প্রিয় জাফর ইকবালের জন্মদিনে
ওল্ড ডিওএইচএস এলাকাটার ঠিক সামনেই রেললাইন। একটু পরপরই ছুটে যায় ট্রেন। এটা প্রতিদিনের ঘটনা। কিন্তু গত ২৩ ডিসেম্বরের ঘটনা ছিল অন্য রকম। সকাল ১০টায় ওল্ড ডিওএইচএসের নিরাপত্তাকর্মীরা অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, কিছুক্ষণ পর পর এলকার গেটে এসে একজন দুজন করে জড়ো হচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা। গেটের পাশেই ছোটখাটো একটা ‘কিশোর মেলা’র মতো তৈরি হয়ে গেল। নিরাপত্তাকর্মী কিছুই বুঝতে পারলেন না। পারার কথাও না। শীতের সকালে লেপের নিচ থেকে জোর করেও বাচ্চাদের ওঠানো যায় না, সেখানে এত কিশোর ছেলেমেয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে—অবাক হওয়ারই কথা। নিরাপত্তাকর্মীরা তো আর জানতেন না যে ২৩ ডিসেম্বর শুধু বছরের ৩৫৭তম দিনই না, ২৩ ডিসেম্বর মুহম্মদ জাফর ইকবালের জন্মদিন। শিশু-কিশোরদের মনে আনন্দের শিহরণ জাগাতে এই একটা নামই যথেষ্ট! সেই প্রিয় মানুষটার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতেই শীত-অবরোধ ভুলে জড়ো হয়েছে সবাই।
ব্যাপারটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। কিশোর আলোর ফেসবুক পেজে জানানো হয়েছিল, জাফর ইকবালের জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে যাবে সবাই। ঘোষণা অনুযায়ী ঠিক ১০টায় সবাই চলে এসেছিল ওল্ড ডিওএইচএসে। ঢাকায় এলে এখানেই থাকেন সবার প্রিয় জাফর ইকবাল। একসঙ্গে এত কিশোর-কিশোরী দেখার অভিজ্ঞতা না থাকায় শুরুতে বোধ হয় ভড়কেই গিয়েছিলেন সেখানকার নিরাপত্তাকর্মী। সবাইকে একপাশে দাঁড়াতে বলে তিনি যোগাযোগ করলেন জাফর ইকবালের সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর সবাইকে চমকে দিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন স্বয়ং জাফর ইকবাল! প্রিয় মানুষকে দেখে সবাই খুশি। খুশির পরিমাণ আরও বাড়াতে শুভেচ্ছা জানাতে আসা প্রায় ৮০ জন কিশোরকে নিয়ে নিজের বাসার দিকে হাঁটা দেন জাফর ইকবাল। জাফর স্যারের পেছন পেছন হাঁটতে থাকে কিশোররাও। এ যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার পেছনে শিশু-কিশোরদের আনন্দ মিছিল!
বাসায় সবাইকে স্বাগত জানান জাফর ইকবালের স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হক। ছিলেন তাঁদের ছেলে নাবিল আর ইয়েশিমও। ড্রয়িংরুমের স্বল্প পরিসরে গাদাগাদি করে ঠিকই বসার জায়গা বের করে ফেলল সবাই। সবার মনে কত প্রশ্ন! কে কার আগে প্রশ্ন করবে, কে আগে জানাবে জন্মদিনের শুভেচ্ছা তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হলো। শেষে সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে বলল, ‘জাফর আংকেল, কেমন আছেন?’ জাফর ইকবাল এবং ইয়াসমীন হকও একসঙ্গে বললেন, ‘ভালো আছি।’ তারপর আবার সবাই চিৎকার করে বলল, ‘জাফর আংকেল, শুভ জন্মদিন!’ তারপর জোরে হাততালি।
এরপর পরিচয় পর্ব। সবাই একে একে বলল নিজের নাম। পরিচয় পর্ব শেষে জাফর ইকবালকে নিয়ে এক কিশোর বন্ধুর তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি গান মুগ্ধ করল সবাইকে। আরেকজন করল স্বরচিত কবিতা পাঠ। প্রিয় লেখকের সঙ্গে দেখা হবে, এই উত্তেজনায় আগের রাতে ঘুম তো হয়ইনি, উল্টো নাকি অন্ধকারেই ইংরেজিতে গোটা দুয়েক কবিতা লিখে ফেলেছিল সে। দুটো কবিতাই বেশ মনোযোগসহকারে শুনেছেন জাফর ইকবাল। তাঁর ছবি এঁকে উপহার দিল আরেক কিশোর বন্ধু। একজন তো জাফর ইকবালের বেশ কিছু বইয়ের নাম দিয়ে এঁকে এনেছিল জাফর ইকবালেরই ছবি! আরেক বন্ধু উপহার দেয় একটা রুবিকস কিউব। পরে জাফর ইকবাল সেটা এলোমেলো করে তাকে মেলাতে বললে মাত্র ১০ সেকেন্ডের মধ্যেই রুবিকস কিউব মিলিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় সে।
উপহার পর্বের মধ্যেই বড় এক কেক আর কিশোর আলোর পাঠকদের শুভেচ্ছাসংবলিত ব্যানার নিয়ে উপস্থিত হন কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক ও নির্বাহী সম্পাদক সিমু নাসের। তারপর হাততালি আর ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ গানের সঙ্গে কাটা হলো কেক। জাফর ইকবাল সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘এ রকম জন্মদিন আগে কখনো হয় নাই।’
ডাইনিং টেবিলে তখন কেক, মিষ্টি, শিঙাড়া সাজানো হয়ে গেছে। ইয়াসমীন হক সবাইকে খাবার টেবিলে যেতে বললেন। তবে কিশোরদের কি আর সেদিকে খেয়াল আছে? তারা তখন প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নেওয়া আর ছবি তোলাতেই ব্যস্ত। এরই মধ্যে তারা জোরালো দাবি তুলেছে, ‘টুনটুনি আর ছোটাচ্চু’ যেন আজীবন ধরে চলতে থাকে। জাফর ইকবাল মুচকি হেসে বলেছেন, ভেবে দেখবেন। এতে কিশোরদের খুশি বেড়ে গেল আরও বহুগুণে। জাফর ইকবালও আনন্দের সঙ্গেই প্রত্যেকের সঙ্গে ছবি তুললেন, অটোগ্রাফে ভরিয়ে দিলেন সবার খাতা। সেই সঙ্গে সবাইকে ভালোভাবে পড়াশোনাও করতে বললেন।
কয়েক ঘণ্টা যেন চোখের পলকেই ফুরিয়ে গেল। যেতে ইচ্ছা করছিল না কারোরই। কিন্তু কী আর করা, যেতে তো হবেই। প্রিয় লেখকের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আনন্দের স্মৃতি নিয়েই বাড়ির পথ ধরল সবাই। মুহম্মদ জাফর ইকবালও কাটিয়েছেন অন্য রকম এক জন্মদিন।