সাপ-রহস্য

ঘটনা শুরু হলো একটা স্কুলব্যাগ থেকে।

সরদারবাড়ির নবু সরদারের মেজো ছেলে বিলু ক্লাস সেভেনের ছাত্র। তাদের গ্রামের নামে স্কুলের নাম। বনসীমান্ত হাইস্কুল। বনসীমান্ত নামটা শুনলেই মনে হয় বনের ধারে গ্রাম। আসলে বনবাদাড় বলতে কিচ্ছু নেই এলাকায়। একটা খাল চলে গেছে গ্রামের ভেতর দিয়ে। সরদারবাড়িটা খালের ধারেই। ফসলের মাঠ, খোলা আকাশ, মেঠোপথ আর গাছপালায় ঘেরা সুন্দর স্নিগ্ধ গ্রাম। খালপারে কিছু ঝোপ জঙ্গল আছে। ও তো সব খালপারেই থাকে।

বিলুদের স্কুল বেশ পুরোনো। বয়স হবে আশি-নব্বই বছর। এলাকার হিন্দু জমিদাররা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিক্রমপুর এলাকার বেশির ভাগ স্কুলই জমিদার বাবুদের করা। বিলুর মামাবাড়ি কাজির পাগলা নামের এক গ্রামে। লৌহজং উপজেলায়ই পড়েছে। বনসীমান্ত হচ্ছে লৌহজং উপজেলার পুবদিকে আর কাজির পাগলা পশ্চিম-উত্তর দিকে। সেই গ্রামে ১২০ বছরের পুরোনো খুবই বিখ্যাত স্কুল কাজির পাগলা এ টি ইনস্টিটিউশন। এ টি হচ্ছে অভয় তালুকদারের সংক্ষেপ। তার মানে স্কুলের পুরো নাম কাজির পাগলা অভয় তালুকদার ইনস্টিটিউশন।

অভয় তালুকদার ছিলেন ওই এলাকার জমিদার। খুবই শিক্ষানুরাগী মানুষ। ১২০ বছর আগে নিজের নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য। এই তথ্য বিলু জেনেছে তার মন্টু মামার কাছ থেকে।

বিলুদের দুই শরিকের বাড়ি। তার বাবা নবু সরদার আর চাচা রবু সরদার বাড়ির মালিক। বাড়িটা বিশাল। বিক্রমপুর অঞ্চলে বিঘার মাপ নেই। আঞ্চলিক ভাষায় ‘কানি’র হিসাব বলে একটা হিসাব আছে। এক কানি হচ্ছে তিন বিঘার সমান। বিলুদের বাড়ি দশ কানি, অর্থাৎ তিরিশ বিঘা। পনেরো বিঘা করে একেক শরিকের অংশ।

সরদাররা অবস্থাপন্ন। বাড়িতে বড় বড় টিনের ঘর। গোলাঘর, ঢেঁকিঘর, রান্নাঘরও বেশ বড়। কাজের লোকজনদের জন্য ঘর আছে, অতিথিদের ঘর আছে। বাড়িতে অতিথি এলে যে ঘরে প্রথম তাদের বসতে দেওয়া হয় সেই ঘরকে বিক্রমপুর অঞ্চলে বলে ‘বাংলাঘর’।

সরদারবাড়ির বাংলাঘর দুটো দেখার মতো। বাড়িতে ঢোকার মুখে মাঝখানে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা রেখে একই রকম দুটো ঘর। ফাঁকা জায়গায় ফুলের বাগান। বর্ষা-বসন্তে প্রচুর ফুল ফোটে। শীত-গ্রীষ্মেও ফোটে।

বাড়ির থাকার ঘরগুলো সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে সুন্দর। কাঠের রেলিং দেওয়া দোতলা ঘর দুটো ছবির মতো।

সরদারবাড়ির অসাধারণ একটা বৈশিষ্ট্য আছে। বাড়ির প্রতি দুটো ঘর একরকম। নবু সরদারের থাকার ঘর যেমন রবু সরদারের থাকার ঘরও তেমন। নবু সরদারের রান্নাঘর যেমন রবু সরদারের রান্নাঘরও অবিকল তেমন।

এর কারণ আছে। দুভাই হুবহু এক রকম দেখতে। অচেনা লোকে বুঝতেই পারবে না কে নবু সরদার আর কে রবু!

হ্যাঁ নবু-রবু যমজ ভাই। এ জন্য সবকিছুই এক রকম তাদের। চালচলন কথাবার্তা পোশাক-আশাক রুচি। দুভাইয়ের সম্পর্কও চমৎকার। ঝগড়াঝাঁটি মনোমালিন্য বলতে গেলে নেই। বাড়ির বউঝি ছেলেমেয়েরা দুভাইয়ের মিলমিশ দেখে নিজেরাও সেভাবে চলে। বাড়ি দুভাগের হলেও পরিবার যেন একটাই।

মাঠের জমাজমি আর বাড়ির ভাগ-বাঁটোয়ারা কখনো চায়নি দুভাই। সংসার আলাদা হোক তাও চায়নি। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা তো বলা যায় না। তাদের দুভাইয়ের যেমন মিল, ছেলেমেয়েদের মধ্যে তেমন মিল নাও থাকতে পারে। সংসার যত বড় হবে জায়গা সম্পত্তির মালিকও তত বাড়বে। এই ভেবে বিলুর দাদা মতি সরদার বেঁচে থাকতেই জায়গা সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে গেছেন। মাঠের শ-দেড়েক কানি জমি আর বাড়ি। একই দিনে দুই ছেলের বিয়ে দিয়ে বউ এনে দিয়েছেন বাড়িতে।

ছেলেদের বিয়ের সময় অদ্ভুত একটা শখ হয়েছিল তাঁর। প্রথমে পাত্রী হিসেবে যমজ মেয়ে খুঁজেছিলেন। একরকম দুই ছেলের জন্য একরকম দুই বউ। অনেক চেষ্টা করে, বিস্তর ঘটক লাগিয়ে সারা বিক্রমপুর তন্ন তন্ন করে খুঁজে ও রকম মেয়ে জোগাড় করতে পারেননি। কী আর করা! শেষ পর্যন্ত একরকম দুই ছেলের জন্য দুই রকম বউ আনলেন।

একবার ভেবেছিলেন ভালো ঘরের এক বাড়ি থেকেই দুটো মেয়ে আনবেন। আপন দুই বোন হলেও অসুবিধা নেই। ভালো বংশের ও রকম সুন্দরী মেয়ে পেয়েছিলেন মালখানগর গ্রামে। কিন্তু ছেলেরা রাজি হয়নি। সবকিছু একরকম হলেও শ্বশুরবাড়ি একই বাড়ি হোক এটা তারা চায়নি। কারণ হিসেবে দুই ভাই বলেছিল, আমরা চাই বাচ্চাকাচ্চাদের দুটো মামাবাড়ি হোক। তাহলে বেড়ানোর জায়গা বাড়বে।

যুক্তি মন্দ না। ছেলেদের কথামতোই তাদের বিয়ে করালেন মতি সরদার। নবুর শ্বশুরবাড়ি কাজির পাগলা গ্রামে আর রবুর হলো সোনারং। সেই দুই বাড়ির অবস্থাও ভালো। নবুর তিন শ্যালক থাকে জাপানে। জাপানে প্রচুর টাকা। মাসে মাসে লাখ লাখ টাকা পাঠায় তারা। গ্রামে আছে নবুর শ্বশুর-শাশুড়ি আর ছোট শ্যালক মন্টু। তিন শ্যালিকার বিয়ে হয়ে গেছে। তারা থাকে ঢাকায়। জামাইরা কেউ ভালো চাকরি করে, কেউ ব্যবসা। অবস্থা ভালো সবারই।

রবুর শ্বশুর বেঁচে নেই। শাশুড়ি আছেন। সাত ভাইয়ের একমাত্র বোন রবুর স্ত্রী। সবার ছোট। পাঁচ ভাই ব্যবসা-বাণিজ্য আর জায়গা সম্পত্তির দেখভাল করে। দুভাই থাকে আমেরিকায়। তারাও বেশ ভালো অবস্থার। টাকাপয়সার কমতি নেই বাড়িতে।

দুই ছেলের বিয়ে হওয়ার তিন মাসের মাথায় মারা গেলেন মতি সরদার। শক্তপোক্ত তাগড়া জোয়ান মানুষ। দিন পাঁচেক খেটে ছেলেদের জায়গা সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছেন। যেদিন কাজ শেষ হয়েছে সেদিন মন খুব ভালো তাঁর। বিশাল একটা কাজ শেষ করলেন। এখন কয়েক দিন আরাম-আয়েশ করবেন। রাতে খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে ঘুমিয়েছেন, সকালবেলা আর ওঠেন না। ভোরে ওঠা মানুষ। সংসারে স্ত্রী নেই বহু বছর। এত বড় বাড়ি, কাজের লোকজন অনেক। ভোরবেলা উঠে ডাকাডাকি করে তাদের তোলেন। সংসারকর্ম সচল করেন।

সেদিন আর ঘুম ভাঙে না মতি সরদারের। বেলা হয়ে যায়, রোদে ভাসছে উঠোন আঙিনা, ফাল্গুন মাস, বাঁশঝাড় শনশন করছে হাওয়ায়, এমন দিনে এত বেলা পর্যন্ত কিছুতেই ঘুমানোর কথা না সরদারের। নবু-রবু অবাক, বউরা অবাক। একসময় দুই ছেলে ডাকতে শুরু করল বাবাকে।

না, ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ নেই। দরজা বন্ধ।

শেষ পর্যন্ত দরজা ভাঙা হলো। দেখা গেল বিছানায় চিৎ হয়ে আছেন মতি সরদার। দেহে প্রাণ নেই। ধবধবে ফর্সা মানুষটির সারা শরীর ছাইবর্ণ। বাড়ির কেউ বুঝতেই পারল না এ রকম ফরসা মানুষের শরীর মৃত্যুর পর ছাইবর্ণ হয়েছে কেন!

মতি সরদার নামকরা মানুষ। তাঁর মৃত্যুর খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে। গ্রামের লোক ভেঙে পড়ল বাড়িতে। বনসীমান্ত হাইস্কুলের হেডমাস্টার কাশেম সাহেব, জলধর ডাক্তার, নরেন কবিরাজ, নজু ঢালি, হাফেজ ওঝা এ রকম শ্রদ্ধেয়জন সবাই এসেছেন, চেয়ারম্যান-মেম্বাররা এসেছেন, মাতবররা এসেছেন। সাধারণ মানুষজন তো আছেই। মতি সরদারের মৃতদেহ দেখে সবাই অবাক। একই প্রশ্ন সবার। গায়ের রং এমন হয়েছে কেন?

