পুরস্কার পাঁচ হাজার টাকা

বুলেট ভাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার পরীক্ষায় ফার্স্ট হবে।

ফার্স্ট হতে গেলে পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেতে হয়। বুলেট ভাই সাধারণত সবার চেয় কম নম্বর পায়, কোনো কোনো সময় একদম পায়ই না। কাজেই তার ফার্স্ট হওয়ার প্রশ্নই নেই। তবু এই নিয়ে কিছুদিন মেতে থাকা যাবে বলে উৎসাহ দিতে শুরু করলাম, ‘যাক, এত দিনে তুমি একটা ভালো কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলে...।’

বুলেট ভাই তেল গায়ে না মেখে বরং খেপে গেল, ‘এত দিনে ভালো কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম, এর মানে কী? আমি কি এত দিন শুধু খারাপ কাজ করে এসেছি? বল আমি কি এতকাল শুধু খারাপ কাজ করেছি?’

‘না, তা বলছি না।’

‘তা-ই তো বলছিস। বাংলায়ই তো বলছিস। ইংলিশ বললেও অবশ্য সমস্যা নেই। আমি ফার্স্ট হওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছি। এখন ইংলিশও পারব।’

আমাদের মধ্যে শফিকটা একটু বোকা প্রকৃতির। বুঝে না-বুঝে বুলেট ভাইয়ের সঙ্গে লাগালাগিতে চলে যায়। বলল, ‘বুলেট ভাই, আমি বুঝলাম না হঠাৎ তোমার মাথায় এমন ভীমরতি এল কেন?’

ভীমরতি শব্দের অর্থ বুলেট ভাইয়ের কাছে ঠিক পরিষ্কার নয়। একটু থতমত খেয়ে বলল, ‘কী শব্দ বললি? বাংলায় বল।’

‘বাংলায়ই তো বলছি। তোমার এমন ভীমরতির মানে কী?’

বুলেট ভাই তাড়াতাড়ি করে টেবিলের তলা থেকে একটা মোটাসোটা বই বের করল। অভিধান। পাতা ওল্টাতে লাগল খুব মনোযোগ দিয়ে।

শফিক বলল, ‘এই একটা শব্দ পারো না। আবার হবে ফার্স্ট? ফার্স্ট হওয়া মানে বোঝো?’

বুলেট ভাইয়ের অবশ্য এ দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় এখন নেই। অভিধান দেখার কাজটা খুব সহজ নয়। বুলেট ভাইয়ের মতো মানুষের জন্য তো ভীষণ কঠিন। প্রথমত, ওই অক্ষরের পাতাগুলো খঁুজে বের করতে হয়। ‘ভ’ আবার খুব সহজ অক্ষরও নয়, কোথায় আছে জানতে বর্ণমালার ধারাবাহিকতটা মুখস্থ থাকা দরকার। বুলেট ভাই ক্লাস থ্রি থেকে প্রতিবছর একবার করে ফেল করে আসছে। এ জন্যই সে এখন ক্লাস এইটে আমাদের ক্লাসমেট, নইলে এত দিনে কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ার কথা। সেই বুলেট ভাই অভিধান ঘেঁটে ‘ভ’ বর্গ খুঁজে বের করবে আর ভীমরতি শব্দের অর্থ জেনে যাবে—হতেই পারে না। অসম্ভব।

কিন্তু এমন মনোযোগ যে খুব কিছু বলতেও পারছি না। নান্টু সাহায্য করতে একটু এগিয়েছিল। বুলেট ভাই চড় দেওয়ার জন্য এমন বিপজ্জনকভাবে হাত বাড়াল যে নান্টু হাত জোড় করে ফিরে এসেছে।

বুলেট ভাইয়ের অভিধান দেখা চলছে। এদিকে আমরা সব বাংলা পাঁচের মতো মুখ করে বসে আছি। ভয়ও হচ্ছে। বুলেট ভাই যদি এভাবে পড়াশোনা নিয়ে মেতে থাকে, তাহলে আগামী কিছুদিন একেবারে নিরামিষ যাবে। বুলেট ভাই আমাদের সব উত্তেজনার উৎস। বুলেট ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা ভূত দেখতে বের হই। বুলেট ভাই আছে বলে হেডস্যারের অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে প্রতিবাদ করি। এখন বুলেট ভাই পড়াশোনা নিয়ে এভাবে মেতে গেলে আমাদের এসব অ্যাডভেঞ্চারের কী হবে!

