ভয়াবহ। পর পর প্রথম দুই ম্যাচেই শূন্য! কিন্তু সকালের সূর্যটা কি সব সময়ই দিনের সঠিক পূর্বাভাস দেয়?

১৯৯০ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টে। অপরাজিত ছিলেন ১১৯ রানে। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। টেন্ডুলকারের নামে এরপর লেখা হয়েছে একের পর এক রেকর্ড। এসেছে আরও ৯৯টি সেঞ্চুরি! টেন্ডুলকারের শততম সেই সেঞ্চুরিটি কিন্তু বাংলাদেশের বিপক্ষেই। যদিও সেই ম্যাচটা বাংলাদেশের কাছে হেরেই গিয়েছিল ভারত! টেস্টে টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ার-সেরা ইনিংসটিও (অপরাজিত ২৪৮) বাংলাদেশের বিপক্ষেই। বাংলাদেশেই মিনি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। স্মৃতির মণিকোঠায় লাল-সবুজের এই দেশটাকেও নিশ্চয়ই মনে রাখবেন টেন্ডুলকার।

পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যাবে তাঁর ব্যাটিং-কীর্তি নিয়ে। সেসব বরং তোলাই থাক। ভালো ব্যাটসম্যানের চেয়েও টেন্ডুলকার যেন আরও বেশি ভালো একজন মানুষ। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে এত দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বিতর্কের পূতিগন্ধময় পানি লাগতে দেননি শরীরে। ভারতের অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ভুলে যাননি সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার কথা।

স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার সঙ্গে শচীন টেন্ডুলকার
স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার সঙ্গে শচীন টেন্ডুলকার

জীবনের প্রায় পুরোটাই জুড়ে আছে ক্রিকেট। সেই ক্রিকেটকে কতটা ভালোবাসেন, সেই ছবিটা দেখা গেল ১৬ নভেম্বর, বিদায়ের মুহূর্তটি যখন একেবারেই চলে এল। চ-ব্বি-শ বছরের সম্পর্ক! এত সহজেই এক ম্যাচেই, একটা মুহূর্তেই সেই সম্পর্কের শেকড় উপড়ে ফেলা যায়!

বিদায়ী ভাষণ দিলেন। সবাই আবেগে থরথর। কিন্তু কী আশ্চর্য, টেন্ডুলকারের হাসিমুখ! বক্তব্যের শুরুতেই বুঝিয়ে দিলেন তিনি কাঁদতে চান না। দর্শকদের অনুরোধ করলেন আবেগের গর্জন থামাতে। না হলে যে কেঁদেই ফেলবেন। ধন্যবাদের লম্বা ফিরিস্তি দিলেন। সেই ভাষণে কাঁদালেন সবাইকে। কাঁদল গোটা ওয়াংখেড়ে। কিন্তু টেন্ডুলকার? না, তাঁর চোখে পানি নেই! গলা বারবার ধরে আসছে। পানি খেয়ে সামলাচ্ছেন। সেই ফাঁকে সামলে নিচ্ছেন উথলে আসা আবেগের জলও।

গোটা মাঠ সতীর্থদের কাঁধে চড়ে চক্করও দিলেন। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, ভেতরে কী ভীষণ উথালপাতাল আবেগের ঢেউ। কিন্তু চোখে জল নেই!

মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগমুহূর্তে উইকেটকে সালামও করে এলেন। যেন বললেন, ‘ধন্যবাদ!’

এরপর এল সেই মুহূর্ত। এবার মাঠ ছেড়ে বেরোতে হবে। শেষবারের মতো ক্রিকেটার টেন্ডুলকারের মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া। নাহ, এবার আর পারলেন না। হু হু কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মাথায় পরা বড় পানামা টুপিটাও আড়াল করতে পারল না সেই কান্না!

টেন্ডুলকারের ব্যাটিং ক্যারিয়ার

 

ম্যাচ

ইনিংস

রান

সর্বোচ্চ

গড়

১০০/৫০

টেস্ট

২০০

৩২৯

১৫৯২১

২৪৮*

৫৩.৭৮

৫১/৬৮

ওয়ানডে

৪৬৩

৪৫২

১৮৪২৬

২০০*

৪৪.৮৩

৪৯/৯৬

টেন্ডুলকার বিচিত্রিতা

·   ডান হাতে ব্যাটিং-বোলিং করলেও টেন্ডুলকার কিন্তু লেখেন বাঁ হাতে!

 ·  ১৯৮৭ বিশ্বকাপে ভারত-ইংল্যান্ড সেমিফাইনালে বলবয় ছিলেন টেন্ডুলকার। তাঁর কাজ ছিল বাউন্ডারিতে বল গেলে কুড়িয়ে মাঠে ফিরিয়ে দেওয়া।

 ·  ভারতের তিহার জেলের একটি ওয়ার্ডের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে!

 ·  ক্রিকেটে থার্ড আম্পায়ারের দেওয়া আউটের অভিষেক হয়েছিল টেন্ডুলকারকে দিয়েই।

 ·  বিমানচালনা সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে গ্রুপ ক্যাপ্টেনের র‌্যাঙ্ক পেয়েছেন টেন্ডুলকার।

 ·  টেন্ডুলকার ব্যাটসম্যান হলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২০০ উইকেটও কিন্তু আছে তাঁর!

 ·  আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০০টি সেঞ্চুরি পেয়েছেন। সংখ্যাটা চোখ কপালেই তুলে দেয়। কিন্তু টেন্ডুলকার সেঞ্চুরি পেতে পারতেন আরও ২৮টি! সেঞ্চুরি থেকে একটু দূরে, নব্বইয়ের ঘরে এই ২৮ বার থেমে যেতে হয়েছে তাঁকে!

 ·  এই যে এত এত রেকর্ড, সেই টেন্ডুলকারের ওয়ানডে শুরুটা কেমন ছিল জানো? প্রথম দুই ম্যাচেই মেরেছিলেন টানা দুটো শূন্য!