জলধর ডাক্তার বললেন, আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে।

নরেন কবিরাজও বললেন একই কথা। সন্দেহ হচ্ছে।

চেয়ারম্যান মালেক মিয়া মোটা শরীরের। বেশ খানিকটা পথ হেঁটে এসেছেন। ঘামে জবজব করছে শরীর। পরনে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, পায়ে কালো পাম শু, মাথায় টুপি। চেয়ারম্যান সাহেবের সারাক্ষণের সঙ্গী বারেক নামের একজন কাজের লোক। শীত-গ্রীষ্ম নেই, বর্ষা-বসন্ত নেই চেয়ারম্যান যেখানেই যাচ্ছেন বারেক আছে তাঁর সঙ্গে। মাথায় ছাতা ধরে রাখে। গ্রীষ্মকালে এক হাতে ছাতা আরেক হাতে তালপাতার পাখা। বিচার সালিসে যে বাড়িতেই যান চেয়ারম্যান সাহেব, বারেকের কাজ হচ্ছে সেই বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই একটা চেয়ার জোগাড় করা। গ্রীষ্মকাল হলে চেয়ারম্যান সাহেব চেয়ারে বসার পর হাতের তালপাখায় তাঁকে বাতাস করা।

চেয়ারম্যানের মোটা শরীরে বেজায় গরম। শরীরের গরমের সঙ্গে টাকার গরমটা আছে, ক্ষমতার গরমটা আছে। দেশগ্রামের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের চুরির টাকার অন্ত নেই। সরকারি উন্নয়নকাজের কন্টাক্ট নিজের লোক দিয়ে করান। বিশ-পঁচিশ লাখ টাকার কাজে চার-পাঁচ লাখ খরচা করে ওপরঅলাদের ঘুষ দিয়ে বাকিটা ম্যানেজ করেন। অমুকের জমির গণ্ডগোল, তমুকের বাড়ির সীমানা ঠিক করা—এসব কাজেও টাকা আসে দেদার। মিথ্যা মামলায় কাউকে ফাঁসানো, টাকাঅলা কোনো লোককে টার্গেট করে তাকে অযথা একটা ঝামেলায় জড়িয়ে টাকা খাওয়া, টাকা খেতে চাইলে এ রকম বহু পথ খোলা। প্রতিটি পথেরই সদ্ব্যবহার করেন মালেক চেয়ারম্যান। তিনি টাকা খেতে ভালোবাসেন। টাকা তাঁর জীবনের চেয়েও প্রিয়। মতি সরদারের কাছ থেকে বহুবার বহুভাবে খেয়েছেন। আজ এসেছেন তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে। এখানে টাকা খাওয়ার পথ নেই। থাকলে খেয়ে ফেলতেন। কোনো কাজে এসে টাকা পাওয়া যাবে না ভাবলে তাঁর মনটা খারাপ হয়। মতি সরদার মারা গেছেন শুনে যতটা না দুঃখ পেয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখ পাচ্ছেন এই ভেবে যে মতি সরদার এভাবে মারা গেলেন কেন? খুন হয়ে গেলেই তো পারতেন! খুনোখুনির কেস হলে থানা-পুলিশ, নানা প্রকারের দরবাদরবি, চেয়ারম্যানের তখন বিরাট ভূমিকা। সন্দেহের তালিকায় যারা তারা তো আছেই, খুনোখুনির বিন্দুবিসর্গও জানে না এমন দশ-বিশজনের নাম যুক্ত করে দিলেই গোপনে টাকা আসবে। নিরীহ লোকজন প্রথমে এসে হাতে-পায়ে ধরবে, তারপর ধরবে আসল পথ। সেই পথের দিশারি বারেক। চেয়ারম্যান নিজ মুখে বলবেন না কিছুই। ও রকম মক্কেল পেলে বারেক হাতের কাজ ফেলে তাদের ডেকে নেবে আড়ালে। টাকার রফাটা করবে।

এসব কাজের টাকা বারেকের হাত দিয়েই আসে কিন্তু বারেকের ভাগ্যে জোটে না দুপয়সাও। আজ বিশ-পঁচিশ বছর ধরে চেয়ারম্যানবাড়িতে আছে। চেয়ারম্যানের উন্নতি হলো ধা ধা করে। বাড়িতে ঘরের পর ঘর। মাঠে জমির পর জমি। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন বড় ঘরে, ছেলেদের বিয়ে করিয়ে কাউকে দোকান করে দিয়েছেন ঢাকায়, কেউ কন্ট্রাক্টরির কাজ করে গ্রামে, কাউকে পাঠিয়েছেন কুয়েত-কাতারে। এক ছেলে থাকে ইতালিতে। টাকা আসে দশ দিক থেকে। কিন্তু বারেকের জীবনে হলো না কিছুই। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছে অতি দরিদ্রভাবে। বউটা মারা গেল বিনা চিকিৎসায়। একমাত্র ছেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে বাড়িতে। থাকার ঘরটার এমন অবস্থা, কালবৈশাখী এসে মাঝারি সাইজের একটা ধাক্কা দিলেই শুয়ে পড়বে।

চেয়ারম্যান সাহেবকে অনেক দিন ধরে বলছে বারেক, একটা ঘর করে দেন বাড়িতে। আর কিছু চাই না। আমি তো আপনার বাড়িতেই থাকি, ছেলেটা বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে বাড়িতে। ঘরে একটু শান্তিতে ঘুমাক। ঘরে চাপা পড়ে যেন না মরে।

দিচ্ছি দেব করে আজ বছর দুয়েক ধরে ঘোরাচ্ছেন চেয়ারম্যান। একবারের জায়গায় দুবার এককথা বললেই বাজখাঁই গলায় ধমক। সেই ধমকে কলিজা ফেটে যাওয়ার অবস্থা। ঘরের কথা এখন আর বলতেও পারে না বারেক। মনের কষ্ট মনে নিয়ে ছাতা ধরে রাখে চেয়ারম্যানের মাথায়, হাতপাখায় বাতাস করে। সেই বাতাসে কতটা ঠান্ডা হয় চেয়ারম্যানের তাপ, আল্লাহ মালুম।

মতি সরদারের মৃতদেহ রাখা হয়েছে উঠোনে। অদূরে চেয়ারে বসে আছেন চেয়ারম্যান। এই অবস্থায়ও এক কাপ চা এসেছে তাঁর হাতে। ফুরুক ফুরুক করে চা খাচ্ছেন। মুখটা গম্ভীর। গাম্ভীর্যের কারণ, একটা বেলা মাঠে মারা গেল। দুটো পয়সাও এল না হাতে।

চেয়ারম্যানকে ঘিরে আছে চাটুকারেরা। রব মেম্বার, তালেব মেম্বার। মতলেব সিকদার, ননী ঘোষ আর সেন্টু কর্মকার আছে। এই তিনজন গ্রামের মাতবর। চেয়ারম্যানের পোষা লোক। চেয়ারম্যান গম্ভীর হয়ে আছেন দেখে তারাও গম্ভীর।

জলধর ডাক্তার আর নরেন কবিরাজের কথায় মুখ খুললেন চেয়ারম্যান। চা শেষ করে কাপ ফেরত দিয়েছেন বারেকের হাতে। এই ফাঁকে তালেব মেম্বার পানদান ধরলেন তাঁর সামনে। রবুর বড় ছেলেকে বলে পান জোগাড় করেছে সে। চেয়ারম্যানকে সন্তুষ্ট রাখার কায়দা।

চেয়ারম্যান পান মুখে দিয়ে গরুর মতো খচর খচর করে চিবাতে লাগলেন। জলধর ডাক্তার আর নরেন কবিরাজের দিকে তাকিয়ে বললেন, সন্দেহ আমারও হচ্ছে।

তারপর তাকালেন হাফেজ ওঝার দিকে। তোমার কী মনে হয় হাফেজ? আমাদের সন্দেহ ঠিক না বেঠিক?

ওঝা বসে ছিল লাশের পাশে। বলল, জি সাহেব, সন্দেহ ঠিক। সাপেই কেটেছে। ‘কালজাত’ (কালো গোখড়ো) সাপে কেটেছে। তার বিষে সরদার সাহেবের দেহ ছাইবর্ণ হয়েছে। কালজাতের বিষ মারাত্মক। এক ছোবলে যেটুকু ঢালে সেটুকুতে মানুষ তো সামান্য জীব, হাতির দফাও রফা হয়ে যায়। আসামের ওদিককার জঙ্গলে যেসব হাতি আছে সেগুলোর বেশির ভাগই মরে চিৎ হয়ে থাকে কালজাতের কামড়ে।

হাতির কথাটা যে বানানো এটা কেউ বুঝলই না।

গ্রামের সবচেয়ে বয়স্কলোক নজু ঢালি। নব্বইয়ের ওপর হবে বয়স। এখনো বেশ শক্তপোক্ত। লাঠি ছাড়াই চলাফেরা করেন। তাঁর নাতি-নাতনির ঘরের ছেলেমেয়েরাও বড় হয়ে গেছে। এখন আর কাজকর্ম কিছুই করেন না, গ্রামের এবাড়ি ওবাড়ি গিয়ে নিজের বয়সের কাছাকাছি মানুষদের সঙ্গে খোশগল্প করেন, পান তামাক খান, চা খান। বয়সের কারণে দেশগ্রামের বহু ঘটনার সাক্ষী।

নজু ঢালি বসে আছেন উঠোনের পশ্চিম দিককার বকুলগাছটার তলায়। চেয়ারম্যান তাঁকে ডাকলেন, ঢালি সাহেব, আসেন এই দিকে। কথা আছে।

ঢালি এলেন। চেয়ারম্যানের পায়ের কাছে জলচৌকিতে বসেছিল রব মেম্বার। সে উঠে জলচৌকি ছেড়ে দিল। বসেন, বসেন ঢালি সাহেব।

ঢালি বসলেন। বলেন চেয়ারম্যান সাহেব।

অনেক দিন আগে আপনি আমাকে একবার বলেছিলেন সরদারবাড়িতে খারাপ কিছু ঘটলে অবাক হবেন না।

জি বলেছিলাম।

কেন বলেছিলেন বলুন তো?

জবাবটা যেন এড়িয়ে গেলেন ঢালি। বললেন, অনুমান, অনুমান থেকে বলেছিলাম। তবে সেই অনুমান ঠিকই ফলে গেল।

তা গেল। মতি সরদারের মতো মানুষ মারা গেলেন এভাবে! ঘুমন্ত মানুষটাকে সাপে কাটল!

এই বাড়ির ওপর সাপের আক্রোশ আছে।

কী করে বুঝলেন?

এই জবাবটাও এড়িয়ে গেলেন ঢালি। বললেন, আমি যতবার এই বাড়ির পাশ দিয়ে, খালপারের ওদিকটা দিয়ে হেঁটে গেছি প্রতিবারই সাপ দেখেছি।

বিষাক্ত সাপ?

বিষাক্ত সাপ দেখেছি একবার। কালজাতের বাচ্চা। অন্য সময় দেখেছি ঢোঁড়া। তাতে আমার মনে হয়েছে...

চেয়ারম্যান পান চিবাতে চিবাতে তীক্ষ্ণচোখে নজু ঢালির দিকে তাকালেন। আপনার স্ত্রী সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিল না?

জি। সাতচল্লিশ বছর আগে। নবু-রবু যেদিন জন্মাল সেই রাতেই সাপে কেটেছিল তাকে। সরদার সাহেবের মতো এ রকম ছাইবর্ণই হয়েছিল শরীর।

নবু-রবু তো তার হাতেই জন্মেছিল! ধাত্রী ছিলেন না আপনার স্ত্রী?