শফিকও বোধ হয় এ রকমই ভাবছে। মোলায়েম গলায় বলল, ‘বুলেট ভাই, বাদ দাও না। তোমার ফার্স্ট হওয়ার তো দরকার দেখছি না।’

‘তুই দরকার দেখবি কেন? আমি তো তোর জন্য ফার্স্ট হতে চাইছি না।’ বুলেট ভাই বই থেকে চোখ না সরিয়েই বলে।

‘তুমি তো যা করো আমাদের জন্যই করো। আমাদের নিয়েই করো।’

স্বীকৃতি পেয়েই কি না বুলেট ভাই একটু হাসল। কিন্তু হাসির মধ্যে যেন একটা রহস্য আছে। বলল না কিছুই।

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘বুলেট ভাই, ফার্স্ট হওয়া অত্যন্ত ছোট কাজ। তুমিই না বলতে, ওগুলো শোভনদের মতো পুতুপুতু ছেলেরা করবে। আমরা করব বড় কাজ। জাতির জন্য, দেশের জন্য, সমাজের জন্য, বিশ্বমানবতার জন্য।’

গলায় প্রয়োজনীয় আবেগ ঢেলে দিয়েছিলাম। বুলেট ভাইও চোখ তুলে তাকাল। তারপর বলল, ‘চল।’

‘কোথায়?’

‘বিশ্বমানবতার জন্য কাজ করতে।’

বিশ্বমানবতা বলতে ঠিক কী বোঝায় আর তার জন্য কাজ করতে কোথায় যেতে হয় আমরা ঠিক জানি না। তবু চললাম। বুলেট ভাই যখন যাচ্ছে তখন বিশ্বমানবতার কাছে নিয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে।

রাস্তায় বেরিয়েই বলল, ‘সবাই পকেটে হাত দে।’

‘পকেটে হাত কেন?’

‘যার যত আছে বের কর।’

‘টাকা?’

‘তাহলে আর কী? তোদের পকেটে তো আর সোনা থাকবে না। টাকাও থাকবে দুই-চারটা করে। তা-ও বের কর।’

শফিক বলল, ‘বুলেট ভাই, আমার না পকেট একেবারে খালি। সকালে আসার সময় পথে দেখলাম একজন ভিক্ষুক। বলল, কয়েক দিন খায়নি। দিয়ে দিলাম। আমরা তো রোজ খাই। বেচারা তিন দিন খায়নি!’

বুলেট ভাই হেসে বলল, ‘নান্টু, তোর ঘটনাটা বল’

নান্টু বলল, ‘বিশ্বাস করবে কি না জানি না কিন্তু আমি আজ ভুল প্যান্ট পরে বেরিয়ে এসেছি। তোমার এখানে আসছি, যা-তা প্যান্ট পরে তো আসা যায় না। ইস্ত্রি করা নতুন প্যান্ট পরেছি, ওদিকে মানিব্যাগটা রয়ে গেছে পুরোনো প্যান্টে। মানে কাল যে প্যান্ট পরেছিলাম। বলো তো দৌড় দিয়ে গিয়ে নিয়ে আসি।’

‘দৌড় দিয়ে গেলে তুই আর আসবি না।’

‘তা হয়তো আসব কিন্তু টাকাটা পাওয়া যাবে কি না কে জানে। আমার বাসায় নতুন বুয়া এসেছে, ও কাপড় ধুয়ে দেওয়ার ব্যাপারে এক নম্বরের ওস্তাদ। হয়তো এরই মধ্যে আমার প্যান্টটা ধুয়ে ফেলেছে।’

‘প্যান্ট ধোয়ার সঙ্গে টাকার কী সম্পর্ক?’