জি সাহেব। চোখের সামনে একই রকম দুটো মৃত্যু দেখলাম। একটা নিজ বাড়িতে, আরেকটা সরদারবাড়িতে। কালজাতে কাটল দুজন মানুষকে। সাতচল্লিশ বছর আগে-পরে।

মতি সরদারের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর আজ ঘটল আরেক ঘটনা। ক্লাসে এসে বিলু তার স্কুলব্যাগের চেন খুলেছে, বইখাতার জন্য ভেতরে মাত্র হাত দেবে, ফোঁস করে ফণা তুলল এক কালজাত। ব্যাগের ভেতর থেকে হাত খানেক উঁচু হয়ে ফণা তুলে স্থির হয়ে রইল। তেল চকচকে এমন কালো সাপ, যেটুকু আলো পড়েছে শরীরে সেই আলো যেন পিছলে পিছলে যাচ্ছে।

মুহূর্তে সাড়া পড়ে গেল ক্লাসে। ছাত্রছাত্রীরা বইখাতা ফেলে ছুট দিল। ক্লাস টিচার আশুবাবু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বিলুর ব্যাগ থেকে সাপ তখনো ফণা তুলে আছে। এই ঘটনা পুরো স্কুলে ছড়াতে দশ সেকেন্ডও লাগল না। সব ক্লাসের ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে এল। ক্লাস টেনের ডাকাবুকো ছেলে দুলালের পাঁচজনের একটা বাহিনী আছে। স্কুলের সব কাজে মাতবরি সরদারি তারাই করে। স্কুলগ্রাউন্ডের উত্তর পাশটায় দোতলা পাকা ভবন হচ্ছে। সামনে ইট-বালুর সঙ্গে বাঁশ-কাঠ রাখা। সেখান থেকে চেলাকাঠ নিল দুলাল, কেউ কেউ নিল আস্ত ইট। যেভাবেই হোক মারতে হবে সাপ।

আশুবাবু তখন কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এসেছেন ক্লাস থেকে। দুলালরা ঢুকেছে। ঢুকে দেখে তারাও ঢুকছে সাপও বিলুর ব্যাগ থেকে বেরিয়ে টিনের বেড়ার তলা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে ঘরের পেছন দিকে গিয়েছে ওরা, গিয়ে দেখে সাপের চিহ্নমাত্র নেই, উধাও হয়ে গেছে। পাওয়া গেল না তো গেলই না।

তখন টিচার্স রুমে বিলুকে নিয়ে পড়েছেন স্যাররা। হেডস্যার গম্ভীর গলায় বললেন, বিলু, বাড়িতে তুই কি তোর স্কুলব্যাগের চেন খোলা রাখিস?

বিলু শুকনো গলায় বলল, না স্যার। লেখাপড়া শেষ করে বইখাতা ব্যাগে গুছিয়ে রাখি। চেন বন্ধ করে রাখি।

কাল রেখেছিলি?

জি স্যার।

ঠিক তো?

একদম ঠিক। আমার স্পষ্ট মনে আছে।

আশুবাবু বললেন, চেন বন্ধ থাকলে ব্যাগে সাপ ঢুকল কেমন করে?

বিলু ঢোঁক গিলল। এটা স্যার আমিও বুঝতে পারছি না।

হেডস্যার বললেন, ব্যাগের কোথাও ছেঁড়াটেড়া নেই তো?

দরজার সামনে থেকে দুলাল বলল, না স্যার। এই যে ব্যাগ আমরা উদ্ধার করেছি। ভালো করে চেক করলাম। পিঁপড়া ঢোকার মতো ছিদ্র্রও নেই। প্রায় নতুন ব্যাগ।

টিচাররা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন, চিন্তিত হয়ে গেলেন।

হেডস্যার বললেন, অদ্ভুত ঘটনা। চেন লাগানো ব্যাগ, কোথাও ছিদ্র্র নেই, সাপ ঢুকল কী করে?

রহমান স্যার বললেন, না না চেন লাগানো থাকলে, ব্যাগে ছেঁড়া-ফাটা না থাকলে সাপ ঢুকতেই পারে না। বিলু নিশ্চয় চেন লাগাতে ভুলে গিয়েছিল।

সুধীর স্যার বললেন, চেন লাগাতে ভুলে গেলে ক্লাসে এসে চেন খুলবে কেন?

হয়তো স্কুলে আসার আগে লাগিয়েছে। সারা রাত চেন খোলা ছিল আর সেই ফাঁকে সাপ ঢুকেছে।

আশু স্যার বললেন, আমার মনে হয় না। যদি তা-ই হতো তাহলে বিলু যখন ব্যাগের চেন লাগাতে গেল সাপ তখনই ফোঁস করে উঠত।

হেডস্যার বললেন, আশুবাবুর কথায় যুক্তি আছে। ও রকম হলে চেন লাগানোর সময়ই সাপ ফণা তুলত।

তিনি চিন্তিত হলেন। বিলুদের বাড়িতে সাপের ঘটনা আছে। ওর দাদাকে সাপে কেটেছিল। মতি সরদার মারাই গেলেন সাপের বিষে।

সুধীর স্যার বললেন, দেশগ্রামে সাপের উপদ্রব থাকেই। খালপারে বাড়ি, সাপ আসতেই পারে। রাতে-দিনে বাগে পেলে ছোবল কাউকে মারতেই পারে। কিন্তু বিলুর ব্যাগের ঘটনা অদ্ভুত।

আমি ভাবছি বিলুর কথা। বাই চান্স সাপ যদি ওকে ছোবল দিত! কালজাতের বিষ হাফেজ ওঝা নামাতে পারত না। লৌহজং হাসপাতালে নিতে নিতে অবস্থা কী দাঁড়াত তা আমি কল্পনাই করতে পারছি না।

আশু স্যার বললেন, আর সাপও যেনতেন সাপ না, আমি নিজ চোখে দেখেছি। আমার হাতের মতো মোটা, হাতের থাবার মতো ফণা।

হেডস্যার আবার বললেন, অদ্ভুত ঘটনা। এমন ঘটনা কখনো শুনিনি।

বিলুদের বাড়িতে এর চেয়েও অদ্ভুত ঘটনা ঘটল কয়েক দিন পর। এমন ঘটনাও কেউ কোনো দিন শোনেনি, কল্পনাও করেনি।

দুই

গ্রামে খবরের কাগজ আসে দুপুরের পর।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বারান্দার ইজিচেয়ারে খবরের কাগজ খুলে বসেন কাশেম সাহেব। ছুটির দিনে এ সময় সাধারণত ভাতঘুম দেওয়ার অভ্যাস লোকের। কাশেম সাহেবের এই অভ্যাস নেই। সারা দিন স্কুলে থাকেন, ছুটির দিন ছাড়া দুপুরের খাবার স্কুলে বসেই খান। বাড়ির পুরোনো কাজের লোক রতন টিফিন ক্যারিয়ারে করে পৌঁছে দেয়। স্কুলের দপ্তরি মজিদ প্লেট-গ্লাস সাজিয়ে দেয়। অন্য টিচারদের নিয়ে একসঙ্গে বসে খান। তার পরও চাইলে নিজের চেয়ারে বসে আধঘণ্টা খানেক ঘুমাতে পারেন। ঘুমান না। দুপুরে ঘুমালে রাতে ঘুমের ডিস্টার্ব হয়। এ জন্য খাওয়া-দাওয়ার পর টিচারদের নিয়ে চা খান। স্কুলের ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলেন। এই স্কুল তাঁর স্বপ্ন। বহু বছরের সাধনায় গ্রামের লোকজনের সাহাযে্য তিল তিল করে স্কুলটাকে তিনি আগের মর্যাদায় ফিরিয়ে এনেছেন। জমিদার বাবুরা তৈরি করে গিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু একটা পর্যায়ে প্রায় বসে গিয়েছিল স্কুল।

কাশেম সাহেব এই স্কুলেরই ছাত্র। বরাবর ভালো রেজাল্ট করা। স্কুল শেষ করে ঢাকায় গিয়ে জগন্নাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়লেন, তারপর ইংরেজি সাহিত্যে পড়লেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু গ্রামের জন্য, স্কুলটির জন্য তাঁর খুব মায়া। ইচ্ছে করলে ঢাকার কোনো কলেজে শিক্ষকতা করতে পারতেন। তা না করে গ্রামে চলে এলেন স্কুল দাঁড় করানোর জন্য। তাঁরা বেশ অবস্থাপন্ন। চাকরিবাকরি করে জীবন চালানোর দরকার নেই। গ্রামে বিশাল বাড়ি, বিস্তর ধানি জমি। তিন বোনের এক ভাই তিনি। বোনরা ছোট। বাবা-মা বেঁচে থাকতেই বিয়ে হয়ে গেছে তিনজনের। দুই বোন থাকে ঢাকায়, একজন চিটাগাংয়ে। অবস্থা সবারই ভালো। বোন জামাইরা কেউ চাকরি করে না, সবাই ব্যবসায়ী। এক বোন জামাইয়ের টেক্সটাইল মিল আছে সাভারে, আরেকজনের গোটা দশেক কাপড়ের দোকান ইসলামপুরে। চিটাগাংয়ে থাকে সবার ছোট চম্পা, তার বরের শিপিং বিজনেস। নিজেদের অবস্থা ভালো বলে দেশগ্রামের বাড়িঘর জায়গা সম্পত্তি নিয়ে বোনদের কোনো আগ্রহ নেই। বড়ভাইকে যে যার অংশ লিখে দিয়েছে।

বোনদের সঙ্গে কাশেম সাহেবের সম্পর্ক খুবই ভালো। তিন বোনই তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করে, তাঁর কথার বাইরে কিছু করে না। বোন জামাইরা বলতে গেলে তাঁর কথায় উঠবস করে। ভাগ্নে-ভাগ্নিরা মামা বলতে অজ্ঞান। সুযোগ পেলেই মামার বাড়িতে এসে থেকে যাচ্ছে, আনন্দ উৎসব করছে।

কাশেম সাহেবের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় পড়তে গেছে। ইউনিভার্সিটি অব অস্টিনে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ছে আজ দুবছর। ছোট ছেলে পড়ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। বাবার মতো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। সবার ছোট মেয়ে। তার নাম শালিখ। ক্লাস নাইনে পড়ে। শালিখ নাম বলেই কি না কে জানে, স্বভাব শালিখ পাখির মতোই। এই এদিকে ছুটছে, ওই ওদিকে ছুটছে। ছুটোছুটি হইচই আমোদ ফূর্তিতে বাড়ি মাতিয়ে রাখছে। পড়াশোনায় মন নেই। ইচ্ছে হলে পড়ল না হলে টেলিভিশন দেখল, ল্যাপটপ নিয়ে সময় কাটিয়ে দিল। মোবাইল ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফুফাতো ভাইবোনদের সঙ্গে গল্প করল, ফুফুদের সঙ্গে গল্প করল। কিন্তু আশ্চর্য মেধাবী মেয়ে। ওই অল্প পড়াতেই ক্লাসের কেউ পেরে ওঠে না তার সঙ্গে। প্রতিবছরই ফার্স্ট হচ্ছে।

বনসীমান্ত হাইস্কুলের রেজাল্ট এখন খুবই ভালো। মুন্সিগঞ্জ জেলার স্কুলগুলোর মধ্যে এক থেকে তিনের মধ্যে থাকে অনেক বছর ধরে। কাশেম সাহেব দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে স্কুলের চেহারা ঘুরে গেছে। বছর তিরিশেক আগে প্রায় বসে গিয়েছিল যে স্কুল, ছাত্রছাত্রী নেই, ভালো টিচার নেই, টিচারদের বেতন হয় না ঠিকমতো, স্কুল পরিচালনা পরিষদ উদাস, প্রায় ধ্বংসের মুখে স্কুল। কাশেম সাহেব দায়িত্ব নিয়ে ধীরে ধীরে আগের গৌরব ফিরিয়ে আনলেন স্কুলের। শক্তিশালী একটা পরিচালনা পরিষদ তৈরি করলেন। গ্রামের টাকাঅলা লোকদের অনেকেই এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। তাঁদের কাছে সহযোগিতা চাইলেন। ভালো একটা ফান্ড তৈরি হলো। বনসীমান্তের লাগোয়া গ্রামগুলোর প্রতিটি বাড়ি ঘুরে ঘুরে ছাত্রছাত্রী জোগাড় করলেন। স্কুল ধীরে ধীরে আগের চেহারা পেল। এখন ছাত্রছাত্রী সাড়ে বারো শর মতো।

এই সাড়ে বারো শ ছাত্রছাত্রীর এক ছাত্রী শালিখ আজ দুপুরের পর বাগানের ওদিক থেকে ফিরেই চিৎকার করে উঠল, মা, ওমা, দেখো কে এসেছে? বাবা, বাবা, কোথায় তুমি...