‘আরে জানো না, এক নম্বরের বেখেয়াল। প্রায়ই টাকাসহ প্যান্ট ধুয়ে ফেলে। ধোয়ার আগে যে পকেট চেক করা দরকার এটা বোঝেই না। গত সপ্তাহে তো বাবার পকেটের তিন হাজার টাকা ধুয়ে একেবারে ইস্ত্রি করে নিয়ে এসেছে।’

‘তোর টাকা তাহলে ধুয়ে ইস্ত্রি হয়ে আসবে?’

এবার আমার দিকে ফিরে বলল, ‘ঠিক আছে বোকারাম, তুই কত আছে বের কর। তোর আর আমারটা দিয়েই দেখি বিশ্বমানবতার কোনো উপকার করা যায় কি না?’

শফিক আর নান্টু দুটো গল্প মেরে দিয়েছে। এরপর আর বিশ্বাসযোগ্য কোনো গল্প না থাকায় আমি নিচু গলায় বললাম, ‘বুলেট ভাই, আমার পকেটে বিশ টাকা আছে। কিন্তু...।’

‘কিন্তু টাকাটা খুব দরকার। তুই খাতা কিনবি। তোর অঙ্ক খাতা শেষ হয়ে গেছে।’

‘অঙ্ক না ইংরেজি খাতা।’

‘ও।’

একটু থেমে বুলেট ভাই বলল, ‘এবার তাহলে যা। বিশ্বমানবতার জন্য কাজ করা তো আর হলো না। পকেটে টাকা না থাকলে তো আর মানুষের কোনো উপকার করা যায় না। মনে রাখিস, মানবতার জন্য টাকা লাগে। সবচেয়ে বেশি লাগে পকেটের টাকা খরচের উদারতা।’

আমার তবু একটু জানতে ইচ্ছে হয়েছিল, টাকা দিলে বিশ্বমানবতার কী উপকার হতো কিন্তু শফিক সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটা শুরু করল। পা মিলিয়ে চলল নান্টুও। ফার্স্ট হওয়া, বিশ্বমানবতার জন্য টাকা জোগাড় ইত্যাদি নিয়ে বুলেট ভাই একটা গোলমাল পাকাচ্ছে বুঝলাম কিন্তু বিষয়টা ঠিক পরিষ্কার হলো না।

পরের কয়েক দিন আর বুলেট ভাইয়ের সঙ্গে খুব যোগাযোগ রাখিনি। বিশ্বমানবতার জন্য যদি টাকা চেয়ে বসে! আমাদের টাকার উৎস বলতে মাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কিছু আদায় কিংবা বাজার করতে গিয়ে সুবিধামতো কিছু সরিয়ে ফেলা কিংবা আপার ভ্যানিটি ব্যাগ হাতড়ে সামান্য কিছু হাতড়ানো। এত শ্রম-ঘাম আর বুদ্ধির টাকা বিশ্বমানবতার জন্য ব্যয় করতে বয়েই গেছে। ক্লাসে তাকে দেখেও এমন ভাব করতে লাগলাম যেন বুলেট ভাই আমাদের বিশেষ কেউ নয়। ক্রমাগত ফেল করে আসা হিসেবে তাকে এড়িয়ে চলাই উচিত।

তাই ক্লাসে যখন বাংলা স্যার বললেন, বুলেট ভাইয়ের মগজ আর বানরের বিষ্ঠার সঙ্গে বিশেষ তফাত নেই, তখন খুব প্রাণখুলে হাসলাম। ক্লাসের অন্যদের মতো আমরাও ঠাট্টা-তামাশায় শরিক থাকলাম।

বুলেট ভাইয়ের অপরাধ বাংলা স্যারকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, ভীমরতি শব্দের অর্থ কী?

স্যার শুনে বললেন, ‘ভীমরতির অনেক অর্থ আছে। তবে এখানে যে অর্থটা খাটে সেটা হলো তুই যা করছিস।’

‘আমি যা করি তা-ই ভীমরতি!’

‘ঠিক তাই।’

‘স্যার আমি পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে চাই, এটা কি ভীমরতি?’