শালিখের চিৎকারে ঘর থেকে বেরুলেন কাশেম সাহেবের স্ত্রী বকুল আর কাশেম সাহেব মুখের সামনে ধরা খবরের কাগজ সরিয়ে বারবাড়ির দিকে তাকালেন। চশমার ভেতর থেকে দেখতে পেলেন তাঁর তিন বোনের মধ্যে বড় বোন মিনুর ছোট ছেলে শাওন হাসিমুখে মামার বাড়িতে ঢুকছে। পিঠে ব্যাগ, পরনে আকাশি রঙের টি-শার্ট-জিনস কেডস। শাওন দেখতে সিনেমার নায়কদের মতো। মাথায় শাহরুখ খানের মতো চুল। মুখে মাস খানেকের দাড়ি। লম্বা ফরসা শাওন ধীরপায়ে এগোচ্ছে। শালিখ ছুটে গিয়ে তার হাত ধরল। এসে খুব ভালো করেছ শাওন ভাইয়া। আমাদের গ্রামে যা ঘটছে না, এমন ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে না।

শাওন ধীরস্থির স্বভাবের ছেলে। মামাতো বোনের কাঁধে হাত রেখে বলল, ঘটনা জেনেই তো এলাম। মোবাইলে তুই আমাকে সবই বলেছিস।

কিন্তু তুমি আসবে এটা ভাবিনি।

এমন একটা ঘটনা আর আমি আসব না! তুই তো জানিস বিচিত্র সব বিষয়ে আমার ইন্টারেস্ট।

কাশেম সাহেব আর বকুলকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল শাওন। কেমন আছো মামা? কেমন আছো মামি?

বকুল বললেন, ভালোই তো ছিলাম রে বাবা কিন্তু গ্রামের ওই ঘটনায় অস্থির হয়ে গেলাম।

কাশেম সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, আগে গোসল কর শাওন। গোসল করে ভাত খা, তারপর কথা বলি।

আমি গোসল করে বেরিয়েছি মামা। এখন ঢাকা থেকে তোমাদের এখানে আসতে দেড় ঘণ্টার বেশি লাগে না।

গাড়ি নিয়ে এলি?

আরে না। গাড়ি আমার ভাল্লাগে না। আমি চলি সাধারণ মানুষের মতো। বাসে এলাম। মামি, ভাত রেডি করতে বলো।

শালিখের দিকে তাকাল শাওন। কী গো শালিখ পাখি, খেয়েছ, নাকি ভাইয়ের সঙ্গে বসবে?

শালিখ তার স্বভাবমতো হইচই করা গলায় বলল, এতক্ষণ না খেয়ে থাকব! সোয়া তিনটা বাজে। তুমি খাও, আমি তোমার সঙ্গে বসছি।

তার আগে আমার ব্যাগ রেখে আয়।

পারব না, তোমারটা তুমি রাখো গিয়ে।

তার পরই হেসে ফেলল। ফান করলাম। দাও, ব্যাগ দাও।

খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দায় ভালো রকম একটা আড্ডা জমে গেল। চৈত্র মাসের শেষদিক। যদিও বেশ গরম পড়েছে কিন্তু এই বাড়িতে গরম কম লাগে। কারণ বাড়িভর্তি গাছপালা। বিকেলের দিকে গরম তেমন লাগছিল না। গাছপালা কাঁপিয়ে হাওয়া আসছিল।

কাশেম সাহেব আগের মতোই বসে আছেন তাঁর ইজিচেয়ারে। খবরের কাগজ পড়া শেষ। এখন ভাগ্নের সঙ্গে গল্প করবেন। গল্প করার ফাঁকে চা খাবেন। পুরোনো দিনের বিল্ডিংগুলোর বারান্দা চওড়া হয়। সেই চওড়া বারান্দার এক পাশে বেতের চেয়ার-টেবিল পাতা। চেয়ারে এসে বসেছেন বকুল। তার পাশে বসেছে শালিখ। কাশেম সাহেবের ইজিচেয়ায়ের মুখোমুখি বসেছে শাওন।

ট্রেতে করে চারজনের চা নিয়ে এল রতন। রতনের বউ কুসুমও এই বাড়িতে থাকে। রান্নাবান্নার কাজ করে। বছর দশেক বিয়ে হয়েছে তাদের, বাচ্চাকাচ্চা নেই। দুজন দুদিক দিয়ে তিনজন মানুষের সংসার চালায়। হাট-বাজার ইত্যাদির কাজ করে রতন, কুসুম করে বাড়ির কাজ। মাঠের জমিগুলো সবই ভাগচাষিদের দেওয়া। ধান চাষ করে অর্ধেক এই বাড়িতে পৌঁছে দেয় তারা। বছর চলার ধান রেখে বাকিটা বিক্রি করে দেন কাশেম সাহেব। টাকা আসে অনেক। স্কুল থেকে তিনি যা পান সেই টাকায় হাতই দিতে হয় না।

মামার মুখোমুখি বসে চায়ে চুমুক দিল শাওন। বলো মামা, ঘটনা বলো।

কাশেম সাহেবও চায়ে চুমুক দিলেন। শালিখ তোকে বলেছে না?

ফোনে একটু বলেছে। তার পরও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। তুমি তো দেখতেও গিয়েছিলে?

শালিখ বলল, কুসুম বুয়াকে নিয়ে আমিও গিয়েছিলাম।

বকুল বললেন, পাড়ার বউঝিদের সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। বাড়ির একেবারে কাছে কেউ যায় না। দেশগ্রামের শত শত মানুষ বাড়ির চারদিকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিড় করে থাকে। তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখে এসেছি।

দূর থেকেও দেখা যায়?

হ্যাঁ, পরিষ্কার দেখা যায়।

কদিন হলো?

কাশেম সাহেব বললেন, আজ চার দিন।

শালিখ বলল হাজার হাজার... ...

হাজার হাজার মনে হয়। হয়তো হাজার হাজার হবে না।

শালিখ বলল, কী বলছ বাবা? তুমিই না প্রথম দিন বাড়ি এসে বললে...। সেদিনই দুপুরের পর আমি গেলাম। দূর থেকে উঠোনের দিকে তাকিয়ে হাজার হাজারই মনে হলো।

শাওন বলল, বুঝলাম। মামা তর্ক-বিতর্ক না করে ঘটনা বলো।

কাশেম সাহেব চায়ে চুমুক দিলেন। চার দিন আগে সকাল সাড়ে আটটার দিকে বিলু দৌড়াতে দৌড়াতে এল এই বাড়িতে। আমি নাশতা খেয়ে চা নিয়ে বসেছি। স্কুল এগারোটা থেকে। দশটায় বাড়ি থেকে বেরুব।

শালিখ বলল, স্কুলে যেতে তোমাকে কোনো দিন এক মিনিট লেট করতে দেখলাম না। কাঁটায় কাঁটায় দশটায় বাড়ি থেকে বেরোও।

এটা আমার গত তিরিশ বছরের অভ্যাস। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে সময় মেনে চলা। তোদেরও সেই শিক্ষা দিয়েছি, ছাত্রছাত্রীদের দিয়েছি। সময় মেনে চলা মানুষ নিজেকে এগিয়ে নেয়, সমাজ এগিয়ে নেয়।

শাওন চা শেষ করে ফেলেছে। বলল, আমি তোমার মতো হতে পারলাম না মামা। আমার কিছুতেই সময় ঠিক থাকে না। প্রতিদিন ভাবি সকাল সাতটার মধ্যে উঠে পড়ব। কিছুতেই পারি না। রাতে চাই এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে। প্রতি রাতেই সাড়ে বারোটা-একটা বেজে যায়। ফেসবুক করতে করতে...

কাশেম সাহেব চায়ে চুমুক দিলেন। তুই করবি কী রে? এভাবে...

শালিখ বলল, এসব ব্যাপারে পরে কথা বলো বাবা। শাওন ভাইয়া যে খবর পেয়ে এল সেই ঘটনা বলো।

চশমা নাকের ডগায় নেমে এসেছিল। এক হাতে চশমা জায়গামতো তুললেন কাশেম সাহেব। বাড়ি থেকে ছুটতে ছুটতে এসেছে বিলু। চোখে-মুখে আতঙ্ক। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বাড়িতে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে স্যার।

আমি চায়ে চুমুক দিতে ভুলে গেলাম। কী হয়েছে?

পুরো বাড়ি সাপে ভরে গেছে।

মানে?

উঠোন-বাগানভর্তি সাপ, বাঁশঝাড়ের ওদিকে সাপ, বারবাড়ির ওদিকে সাপ। শুধু সাপ আর সাপ।

বলিস কী?

জি স্যার। বাড়িতে সবার আগে ঘুম ভাঙে মা আর চাচির। তাঁরা উঠে দরজা খোলেন, সবাইকে ডাকাডাকি করে তোলেন। আজও তাই হয়েছে। মা আর চাচি উঠে মাত্র দরজা খুলেছেন, মা দেখেন আমাদের উঠোনে তিনটা কালজাত সাপ, চাচি দেখেন তাদের উঠোনেও তিনটা কালজাত। আমার ব্যাগ থেকে যে সাপটা বেরিয়েছিল ঠিক ওই সাপ। কালো কুচকুচে, চার-পাঁচ হাতের কম হবে না লম্বা। উঠোনে ও রকম তিনটা সাপ দেখে চিৎকার করে বাবাকে ডেকেছেন মা, চাচি ডেকেছেন চাচাকে। বাড়ির কাজের লোকজনেরা তাদের ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে দেখে ওই দৃশ্য। কী করবে না করবে কেউ বুঝতে পারে না। একটা সাপ হলে মারার চেষ্টা করা যেত, সাপ তো দুই উঠোনে ছয়টা। আর এত বড় বড় সাপ, কে সাহস করে যাবে মারতে! তার পরও কাজের লোক ইউনুসকে ডেকে বাবা বললেন, লাঠি নে ইউনুস। আমিও নিচ্ছি একটা, তোর বউকেও লাঠি নিতে বল, তিনজন তিন দিক থেকে এগোই। পা টিপে টিপে গিয়ে আচমকা সাপের কোমর বরাবর বাড়ি মারবি। কোমর ভেঙে ফেললে সাপ আর এগোতে পারবে না। এক জায়গায় ফণা তুলে স্থির হয়ে থাকবে, তখন পিটিয়ে মারতে সুবিধে হবে।