স্যার আরেকটু হলে উল্টে পড়ে যাচ্ছিলেন। কোনো রকমে সামলে নিয়ে বললেন, ‘কী বললি? আবার বল।’

‘স্যার আমি এবারের পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে চাই।’

‘আবার বল।’

‘ফার্স্ট হতে চাই। ফার্স্ট।’

‘তুই হবি ফার্স্ট?’

‘হ্যাঁ। আমি। বুলেট। ফার্স্ট হব। এটা আমার চ্যালেঞ্জ। আমি জিতলে কত টাকা দেবেন?’

‘আবার টাকা দিতে হবে?’

‘বেশি না স্যার, পাঁচ হাজার টাকা দেন। ফাইভ থাউজ্যান্ড টাকা অনলি।’

‘স্যার হঠাৎ কী ভেবে বললেন, তোর ফার্স্ট হওয়া লাগবে না। তুই যদি বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পাস, তাহলেই হবে।’

‘তাহলেই পাঁচ হাজার টাকা দেবেন?’

‘আমার অত টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু সত্যিই যদি তুই বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পাস, তাহলে হেড স্যারের সঙ্গে আলাপ করে স্কুল ফান্ড থেকে তোর জন্য পাঁচ হাজার টাকার ব্যবস্থা করে দেব। হলো তো।’

পুরো ক্লাসে তুমুল হাততালি। বুলেট ভাই বেশির ভাগ সময় ফেল করে, মাঝেমধ্যে যা-ও বা দু-একবার পাস করে, সেগুলো স্যারদের দয়ায়। সেই বুলেট ভাই পাঁচ হাজার টাকার চ্যালেঞ্জ করে বসেছে, এটা পুরো ক্লাসের জন্যই একটা দারুণ ব্যাপার। হাততালি আর থামতে চায় না। 

সন্ধ্যাবেলা সবাই বুলেট ভাইয়ের বাসায়। বুলেট ভাই-ই ডেকে এনেছে। ক্লাসের পর আমাকে ডেকে বলল, ‘খেলা কিন্তু জমিয়ে দিলাম।’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘এত দিন তবু গোল্লা পেতে কেউ জানত না, এখন পুরো স্কুলের কাছে নাক কাটা যাবে।’

শফিক বলল, ‘তোমার নাক তো সব সময় কাটা। এবার আমাদেরও নাক যাবে। তোমার সঙ্গে আমরা মিশি এই লজ্জায় আমরা আর মুখ দেখাতে পারব না।’

বুলেট ভাই খেপে না গিয়ে বলল, ‘সন্ধ্যায় বাসায় আয়। সেদিন তো বিশ্বমানবতার জন্য টাকা দিতে হবে বলে পালিয়েছিলি। আজ বিশ্বমানবতার কাজ করার জন্য টাকা পাবি।’

‘তোমার টাকায় ... করি।’ শফিক খুব বাজে একটা কথা বলল।

বুলেট ভাই তবু না রেগে বলল, ‘ঠিক আছে, সেটাই করিস কিন্তু টাকাটা হাতে পেয়ে তো করতে হবে।’

আমার ধারণা ছিল কেউ আসবে না। কিন্তু গিয়ে দেখি আমার আগেই শফিক হাজির। নান্টুও। আমাকে দেখে শফিক একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ‘আসতাম না কিন্তু ভাবলাম একা একা কী ঝামেলা পাকায়। তাই বোঝাতে এলাম।’

বুলেট ভাই অবশ্য শুধু জ্ঞানের কথা বলছে। ‘দশের লাঠি একের বোঝা’, ‘দশে মিলি করি কাজ হারি-জিতি নাহি লাজ’, ‘এসো হাতে হাত রাখি’ এই জাতীয়।

শফিক একসময় বিরক্ত হয়ে বলল, ‘হাতে হাতটাত রাখতে পারব না। তোমার হাতে হাত রাখলে এখন ডেটল দিয়ে হাত ধুতে হবে।’

‘আমার হাতে হাত রাখতে হবে না। এই টাকাটা পকেটে রাখ।’