ইউনুসের বউ পরি সাহসী মহিলা। বাবার কথামতো তারা দুজন লাঠি নিয়েছে। পরির কোলের ছেলেটা দুবছরের। সকালবেলা উঠে নিয়মিত চিৎকার করে কাঁদে। আজও কাঁদতে গিয়েছিল, সাপ দেখে ওইটুকু বাচ্চাও চুপ হয়ে গেছে। মেয়েটি বড়। তার নাম বিন্তি। বিন্তি ঘুমচোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমি আর দিলু ভাইজান থাকি পুবের ঘরে। ভাইদের মধ্যে নীলু ছোট, সবার ছোট বোন ঝুনু, ওরা থাকে মা-বাবার সঙ্গে। মোট কথা বাড়িতে স্যার বড় রকমের আতঙ্ক তৈরি হয়ে গেছে। তার পরও বাবা, ইউনুস আর পরি লাঠি নিয়েছে। চাচার ওদিকেও চলছে সাপ মারার একই রকমের প্রস্ত্ততি। এ সময় ঘটল আরেক ঘটনা। লাঠি হাতে মাত্র ঘর থেকে বেরুতে যাবেন বাবা, আমি আর দিলু ভাইজান আমাদের ঘরের দরজা খুলে উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছি, দেখি খালপারের ওদিক থেকে, বাঁশঝাড় আর বাগানের ওদিক থেকে তিনটা-চারটা করে সাপ উঠোনের দিকে আসছে। মা-বাবাও দেখলেন, ওদিকে চাচা-চাচিও দেখছেন, চাচাতো ভাইবোনরা দেখছে। আমাদের উঠোনের দিকে যেভাবে তিন-চার দিক থেকে আসছে সাপ তাঁদের উঠোনে সেভাবেই আসছে। বাড়ির সবার তখন ভয়ে আতঙ্কে দম বন্ধ অবস্থা। হাতের লাঠি এক পাশে রেখে বাবা চিৎকার করে চাচাকে ডাকলেন। রবু, রবুরে, পালা। সবাইকে নিয়ে যেভাবে পারিস বাড়ি থেকে বেরো। সাপে আজ আমাদের পুরো পরিবার শেষ করে দেবে। তারপর স্যার আমরা, বাড়ির কাজের লোকজনসহ দুই পরিবারের আঠাশজন লোক অতি সাবধানে ঘর থেকে বেরিয়েছি। পা টিপে টিপে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের মাঠে জড়ো হয়েছি। আমাদের ওভাবে বাড়ি থেকে বেরুতে দেখে পাড়ার লোকজনের কৌতূহল হয়েছে। ঘটনা কী, সরদারবাড়ির সব লোক মাঠে কেন?

অন্যান্য বাড়ির লোকজন বউঝি ছেলেপুলেরা বেরিয়ে এসেছে। সবারই এক প্রশ্ন। কী হয়েছে? আমরা যে যার মতো করে ঘটনা বললাম। সাহসী কেউ কেউ লাঠি নিয়ে বাড়ির দিকে এগোল কিন্তু বাড়ির সীমানায় যেতেই পারল না। যেন আগুনের ছ্যাঁকা খেয়ে ছিটকে এল। সবার চোখে ভয়, আতঙ্ক।

মির্জাবাড়ির দলিল দাদা বললেন, সর্বনাশ! বাড়িভর্তি সাপ। সব কালজাত। বাড়ির উঠোন আঙিনা সাপের রঙে কালো হয়ে গেছে। হাজার হাজার কালজাত কিলবিল কিলবিল করছে।

ইউনুস বলল, ছোট-বড়-মাঝারি নানান সাইজের সাপ। তবে সবই কালো। উঠোন থেকে এখন ঘরে ঢুকছে। পুরো বাড়ি দখল করে ফেলেছে।

বাড়িতে তিনটা কুকুর আমাদের। দেশি কুকুর। গোটা চারেক বেড়াল। গরু ছাগল হাঁসমুরগি বাবা চাচা পছন্দ করেন না। বাড়ি নোংরা করে। এ জন্য ওসব আমাদের বাড়িতে নেই। সাপ দেখে কুকুর তিনটা প্রথমে তেড়ে গিয়েছিল। ঘেউ ঘেউ করে তাড়াতে চেয়েছে। সাপগুলো যখন ফণা তুলে এগিয়েছে, ভয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। আমাদের সঙ্গে মাঠে চলে এসেছে। মাঠে দাঁড়িয়ে সমানে ঘেউ ঘেউ করছে। থেকে থেকে ছুটে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। কিছুদূর গিয়েই আবার ফিরে আসছে।

চারটা বেড়ালের তিনটা মাঠে চলে এসেছে। শুধু হুলোটা নেই। বেজায় সাহসী। নিশ্চয় কোনো সাপ কামড়ে ধরতে গিয়েছিল, সাপের কামড়ে ফিনিস হয়ে গেছে।

কাশেম সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন। বিলুর কথা শুনে আমি হতভম্ব। কী বলব বুঝতে পারছি না। শুধু মনে হচ্ছে বিলু বাড়িয়ে বলছে। হাজার হাজার কালজাত সাপ কোত্থেকে আসবে! হয়তো দশ-বিশটাকেই হাজার হাজার মনে হচ্ছে। খালের ধারে বাড়ি তো, সাপ ওই দিকে থাকতেই পারে। মতি সরদার মারা গিয়েছিলেন সাপের কামড়ে। এক জোড়া কালজাত যদি কোথাও থাকে সেই দুটো থেকে দশ-বিশটা বা তারও বেশি সাপ জন্মাতে পারে। কিন্তু বিলু যে বলছে হাজার হাজার এটা একেবারেই অসম্ভব। দেশগ্রামের মানুষের স্বভাবই হচ্ছে বাড়িয়ে বলা।

বিলুকে বললাম, হাজার হাজার সাপ কোত্থেকে আসবে! দশ-বিশটা হতে পারে!

বিলু বলল, না স্যার। হাজার হাজার না হলেও শত শত সাপ হবে।

আমি হাসলাম। কিছুক্ষণ পর বলবি পঞ্চাশ-একশটা হবে।

বিশ্বাস না হলে আপনি চলুন স্যার। নিজ চোখে দেখবেন। আমি যখন আপনার বাড়ির দিকে ছুটছি তখন পুরো গ্রামের লোক আমাদের বাড়ির সামনে। বাড়ির চারদিকেই লোক। খালের ওপারে দাঁড়িয়েও সাপ দেখছে লোকে। আমি যখন এলাম তখন মাঠ থেকে পরিষ্কার দেখলাম বাড়ির ঘর দুয়ারে চলাফেরা করছে সাপ, গাছপালায় ওঠানামা করছে। উঠোন আঙিনায় তো আছেই।

চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়নি? অর্থাৎ বাড়ির চারপাশে, মাঠের ওদিকটায়?

না স্যার। এ আরেক আশ্চর্য কারবার। বাড়ির বাইরে একটা সাপও নেই। বাইরের দিকটায় আসছেই না। ভাবটা এমন, যেন আমাদের বাড়িটা দখল করাই উদ্দেশ্য। আমাদের বাড়ি থেকে তাড়ানোই উদ্দেশ্য।

একটু থেমে বিলু বলল, আপনি চলুন স্যার। নিজ চোখে দেখবেন।

চল তো!

থামলেন কাশেম সাহেব। রতনকে ডাকলেন। রতন।

রান্নাঘরের ওদিক থেকে সাড়া দিল রতন। জি স্যার।

আরেক কাপ চা দে।

তারপর শাওনের দিকে তাকালেন। তুই খাবি নাকি আরেক কাপ?

খেতে পারি।

শালিখ বলল, আমিও খাব।

তাহলে তোর মাকে আর বাদ দিচ্ছিস কেন? সবার জন্য বানাতে বল।

বকুল বললেন, না আমি আর চা খাব না। বেশি চা খেলে রাতে আমার ঘুম হয় না।

রতনকে দাদা ডাকে শালিখ। বারান্দা থেকেই চিৎকার করে বলল, রতনদা, তিন কাপ চা।

রতন সাড়া দিল। দিচ্ছি।

বাবার দিকে তাকাল শালিখ। বলো বাবা, তারপর কী হলো বলো।

কাশেম সাহেব একটু নড়েচড়ে বসলেন। গেলাম বিলুর সঙ্গে। একটু ঘুরপথে গিয়ে সরদারবাড়ির সামনের মাঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে পুরো শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। সত্যি সত্যি ভয়ংকর কাণ্ড। সরদারদের তিরিশ বিঘার বাড়িভর্তি সাপ। যেদিকে তাকাই সেদিকেই সাপ। সব এক রকমের সাপ। ঝিমকালো। চৈত্র মাসের রোদ তীব্র হয়েছে। কোনো কোনো সাপের গায়ে পড়েছে, পড়ে যেন পিছলে যাচ্ছে। বাড়ির এদিক-ওদিক চলাফেরা করছে নির্বিঘ্নে। উঠোন আঙিনায়, ঘরের ভেতর, চালা বেড়া গাছপালা, সর্বত্র সাপ। আশ্চর্য ব্যাপার হলো বাড়ির সীমানার বাইরে আসছে না একটাও।

ভিড়ের মধ্যে হাফেজ ওঝা দাঁড়িয়ে আছে। মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, এ রকম কাণ্ড বাপের জন্মে দেখিনি। দেখা তো দূরের কথা, শুনিওনি।

আমার পাশে তখন অনেক লোক। কে একজন বলল, তোমার ওঝাগিরি দেখাও হাফেজ। সাপ তাড়ানোর ব্যবস্থা করো।

হাফেজ ভয়ার্ত গলায় বলল, এই সাপ তাড়ানোর বিদ্যা আমার নেই। বিদ্যা যেটুকু আছে ওইটুকু ফলাতে গেলে আজ রাতেই কালজাতে কাটবে আমাকে। আগামীকালের ভোরের আলো আর দেখতে পাব না।

নবু সরদার বললেন, কিন্তু কোনো না কোনো ব্যবস্থা তো করতে হবে। সাপ না তাড়ালে বাড়িতে আমরা ঢুকব কেমন করে?