অবাক হয়ে দেখলাম, একটা ১০০ টাকার নোট শফিকের হাতে চলে গেল।

শফিক ঠিক নিশ্চিত হতে না পেরে টাকাটা উল্টেপাল্টে দেখতে থাকল। আসল না নকল বোঝার চেষ্টা করছে। আসল টাকা নিশ্চিত হওয়ার পর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘তুমি যে কী করো না! খালি ঝামেলা করো। কিন্তু কী আর করা, তবু তোমাকে তো ফেলে দিতে পারি না।’

‘তুই না বলেছিলি টাকায় প্রস্রাব করবি?’

‘কথার কথা বলেছি। আমি আসলে দেখতে চেয়েছিলাম সত্যিই তুমি বিশ্বমানবতার কাজ করার জন্য টাকা দাও কি না?’

‘বিশ্বমানবতা কী?

‘সেটা তো তুমি বলবে। তুমি বলবে আমরা শুনব।’

নান্টু একটু অধৈর্য হয়ে ওঠে। টাকাটা কি শুধু শফিকের জন্য? ফিসফিস করে বলল, ‘পল্টু। আমাদেরও তেত্রিশ টাকা তেত্রিশ পয়সা পাওনা হয়। খেয়াল রাখিস। শফিক কিন্তু কেটে যাওয়ার চেষ্টা করবে। খুব স্বার্থপর ছেলে।’

বুলেট ভাই বলল, ‘তেত্রিশ টাকা তেত্রিশ পয়সা নয়, তোদের দুজনের জন্যও ১০০ টাকা করে। নে ধর।’

এমন হেলাফেলায় দুটো ১০০ টাকার নোট বের করে দিল যে আমার মনে হলো, বুলেট ভাই বোধ হয় আন্তর্জাতিক ছেলেধরা চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। সিনেমায় তো দেখি ওদেরই এমন প্রচুর টাকা। যাকে যত ইচ্ছা দিতে পারে।

আমি ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম, ‘আমাদের কাজটা কী? কী করতে হবে?’

শফিক বলল, ‘কাজের কথাটা শুধু বলে দেখ। তোমাকে ফার্স্ট বানানোর জন্য এই যে সূর্যের দিকে তাকিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম। বলো তো পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্ন চুরি করে আনব। যদি চাও স্যারকে কিডন্যাপ করে এনে তোমাকে হাইয়েস্ট নম্বর পাইয়ে তারপর ছাড়ব।’

বুলেট ভাই বলল, ‘এত কিছু করতে হবে না। আমার বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ তৈরি করতে হবে।’

‘তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ?’

‘ক্লাসে কালকে আমার বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ তৈরি করতে হবে। বিষয়টা হবে এ রকম যে বুলেট হাইয়েস্ট নম্বর পেলে শুধু তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হবে এটা অন্যায়। বরং নিয়ম হওয়া উচিত প্রতি ক্লাসে যে বা যারা এবার বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পাবে কিংবা ফার্স্ট হবে, তাদের সবাইকে এমন পুরস্কার দিতে হবে।’

‘সেটা না হয় বোঝা গেল কিন্তু কাজটা করব কীভাবে?’

‘আমার কাছে তালিকা আছে। প্রতি ক্লাসের ফার্স্টবয়ের কাছে তোরা যাবি। বিদ্রোহের আগুন জ্বালবি। শর্ত দিবি শুধু একটা, টাকা পাওয়ার পর আমার একটা কথা শুনতে হবে।’

‘তোমার শর্তে ওরা রাজি হবে কেন?’

‘এখন রাজি হবে। মানুষ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনায় যেকোনো শর্তে রাজি হয়। এখন বিদ্রোহটা তৈরি করতে হবে।’

‘তাতে তোমার কী লাভ?’