গ্রামের যুবকেরা তখন লাঠিসোঁটা নিয়ে তৈরি হয়েছে। জনা বিশেকের একটা দল হয়েছে। একদিক থেকে সার ধরে তারা সরদারবাড়িতে উঠবে। একটা একটা করে সাপ মারবে আর এগিয়ে যাবে।

নজু ঢালি তার বয়স্ক শরীর নিয়ে বসে আছেন মাঠের কোণে। হঠাৎই তাঁর দিকে চোখ গেছে। দেখি আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ছেন। অর্থাৎ কাজ হবে না। একটা সাপও মারতে পারবে না।

হলোও তাই। যুবকের দল প্ল্যানমতো লাঠি হাতে সার ধরে এগোল। বাড়ির সীমানায় মাত্র পা দিয়েছে, বিস্মিত চোখে আমরা দেখি মুহূর্তে চারদিক থেকে ছুটে এল শখানেক সাপ। এসে পুরোনো কালের যোদ্ধারা যুদ্ধের মাঠে শত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য ঢাল হাতে যেভাবে সার বেঁধে দাঁড়াত, ঠিক সেই ভঙ্গিতে ফণা তুলেছে। মুখে এমন হিসহিসে শব্দ, কোনো কোনোটা তেড়েও এল যুবকদের দিকে। ওই দেখে এক পা এগোনোর সাহস পেল না কেউ। হাতের লাঠি নিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে ফিরে এল। না, এত সাপের মোকাবিলা করা সম্ভব না।

রতন চা নিয়ে এল। কাশেম সাহেব চা নিলেন। শাওন আর শালিখও নিল।

চায়ে চুমুক দিয়ে কাশেম সাহেব বললেন, ওই দৃশ্য যে না দেখেছে সে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু বাড়ি তো সাপমুক্ত করতে হবে। কী করে সম্ভব? চেয়ারম্যান-মেম্বাররা সবাই আছে, মাতবররা আছে। ঠিক হলো, ওই বিশ যুবক পুরোনো ন্যাকড়ার মশাল তৈরি করবে। ন্যাকড়ায় কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে বাড়ির দিকে এগোবে। আগুনে ভীষণ ভয় সাপের। আগুনের সামনে আসবে না, আগুন দেখলে পালাতে বাধ্য হবে।

আমি আবার তাকালাম নজু ঢালির দিকে। কোনো কারণ ছাড়াই তাকিয়েছি। দেখি সে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমাকে তাকাতে দেখে আগের মতোই মাথা নাড়ল। অর্থাৎ আগুনেও কাজ হবে না।

কাশেম সাহেব চায়ে চুমুক দিলেন। তাই হলো। ওরা মশালের আগুন নিয়ে এগোতেই পারল না। সাপগুলো এমন ভঙ্গিতে তেড়ে এল, মশাল ফেলে দৌড়ে এল সবাই।

শাওন পরপর দুবার চায়ে চুমুক দিল। আগুনে কাজ হওয়ার কথা। না হওয়ার কারণ হচ্ছে একসঙ্গে এত সাপ কেউ কোনো দিন দেখেনি। ভয়ে আতঙ্কে অস্থির হয়ে আছে সবাই। ওই ভয়ের কারণে ঠিকমতো এগোনোর সাহস পায়নি। মনোবল বলতে গেলে ছিলই না কারও মধ্যে।

শালিখ বলল, তাই তো হওয়ার কথা। অত দূর থেকে দেখেই দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার!

কিন্তু মামা, এখানকার পুলিশ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি?

কী ব্যবস্থা নেবে কেউ বুঝতে পারছে না। ডিসি এসপি এসেছিলেন, উপজেলা কর্মকর্তা, ওসি তাঁরা তো আছেনই। রোজই আসা-যাওয়া করছেন। আজ চার দিন কোনো কাজই হয়নি। সরদাররা অন্য বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। গ্রামের সব কাজকর্ম বন্ধ। আমাদের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসছে না। সারা জেলার মানুষ এসে ভিড় করছে সাপ দেখার জন্য। সরদারবাড়ির সামনে মেলা বসে গেছে। সত্যি সত্যি মেলা। চা মিষ্টির দোকান, মুদি মনিহারি দোকান, খেলনাপাতির দোকান, পান বিড়ি সিগ্রেটের দোকান, বরফ দেওয়া শরবতের দোকান।

কিন্তু ব্যবস্থা তো কিছু একটা করা দরকার।

তা তো বটেই। এভাবে একটা বাড়ি সাপের দখলে চলে যাবে তা তো হতে পারে না। পরিত্যক্ত জঙ্গুলে বাড়ি হতো, সে না হয় অন্য কথা। কেউ কিছু মনে করত না। এ তো বসতবাড়ি!

একটু থেমে চিন্তিত গলায় শাওন বলল, নজু ঢালির ব্যাপারটা কী? সে দুবারই কেমন করে বলল, কাজ হবে না।

এটা আমারও প্রশ্ন।

ভদ্রলোকের সঙ্গে পরে তুমি কথা বলেছ মামা?

না।

বলা দরকার। তাঁকে খবর দাও। কাল সকালে আসতে বলো।

ঠিক আছে। রতনকে বলব ডেকে নিয়ে আসতে।

আর আমি এখন একটু সরদারবাড়ির দিকে যেতে চাই। শালিখ যাবি নাকি?

শালিখ লাফিয়ে উঠল। চলো।

কাশেম সাহেব বললেন, চলো আমিও যাই।

বকুল বললেন, সন্ধ্যার আগে আগে ফিরো। সাপ খুবই খারাপ জিনিস।

তিন

আমি যা বলব মনে হয় আপনারা কেউ তা বিশ্বাস করবেন না। খুবই অবিশ্বাস্য ঘটনা। বায়ান্ন বছর ধরে চেপে রেখেছি কিন্তু আজ আর না বলে উপায় নেই। বলার পর আজ রাতেই আমি শেষ হয়ে যাব কি না জানি না। শেষ হলেও দুঃখ নেই। নব্বইয়ের ওপর বয়স হয়েছে, আর কত বাঁচব!

কাশেম সাহেবের বাংলাঘরে সকালবেলা এসে বসেছেন নজু ঢালি। সঙ্গে নবু-রবুও আছে। দুজনের মুখই শুকনো, ফ্যাকাসে। চোখে কয়েক রাত না ঘুমানোর চিহ্ন। তারা ধোপদুরস্ত থাকে সব সময়। আজ পরনের পাজামা-পাঞ্জাবি মলিন। মুখে কয়েক দিনের না কামানো দাড়ি। পায়ের কালো পাম শু ধুলোয় ধূসর।

তাদের তিনজনকে বাংলাঘরে বসিয়ে কাশেম সাহেবকে খবর দিয়েছে রতন। তখনো নাশতার টেবিলে তিনি। নাশতা শেষ করে চা খাচ্ছেন, শাওন শালিখের সঙ্গে টুকটাক কথা বলছে। বকুল খানিক আগে রান্নাঘরের দিকে গেছেন।

শাওন ঘুরেফিরে সরদারবাড়ির কথা তুলছিল, সাপের কথা তুলছিল। কাল বিকেলে নিজ চোখে দেখে এসেছে। তার ধারণা শ-খানেক সাপ সব মিলিয়ে হতে পারে। এক শ সাপও বিশাল ব্যাপার। একসঙ্গে এক শ সাপ কোথাও চলাফেরা করলে লোকের মনে হবে হাজার হাজার সাপ চড়ছে। শালিখের ধারণা সাপ হবে চার-পাঁচ শ। কাশেম সাহেবের ধারণা দুই-আড়াই শ। রতনের কথা হচ্ছে সাপ হবে কমপক্ষে এক হাজার।

চায়ে চুমুক দিয়ে কাশেম সাহেবের দিকে তাকিয়েছে শাওন। মামা, সাপ তাড়ানোর সহজ একটা পথ আছে।

কাশেম সাহেব কথা বলার আগেই শালিখ বলল, জানি, কার্বলিক অ্যাসিড। ওই জিনিস স্পে্র করে দিলে মুহূর্তে পালাবে সাপ। আমাদের বাড়িতে কার্বলিক অ্যাসিড আছে।

কাশেম সাহেব বললেন, হোমিওপ্যাথির সিসিতে কার্বলিক অ্যাসিড ভরে বাড়ির এদিক-ওদিক পুঁতে রাখি আমরা। যে কারণে গ্রীষ্ম-বর্ষায় সাপের উপদ্রব এই বাড়িতে একদমই হয় না। আর শীতকালে তো সাপ থাকেই না। শীতনিদ্রায় যায়।

এ সময় রতন এসে নজু ঢালি আর নবু-রবুর খবর দিল। তাদের চা-নাশতা দেওয়ার কথা বলে উঠলেন কাশেম সাহেব। শাওন শালিখকে বললেন, তোরাও আয়।

শালিখ বলল, তা তুমি না বললেও আসব। শুনতে হবে না ঘটনা কী!

কাশেম সাহেব রতনের দিকে তাকালেন। রতন, শালিখের মাকেও বাংলাঘরে আসতে বলো।

তার পর থেকে বাংলাঘরে সবাই। নাশতা দেওয়া হয়েছিল খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে ভাজা পরোটা আর সুজির হালুয়া। নজু ঢালি খুবই আয়েশ করে খেলেন। নবু-রবুর খাওয়ার দিকে মন নেই। তবু সামান্য মুখে দিয়েছে। এখন চা খাচ্ছে তিনজনে। চা খেতে খেতেই ওসব কথা বললেন ঢালি।

কাশেম সাহেব বললেন, সাপের সঙ্গে সব সময়ই অনেক কুসংস্কার থাকে। দেশগ্রামে বহু প্রচলিত গল্প আছে সাপ নিয়ে...

ঢালি বললেন, এটা কুসংস্কার না। সত্য গল্প। গল্পও না, ঘটনা। গল্পের সঙ্গে কল্পনার মিশেল থাকে। এখানে কোনো কল্পনা নেই।

ঢালির কথা বলার ধরন, উচ্চারণ আর শব্দ ব্যবহার শুনে শাওন অবাক। গ্রামের এই বয়সী একজন মানুষ, চেহারা দেখে মনে হয় লেখাপড়া তেমন জানেন না কিন্তু কথা বলছেন এত সুন্দর করে! গল্প আর ঘটনার ব্যাখ্যা করছেন! ‘মিশেল’ শব্দ ব্যবহার করছেন!

কথাটা না বলে পারল না সে। বলল, আঙ্কেল...

কাশেম সাহেব তাকে থামিয়ে দিল। নানা ডাক। ঢালি সাহেবকে আমরা চাচা ডাকি। চাচির হাতে আমার আর তোর মা-খালাদের সবারই জন্ম হয়েছে।

ওকে মামা। হ্যাঁ যা বলছিলাম নানা...। না, শুধু নানাটা জমছে না, নানাভাই বলি। নানাভাই, আপনি অসাধারণ সুন্দর করে কথা বলেন। শুনে মনে হয় বাংলা সাহিত্যের কোনো টিচার কথা বলছে।

এই অবস্থায়ও হাসলেন ঢালি। কী যে বলো ভাই! আমি মূর্খ মানুষ, সেই কোন আমলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিলাম। তবে দেশগ্রামে ঘুরে বেড়াই, তোমার মামার মতো শিক্ষিত মানুষদের সঙ্গে উঠবস করি সে জন্য হয়তো কথা কিছুটা শিখেছি।

কাশেম সাহেব বললেন, যা বলতে চাইলে সে কথা বলো চাচা।

নবু-রবুও একসঙ্গে বলল, হ্যাঁ, শুনি কী ঘটনা।

ঢালি চায়ে চুমুক দিয়ে দুভাইয়ের দিকে তাকালেন। তোমাদের আরেক ভাই আছে।

আচমকা এমন একটা কথা, নবু-রবু আকাশ থেকে পড়ল। কাশেম সাহেব, বকুল এমনকি শালিখ পর্যন্ত স্তম্ভিত হলো। দুভাই একসঙ্গে বলল, বলো কী চাচা? আমাদের আরেক ভাই! কোনোদিন শুনিনি তো! আমরা যমজ দুভাই, আর কোনো ভাই-বোন নেই, এ কথা জন্মের পর থেকে শুনে আসছি!