‘বিশ্বমানবতার লাভ।’

মাথামুণ্ডু কিছু বুঝলাম না কিন্তু পরদিন সত্যিই বিদ্রোহ তৈরি করে ফেললাম। পুরো স্কুল একমত। বুলেটকে শুধু পুরস্কার দেওয়া হবে কেন? যে সর্বোচ্চ নম্বর পাবে তাঁকেই পুরস্কার দেওয়া উচিত। প্রয়োজনে কঠোর আন্দোলনের পক্ষেও কেউ কেউ। আমরা ক্লাস-পরীক্ষা সব বর্জন করব—সমীরের এই ঘোষণায় এমন হাততালি শুরু হলো যে আর থামতেই চায় না কেউ।

আমরা নিজেদের কীর্তিতে দারুণ উৎসাহিত। বিদ্রোহ যে এত সহজে তৈরি হয়ে যায় আমাদের ধারণাই ছিল না। ঠিক হয়ে গেল দুপুরের মধ্যে স্কুলের পাঁচ ক্লাসের ফার্স্টবয়ের নেতৃত্বে সবাই যাবে হেডস্যারের কাছে। বলা হবে, বুলেটকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলা স্যার। এটা হতে পারে না। হলে সবার জন্য হবে, সব ক্লাসের জন্য। 

হেডস্যার দাবিটা পড়ে লাফ দিয়ে উঠলেন। এত খুশি যে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। উত্তেজিত হওয়ার বদলে তাঁর গলার স্বর মিষ্টি। চিৎকার করে বাংলার স্যারকে ডাকলেন, ‘আসিফ সাহেব। আসিফ সাহেব।’

বাংলার স্যার এসে দাঁড়াতেই বললেন, ‘আমার ১০০ টাকা দিন।’

‘কিসের ১০০ টাকা?’

‘বাজি ধরেছিলাম না যে একটা ক্লাসে একজনকে এ রকম পুরস্কারের ব্যবস্থা করলে পুরো স্কুল ফুঁসে উঠবে। সবাই চাইবে। বলেছিলাম না!’

‘তা বলেছিলেন।’ বাংলার স্যার একটু বিব্রত হয়ে বলেন।

‘এই যে দেখেন পুরো স্কুলের দাবি চলে এসেছে।’

বাংলার স্যার জমায়েতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাই তো দেখছি।’

‘দিন আমার ১০০ দিন।’

বাংলার স্যারকে সত্যিই বাজির ১০০ টাকা বের করে দিতে হলো। হেডস্যার টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে বললেন, ‘আমি ১০০ টাকা পেলাম। তোমরাও পাবে। কাউকে বঞ্চিত করা হবে না। কালকে আসিফ সাহেবের কাছ থেকে শোনার পর থেকেই আমি ভাবছিলাম আইডিয়াটা মন্দ না। এ রকম একটা পুরস্কার ঘোষণা হলে সবার মধ্যে উৎসাহ তৈরি হবে। আমাদের স্কুলের একটা রেকর্ড হবে।’

বাংলার স্যার ফিসফিস করে বললেন, ‘কিন্তু স্যার, সব ক্লাসে দিতে গেলে ২৫ হাজার টাকা...স্কুল ফান্ডে কি অত টাকা আছে?’

‘আরে স্কুল ফান্ড টাকা দেবে কেন? টাকা দেবে গৌরি সেন। আমি প্রস্তাবটা ম্যানেজমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যানকে দেওয়ার পর থেকে তো তিনি লাফাচ্ছেন। পারলে পরীক্ষার আগে পুরস্কার বিতরণীর ব্যবস্থা করে ফেলেন।’

‘বলেন কী?’

‘কিছু কায়দা করতে হয়েছে। আলু খেয়ে তো আর আপনাদের পেছনে ফেলে হেডমাস্টার হইনি। বোঝালাম, এ রকম একটা জিনিস করলে অন্য সব স্কুলের চেয়ে আমরা এগিয়ে যাব। ওনার নাম হবে সবচেয়ে বেশি। তারপর ডোনেশন আসবে। অনেক টাকা। আগামীবার ছাত্র ভর্তির সময় লালে লাল হয়ে যাব। বেতন বেড়ে যাবে আপনাদের। উনি ইতিমধ্যে স্পনসর হিসেবে দুটো কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে ফেলেছেন।’

‘স্পনসরের সঙ্গেও কথা হয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ। একটা লুঙ্গি কোম্পানি, আরেকজন কাগজের ব্যবসায়ী। আমি অবশ্য কাগজের পক্ষে কিন্তু লুঙ্গি কোম্পানি বেশি টাকা দিতে যাচ্ছে। লুঙ্গি নিয়ে একটু সমস্যায় আছি, এটা ঠিক আভিজাত্যের সঙ্গে যায় না। ওরা দেখা গেল পুরস্কার বিতরণীর দিন এসে এখানে লুঙ্গির মেলা বসিয়ে দিল। না, দুটো পয়সা লস দিয়ে হলেও লুঙ্গি কোম্পানিকে বাতিল করতে হবে।’

হেডস্যার লুঙ্গি কোম্পানিকে বাতিল করা নিয়ে খুব চিন্তিত দেখা যান। ওদিকে কাজ এগিয়ে চলে। পরীক্ষার চেয়ে এবার সেই পুরস্কার বিতরণীর প্রস্ত্ততি নিয়েই স্যাররা মেতে থাকেন। শেষপর্যন্ত কাগজ কোম্পানিই স্পনসর হিসেবে ঠিক হয়েছে। নানা গল্প শোনা যায়। কাগজ কোম্পানির মালিক, তাঁর নাকি সিঙ্গাপুরে বাড়ি আছে। পরীক্ষার পর স্যারদের সবাইকে সস্ত্রীক সেখানে বেড়াতে নিয়ে যাবেন। তুমুল উৎসাহে চলতে থাকে আয়োজন।

আজ আমাদের সেই পুরস্কার বিতরণী। এক ফাঁকে পরীক্ষাও হয়ে গেছে। না, বুলেট ভাই ফার্স্ট হয়নি। ফার্স্ট যাদের হওয়ার কথা তারাই হয়েছে। বুলেট ভাই কী ফল করেছে, সেটা বলে আর বেচারার লজ্জা বাড়াতে চাচ্ছি না। বুলেট ভাই অবশ্য লজ্জিত নয় একটুও। বরং মহাখুশি। অনুষ্ঠানে তাঁকে ছোট্ট একটা বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তার মাধ্যমেই এই দারুণ পরিকল্পনাটার ভিত তৈরি হয় বলে এই আলাদা সম্মান।

এখন সেই বক্তব্য দিতে উঠেছে বুলেট ভাই। আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। কী না কী গোলমাল করে! শেষ মুহূর্তে একটা ঝামেলা পাকানো তার অভ্যাস।

বুলেট ভাই সবাইকে ধন্যবাদ দিতে দিতে বক্তব্য শুরু করল। হাততালিও পড়তে থাকল খুব। হঠাৎ নাটকীয়ভাবে প্রশ্ন করল, ‘এই টাকাটা যে সবাই পাচ্ছে, সেটা তো আমার জন্য। ঠিক কি না?’

সবাই হাততালি দিয়ে জানাল, ‘ঠিক।’

‘তাহলে আমার একটা দাবি। এই পাঁচ হাজার টাকা থেকে সবাই দুই হাজার টাকা করে আমাকে দিয়ে দেবে। তারপরও তিন হাজার টাকা করে থাকবে। এই টাকাটাও তো কম না।’

হেডস্যার মুখ কালো করে বললেন, ‘ঠিক আছে, বুলেট বক্তব্য শেষ করো।’

বুলেট ভাই বলল, ‘না। শেষ করব না। যারা টাকা পাচ্ছে তারা আগে বলেছে আমার শর্তটা মানবে। আমি এখনই জানতে চাই, ওরা আমাকে দশ হাজার টাকা দেবে কি না?’