না, আছে এক ভাই।

নবু বলল, কোথায় আছে সে? আমাদের তেরো বছর বয়স পর্যন্ত মা বেঁচে ছিলেন। শেষদিকে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ওই অবস্থায় মারা গেলেন। কিন্তু কোনো দিন তাঁর মুখে আমাদের কোনো ভাই-বোনের কথা শুনিনি। জন্মেছিল, পরে মারা গেছে, এমন ঘটনাও ঘটেনি। ঘটলে নিশ্চয় মা বলতেন, না হয় অন্য কেউ বলত।

রবু বলল, বাবা মারা গেলেন পাঁচ বছর আগে। তেরো বছরের যমজ ছেলে বাবা ও মা দুজনের আদরে মানুষ করলেন। মায়ের মাথায় গন্ডগোল দেখা দেওয়ার পর বাবার দূর সম্পর্কের বিধবা বোন শেফালি ফুফু এসে সংসারের হাল ধরলেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আমাদের দুভাইকে আপন ছেলের মতো ভালোবাসতেন। বাবা কিংবা ফুফু কিংবা অন্য কোনো আত্মীয়স্বজনের মুখে কোনো দিন শুনিনি আমাদের আরেক ভাই আছে।

কাশেম সাহেব বললেন, এ ধরনের ঘটনা চাপা থাকে না চাচা। মতি সরদার অন্য কোথাও বিয়ে করেছেন, সেই ঘরে ছেলে আছে—এমন কথা আমরা কোনো দিন শুনিনি। জন্মের পর থেকে তাঁকে দেখে আসছি।

ঢালি বললেন, না, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিল না।

তাহলে?

নবু-রবুর মায়ের গর্ভেই জন্মেছে আরেক ছেলে।

দুভাই কথা বলার আগেই ঢালি বললেন, তোমরা দুভাই না, তিন ভাই জন্মেছিলে একসঙ্গে। এ কথা পৃথিবীর চারজন মানুষ ছাড়া পঞ্চম কেউ জানে না। চারজনের তিনজন বিশ্বাস করতেন, একজন করতেন না। সেই একজন হচ্ছেন মতি সরদার, তোমাদের বাবা। তোমার মা তো বিশ্বাস করতেনই, সেই ছেলের সঙ্গে ক্বচিত দেখাও হতো তাঁর। আর জানত আমার স্ত্রী। সে একজন মানুষকে সে কথা বলেছিল। সেই মানুষটি আমি।

নবু-রবু শুকনো গলায় বলল, আমাদের সেই ভাই কোথায়?

আছে, তোমাদের আশপাশেই আছে।

শাওন তীক্ষ্ণ চোখে ঢালি সাহেবের দিকে তাকাল। নানাভাই, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, নবু সাহেব, রবু সাহেবের আরেকজন ভাই আছেন, তার সঙ্গে সাপের সম্পর্ক কী?

ঢালি সাহেব শাওনের দিকে তাকালেন। বয়সী অপলক চোখে তাকিয়ে বললেন, সেই ভাই মানুষ না। সেই ভাই সাপ। কালজাত সাপ।

এ কথায় কাশেম সাহেবের বাংলাঘরে যেন বাজ পড়ল। একসঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। এ-ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। নবু-রবু পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে পাথর হয়ে গেল।

ঢালি সাহেব বললেন, জানি আমার কথা কারও বিশ্বাস হচ্ছে না। স্ত্রীর মুখে শুনে আমিও সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করিনি। বিশ্বাস করলাম নবু-রবু যেদিন জন্মাল সেই রাতেই সাপের দংশনে স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনায়। ওরা জন্মেছিল দুপুরের পর। বৃষ্টি-বাদলার দিন। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল, দুপুরের পর পরই সন্ধ্যাবেলার মতো আবছা অন্ধকার হয়ে উঠেছে চারদিক...

চায়ে শেষ চুমুক দিলেন ঢালি। আমি বাড়িতেই ছিলাম। বাড়ি ফিরে স্ত্রী বলল, সরদার সাহেবের যমজ ছেলে হয়েছে। শুনে আমি খুবই খুশি কিন্তু স্ত্রীর মুখে কী রকম চিন্তার ছায়া। বললাম, কী হয়েছে তোমার? এত আনন্দের সংবাদ নিয়ে এলে, মুখ মলিন কেন? কী চিন্তা করো?

তখনই সে আমাকে কিছু বলল না, বলল রাতের বেলা। ঘুমাতে যাওয়ার আগে। তখনকার দিনে দেশগ্রামের স্ত্রীরা স্বামীকে ‘আপনি’ করে বলত। চিন্তিত গলায় সে বলল, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।

বলো।

কথাটা কোনো দিন কাউকে বলতে পারবেন না।

আমি হাসিমুখে বললাম, ঠিক আছে বলব না।

আমার মন বলছে বললে আপনার ক্ষতি হতে পারে। এই যে আমি আপনাকে বলছি কিন্তু মন থেকে সায় পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে এতে আমার ক্ষতি হবে।

তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না। কী এমন কথা যা বললে ক্ষতি হবে? কী ক্ষতি হবে?

তা বুঝতে পারছি না।

আমাকে বলে ফেলো, মন হালকা হবে। কোনো সমস্যা নেই। স্বামীর কাছে স্ত্রীদের কোনো কথাই লুকানো ঠিক না।

তার পরও সে একটু চুপ করে রইল।

বললাম, কী হলো? বলো।

হারিকেনের আলোয় দেখি তার মুখ ফ্যাকাশে। আমার কথা শুনে বলল, সরদার সাহেবের যমজ ছেলের সঙ্গে একটা সাপও জন্মেছে। কালজাত সাপ।

শুনে আঁতকে উঠলাম। কী বলছ?

হ্যাঁ। হাত খানেক লম্বা হবে এমন একটা কালজাত সাপ। জন্মের পর কিছুক্ষণ রইল ঘরে। আমি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছি। দুতিন মিনিট হবে ঘরে থাকল সাপটা, তারপর বেড়ার তলা দিয়ে বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় বেরিয়ে গেল।

তার কথা আমি বিশ্বাসই করলাম না। প্রথমে বিস্মিত হয়েছিলাম, তারপর হেসে উড়িয়ে দিলাম। ধেৎ, কী বলছ তুমি!

সত্য কথা বলছি। আমি আপনার সঙ্গে জীবনে মিথ্যা বলিনি। যমজ ছেলের সঙ্গে একটা কালজাত সাপও জন্মেছে। বিশ্বাস করুন, আমার এই চোখে পরিষ্কার দেখেছি। দুতিন মিনিট দেখেছি। আমার হাতেই তো জন্মাল।

তুমি ভুল দেখেছ। মানুষের পেটে সাপ জন্মাতেই পারে না।

তাহলে কী জন্মাল আমার হাতে, কী দেখলাম আমি?

জন্মেছে যমজ ছেলে।

আর সাপটা! বেড়ার তলা দিয়ে যে বেরিয়ে গেল!

হতে পারে ও সময় ঘরে একটা কালজাতের বাচ্চা ঢুকেছিল। বাঁশঝাড়ের ওদিককার ঘর। ঘরের পেছনে বাগান, জঙ্গল ঝোপঝাড়। ও রকম ঘরে সাপ ঢুকতেই পারে।

সে দৃঢ় গলায় বলল, না, আমি যা বলছি সেটাই সত্য। নিজেকে আমি অবিশ্বাস করতে পারি না।

নানা রকমভাবে তাকে বোঝালাম, সে বুঝলই না। একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার ঘুম বরাবরই গাঢ়। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি। একটানা গভীর ঘুম ঘুমাই। কানের পাশে ঢোলডগর বাজলেও টের পাই না। পাশে শোয়া স্ত্রীকে সাপে কাটল, নিশ্চয় বিষে জর্জরিত হয়ে হাত-পা নেড়েছে, আমাকে হয়তো ডেকেছে, আমি টের পাইনি কিছুই। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি ফর্সা মানুষটা সাপের বিষে ছাইবর্ণ। সব শেষ হয়ে গেছে।

বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। স্ত্রী বলেছিল সাপের ঘটনা বললে তার ক্ষতি হতে পারে। এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর কী হবে! জীবনই তো চলে গেল! তার মানে আমিও যদি কাউকে এ কথা বলি, তাহলে রাতে এসে কালজাত আমাকেও দংশন করে যাবে। ঘুমঘোরে মারা যাব। সেই ভয়ে আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি। আকারে-ইঙ্গিতে সরদার সাহেবকে বোঝাতে চেয়েছি, তিনি বোঝেননি।

ঘরের ভেতর মৃত্যুর মতো স্তব্ধতা। সেই স্তব্ধতা ভাঙল শাওন। কী রকম আকার-ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছেন?

সরদার সাহেব আমার চেয়ে দশ-বারো বছরের ছোট। তার পরও তাঁর সঙ্গে ছিল গভীর বন্ধুত্ব। যেকোনো কাজে তিনি আমাকে ডাকতেন, সংসার জায়গা সম্পত্তি বাড়িঘর নিয়ে, নবু-রবুকে নিয়ে বুদ্ধি পরামর্শ কিছু থাকলে আমাকে নিয়ে করতেন। জীবনের সব কথাই আমাকে বলতেন। অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতাম। আড্ডা দিয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফিরতাম। এক পূর্ণিমা রাতে আড্ডা দিয়ে ফিরছি। সরদারবাড়ি থেকে আমার বাড়িতে যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা হচ্ছে বাড়ির পেছন দিককার বাগান আর বাঁশঝাড়ের ওদিক দিয়ে খালপারের পথ ধরা। এক পাশে খাল আরেক পাশে ফসলের মাঠ। পূর্ণিমা রাত, আকাশে ভরা চাঁদ। চাঁদের আলো দিনদুপুরের মতো। সরদারবাড়ির পেছন দিককার পথ ধরেছি। বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় আসতেই কানে এল অদ্ভুত এক হিসহিসে শব্দ। চমকে তাকিয়েছি, তাকিয়ে দেখি বাঁশঝাড়ের সামনের দিককার সবুজ ঘাসের ওপর দুটো বিশাল সাপ মুখোমুখি ফণা তুলে আছে আর তাদের দুপাশে কিলবিল করছে ছোট ছোট কতগুলো সাপ। জ্যোৎস্নায় আসল রং বোঝা যাচ্ছিল না, ছাইবর্ণের দেখাচ্ছিল সাপগুলো। প্রথমে দৃশ্যটা বাস্তব মনে হলো না। মনে হলো, আমি হয়তো স্বপ্ন দেখছি। কী রকম একটা ঘোর লেগে গেল। কয়েক মুহূর্ত নীরবে কাটল। তারপর ঘোর কাটল। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেছে। শব্দ পেলেই ছুটে আসবে সাপ। আমি পা টিপে টিপে, বেড়ালের মতো নিঃশব্দে জায়গাটা পেরিয়ে এলাম। বাড়িতে কাউকে বললাম না সাপের কথা। পরদিন সরদার সাহেবকে বললাম। শুনে তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ কোনো কথা বললেন না। একসময় স্তব্ধতা ভেঙে বললেন, ঢালি, আজ তোমাকে একটা কথা বলি। জীবনে কাউকে বলিনি, তোমাকেই বলছি।

আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। কী এমন কথা, শুনি।

পূর্ণিমা রাতে নবু-রবুর মা প্রায়ই ঘরে থাকত না।

কোথায় যেতেন?

ওই বাঁশঝাড়তলায়। ওখানে গিয়ে ঘাসের ছোট্ট মাঠটায় বসে থাকত।

কেন?

সেটাই আশ্চর্য ঘটনা। নবু-রবু তখন বেশ ছোট। এক রাতে টের পেলাম ওদের মা ঘরে নেই। এত রাতে কোথায় গেছে ভেবে পেলাম না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। না, ফিরছে না। ঘর থেকে বেরুলাম। নবু-রবু আমাদের বিছানায় ঘুমাচ্ছে। বাড়ির এদিক-ওদিক খঁুজলাম, পেলাম না তাকে। একসময় বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় গেছি। দেখি বাড়ির দিকে পেছন ফিরে আনসপিঁড়ি করে বসে আছে। ছোট বাচ্চা কোলে নেওয়ার ভঙ্গিতে দুহাত কোলের কাছে তোলা। নিচু স্বরে বলছে, ওরে আমার সোনা, ওরে আমার মানিক...

ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পা টিপে টিপে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। দেখি তার কোলে একটা সাপ। দেখে নিজের অজান্তে শব্দ করে ফেলেছি। সে মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, তারপর কোলের সাপটা ঘাসের বনে নামিয়ে দিয়ে বলল, যা বাবা, যা।

সাপ দ্রুত বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল আর সে উঠে বাড়ির দিকে চলে এল। আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। ঘরে ফিরে দেখি নবু-রবুকে বুকের কাছে নিয়ে গভীর ঘুমে ডুবে গেছে। সেই রাতে একটা মিনিটও ঘুমাতে পারলাম না আমি। বিশ্বাসই হচ্ছিল না দৃশ্যটা সত্যি সত্যি দেখেছি। পরদিন জিজ্ঞেস করলাম তাকে, সে কোনো জবাব দিল না। এমনিতেই কম কথা বলা মানুষ, সেদিনের পর থেকে কথা যেন আরও কমে গেল। কিছুতেই আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। যত দিন সে বেঁচে ছিল তত দিনে মোট সাতবার আমি তাকে ওভাবে দেখেছি। কোলে সাপ, নবু-রবুকে যেভাবে আদর করত, সেভাবে আদর করছে সাপটাকে। নিচু স্বরে বলছে, ওরে আমার সোনা, ওরে আমার মানিক...। তারপর মাথা খারাপ হয়ে তিন বছরের মতো বেঁচে থাকল। পাগল অবস্থায় একদমই কথা বলত না কারও সঙ্গে, পূর্ণিমা রাতে বাঁশঝাড়তলায় আর যেত না।

বাংলাঘরে পিনপতন নীরবতা।

একটু থেমে ঢালি বললেন, সরদার সাহেবের মুখে এই ঘটনা শুনে দ্বিতীয়বার আমার বিশ্বাস হলো স্ত্রী আমাকে মিথ্যা বলেনি। একবার তাকে বলতেও চাইলাম, তোমার নবু-রবুর সঙ্গে আরেক ছেলেও জন্মেছিল। সেই ছেলে মানুষ না, সাপ। পূর্ণিমা রাতে মা যেত তার কাছে, সে আসত মায়ের কাছে। ওই বাঁশঝাড়তলায় তার বাস। বললাম না ভয়ে। বলার পর যদি অবস্থা হয় আমার স্ত্রীর মতো! ঘুমঘোরে সাপ এসে দংশন করে যায়! সেদিনের পর থেকে মাঝেমধ্যেই সরদার সাহেবকে বলতাম, সাপ থেকে সাবধান। তোমার সঙ্গে ছায়ার মতো আছে সাপ। জ্যোৎস্নারাতে তো নয়ই, কোনো রাতেই বাঁশঝাড়তলায় যেয়ো না। চলাফেরা কোরো সাবধানে।

আমি নিজেও রাতের বেলা ওই পথে আর চলাফেরা করতাম না। দিনের বেলা ওদিক দিয়ে গেলে-এলে বুক কাঁপত। তবে দিনের বেলা সাপ কখনো দেখিনি।

শাওন বলল, আমার একটা প্রশ্ন আছে নানাভাই। করব?

ঢালি সাহেব শাওনের দিকে তাকালেন। করো।

সাপটা যে ছেলে বুঝলেন কী করে?

আমার স্ত্রী বলেছিল। তবে সাপটা ছেলে না মেয়ে এই প্রশ্ন তখন আমার মাথায় আসেনি। নিশ্চিত হলাম সরদার সাহেবের কথা শুনে। নবু-রবুর মা পূর্ণিমা রাতে বাঁশঝাড়তলায় বসে কোলে সাপ নিয়ে বলতেন, ওরে আমার সোনা, ওরে আমার মানিক। মা জানতেন সাপটা ছেলে।

শাওন মাথা নাড়ল। কথায় লজিক আছে।

শালিখ বলল, তারপর কী হলো?

নবু-রবু অপলক চোখে তাকিয়ে আছে ঢালির দিকে। তিনি বললেন, আরেক ঘটনা ঘটল নবু-রবুর বিয়ের মাস তিনেক পর, সরদার সাহেব যখন জমি আর বাড়ি ভাগ করছিলেন। লৌহজংয়ের খালেক আমিন জায়গাজমিন মাপজোখের কাজ করে। সরদারের এত জমি আর এত বড় বাড়ি, দুজন সহকারী নিয়ে কাজ শেষ করতে পাঁচ দিন লাগল। ওই পাঁচ দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমি সরদারের সঙ্গে। প্রতিদিনই মাপ শেষ করার পর, দুই ছেলের কার কোন জমি, সীমানা খুঁটি পুঁততে গিয়েই দেখা যায় ভাগ দুটো হয়নি, হয়েছে তিনটা। আমিন আর তার সহকারীরা বেকুব হয়ে যায়, আমি আর সরদার মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। আমিন বুঝতে পারে না ঘটনা কী! সহকারী দুজন বুঝতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, ঘটনা কী! ভাগ হবে দুটো, হয়ে যাচ্ছে তিনটে! এ রকম ঘটনা তো জীবনে দেখিনি! পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এ কাজ করছি। সরদার সাহেব, আপনার আর কোনো ওয়ারিশ আছে নাকি?

সরদার না, জবাব দিই আমি। ওয়ারিশ থাকলেই কি আপনাআপনি মাপ বদলে যাবে?

না, তা না। বললাম আর কী? ঘটনা খুবই আশ্চর্যজনক।

সরদার সাহেব চিন্তিত গলায় বলল, এটা হয়তো তোমাদের মনের ভুল। ভাগ হয়েছে দুটোই। দুভাগে খঁুটি পোঁতো।

যেদিন কাজ শেষ হলো সে রাতেই সরদার সাহেবকে সাপে কাটল। সকাল বেলা খবর পেয়ে যা বোঝার বুঝে গেলাম আমি। তিন ছেলের ভাগ দুই ছেলেকে দেওয়ায় প্রতিশোধ নিল তৃতীয়জন।

এই এতক্ষণ পর কথা বললেন কাশেম সাহেব। এ জন্যই সরদার সাহেবের মৃত্যুর দিন বকুলতলায় বসে তুমি চেয়ারম্যানের কথায়...

হ্যাঁ, পরিষ্কার করে কিছু বলিনি। এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। তবে সেদিনই আমি জানতাম ঘটনা আরও ঘটবে। সরদারবাড়িতে সেই ঘটনাই ঘটেছে। তৃতীয়জন তার দলবল নিয়ে এসে বাড়ির দখল নিয়েছে।

শাওন বলল, যদি তা-ই হয় তাহলে শুধু বাড়ির দখল নেবে কেন? ধানি জমির দখলও নেওয়ার কথা। তিরিশ বিঘা বাড়ির দশ বিঘা পড়বে তৃতীয়জনের ভাগে, দেড় শ কানি, মানে সাড়ে চার শ বিঘা ধানি জমির দেড় শ বিঘা পড়বে, সেই দেড় শ বিঘার দখলও নেওয়ার কথা।

ঢালি কথা বললেন না।

শুকনো মুখে নবু-রবু একসঙ্গে বলল, আমাদের এখন করণীয় কী?

আমার যা চিন্তা সেটা বলতে পারি। জানি না তাতে সমস্যা মিটবে কি না। মন বলছে মিটবে।

বকুল বললেন, সেটা কী, বলুন শুনি?

ধানি জমি আর ঘর-দুয়ারের প্রতি তৃতীয়জনের কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। তার আগ্রহ বাঁশঝাড়তলার ওদিকটা। ওখানে সে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করত। আমার মনে হয় বাড়ির ওদিককার দশ বিঘা মতো জমি নবু-রবু ব্যবহার না করে যদি তৃতীয়জনকে ছেড়ে দেয়, তাহলে সমস্যা মিটে যাবে। সে তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ওদিকটায় বসবাস করবে।

কাশেম সাহেব বললেন, কীভাবে ছাড়বে?

ওদিকটা ওরা দুভাই ব্যবহার করবে না। দরকার হলে দশ বিঘা পরিমাণ জায়গা কাঁটাতারে ঘিরে দেবে।

নবু-রবু মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর দুজন একসঙ্গে বলল, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এই মুহূর্তেই আমরা বাঁশঝাড়তলা আর বাগানের ওদিকটা ছেড়ে দিলাম। বাড়ি থেকে তারা চলে গেলে দু-এক দিনের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়ায় ঘিরে দেব। ওদিককার রাস্তা বন্ধ করে দেব। ওদিকে কেউ যাবে না।

ঠিক?

একদম ঠিক।

আমার মনে হয় তাহলে তোমাদের বাড়ি মুক্ত হয়ে যাবে।

ঢালি সাহেব কী রকম স্বস্তির মুখে শালিখের দিকে তাকালেন। ও শালিখ, রতনকে বলো চা দিতে। আরেক কাপ চা খাই।

সবার জন্যই চা করে আনল রতন। ঢালি সাহেবের চা শেষ হওয়ার আগেই দৌড়াতে দৌড়াতে এল বিলু। বাংলাঘরে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে নবুকে বলল, কাজ হয়ে গেছে বাবা। কিছুক্ষণ আগে বাড়ি থেকে সব সাপ উধাও হয়ে গেছে। একটাও নেই। দুলাল ভাইরা বাড়িতে ঢুকেছে। বাড়িঘর তন্নতন্ন করে খুঁজছে। একটা সাপও নেই।

বিলুর কথা শুনে ঘরের মানুষগুলো আবার বাকরুদ্ধ হলো। ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা খঁুজে পেল না কেউ।

শেষ কথা

সরদারবাড়ির বাঁশঝাড়তলার ওদিককার দশ বিঘা জমি কাঁটাতারে ঘিরে দিয়েছে নবু-রবু। বাড়ির লোকজনের ওদিকে যাওয়া নিষেধ। কেউ যায়ও না। কোনো কোনো পূর্ণিমা রাতে নজু ঢালি আসেন সরদারবাড়িতে। রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে অতিথিদের থাকার ঘরে থেকে যান। গভীর রাতে ঘুম ভাঙে তাঁর। নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরোন। এখন তাঁর বয়স এক শ এক বছর। লাঠি ভর দিয়ে হাঁটেন। চোখে মোটা লেন্সের চশমা। ঘর থেকে বেরিয়ে বাঁশঝাড়তলার ওদিকটায় আসেন। কাঁটাতারের এপাশে দাঁড়িয়ে বাঁশঝাড়তলার সবুজ এক টুকরো মাঠের দিকে তাকান। তাকিয়ে দেখেন এক জোড়া বিশাল সাপ জ্যোৎস্নায় ফণা তুলে আছে। তাদের চারপাশে কিলবিল কিলবিল করছে অনেকগুলো নানা আকৃতির সাপ। তার মানে তৃতীয়জনের বয়স হয়েছে। ছেলেমেয়ের ঘরে নাতি-নাতনি জন্মেছে। বিশাল পরিবার এখন। পূর্ণিমা রাতে পুরো পরিবার নিয়ে চড়তে বেরোয়। ওদের দিকে তাকিয়ে নজু ঢালি মনে মনে বলেন, সুখে থেকো বাছারা। ভালো থেকো।