হেডস্যার উঠে দাঁড়িয়ে মাইক কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘যাও। তুমি যাও। তোমার বক্তব্য শেষ।’

বুলেট ভাই এখন তার ফর্মে চলে গেছে। মাইকটা ফিরিয়ে এনে বলল, ‘বললেই তো আমার বক্তব্য শেষ হবে না। মাত্র তো শুরু।’

এদিকে স্রোতাদের মধ্যে হইচই। ওরা বুলেট ভাইয়ের বক্তব্য পুরোটা শুনতে চায়।

বুলেট ভাই বলল, ‘আমি চাই এর মধ্য থেকে দশ হাজার টাকা। প্রত্যেকে দেবে দুই হাজার করে। আমি কায়দা করে বাংলা স্যারের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে এই টাকার ব্যবস্থা করেছি। নইলে তো কেউ কিছু পেত না।’

পুরস্কৃত যারা তারা মঞ্চে উপস্থিত। বুলেট ভাই ওদের দিকে তাকায়। যদিও প্রত্যেকে আগে আমাদের বলেছিল, টাকা পেলে বুলেট ভাই যা বলবে তাতে রাজি কিন্তু এখন কোনো হেলদোল দেখা যায় না। মনে পড়ল, বুলেট ভাই বলেছিল টাকা পাওয়ার আগে সবাই সব শর্তে রাজি কিন্তু টাকা পেলে আর ছাড়তে চায় না।

শফিক বলল, ‘বুলেট ভাই মান-ইজ্জত ডুবিয়ে দিল। আমি জানতাম ও একটা লোভী।’

কেন যেন কথাটা ঠিক মানতে ইচ্ছে করে না। দশ হাজার টাকা দিয়ে কী করতে চায়! কোনো একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। 

কাগজ কোম্পানির মালিক ভদ্রলোক বললেন, ‘ঠিক আছে। দশ হাজার টাকা ওদের দিতে হবে না। আমি তোমাকে দেব কিন্তু তোমাকে এখানে বলতে হবে এই টাকা দিয়ে তুমি কী করতে চাও। যদি তোমার উত্তর সবার পছন্দ হয় তাহলে তুমি এখনই টাকাটা পাবে।’

বুলেট ভাই বলল, ‘আমি একজনকে দেব।’

‘একজনটা কে?’

বুলেট ভাই একটু যেন থামে। নিচে দাঁড়ানো কেউ একজনের দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘আমাদের স্কুলের দপ্তরি আনোয়ার ভাই। তাঁর ছেলেটা অসুস্থ। দশ হাজার টাকা লাগবে চিকিৎসার জন্য।’

হেডস্যার চিৎকার করে বললেন, ‘সেটা আগে আমাকে বললেই হতো...’

বুলেট ভাই বলল, ‘বলেছিল স্যার। আপনি বলেছিলেন, স্কুল ফান্ডের অবস্থা খুব খারাপ।’

হাসি শুরু হলো জমায়েতে। হেডস্যার বিব্রত ভাবটা সামলে বললেন, ‘হ্যাঁ বলেছিল বটে। আমি ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে আলাপও করেছিলাম। উনি বললেন, এ রকম একজনকে দিলে একের পর এক কেস আসতে থাকবে। পুরো স্কুল ফতুর হয়ে যাবে।’

এবার সবার চোখ ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যানের দিকে। তিনি মিনমিন করে বললেন, ‘আমি চেষ্টা করেছিলাম স্পনসরের জন্য। যোগাযোগও করেছিলাম কিছু কিন্তু রেসপন্স পাইনি। স্পনসররা বলল, একজন দপ্তরিকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারটাকে ঠিক সেভাবে ব্র্যান্ডিং করা যাবে না। তাই...’

হেডস্যার এবার মাইক কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘যাও। বুলেট, তোমার কথা আমরা শুনেছি। যাও।’

বুলেট ভাই নিচে নেমে আসে। দপ্তরি আনোয়ার ভাই এসে হাত ধরে। বুলেট ভাই আড়াল হতে থাকে মাথা নিচু করে।

মঞ্চটা অনেক উঁচু। সেখানে আলোকিত হয়ে বসে আছেন অতিথিরা। ফার্স্টবয়রা। তাদের গর্বিত মা-বাবারা। কিন্তু মাথা নিচু করে আড়ালে হারাতে থাকা বুলেট ভাইয়ের মাথাটাকে ওদের চেয়ে অনেক বেশি উঁচু মনে হয়। 

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী