ওহে, তুমি কি প্যাঁচা?

কিশোর বয়সে রাত জাগলে মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়. যার ফল ভোগ করতে হয় সারাজীবন।
কিশোর বয়সে রাত জাগলে মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়. যার ফল ভোগ করতে হয় সারাজীবন।

আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?

তাই বলে আমরা যদি সারা রাতই জেগে থাকি, তাহলে ২৪ ঘণ্টাই সকাল হয়ে থাকবে, এমন আশা করাটাও হবে চরম বোকামি। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে ফেসবুকে পড়ে থাকা যেমন কাজের কথা নয়, তেমনি টেবিলভরা বুক-এর দিকে ফেস রেখে চোখ কচলাতে থাকাও কাজের কথা নয়।

রাতে কতক্ষণ ঘুমাতেই হবে—এমন কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা যদিও নেই, তবু চিকিৎসকেরা বলেন, একজন কিশোর বা কিশোরীর দিনে মোটামুটি সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। এটা পড়ে কেউ আবার জিজ্ঞেস করতে পারো, দিনে সাত-আট ঘণ্টা ঘুমালে রাতে কী করব? তোমাদের জন্যই বলছি, এই দিন = ২৪ ঘণ্টা।

এ নিয়ে একটা গল্প আছে: এক রোগী এসে তার ডক্টরকে বলছে, ডক্টর ডক্টর, আমি আজ ২০ দিন হলো ঘুমাতে পারি না।

ডক্টর বললেন, অবিশ্বাস্য! এটা কীভাবে সম্ভব?

রোগী বলল, রাতে আট ঘণ্টা করে ঘুমালে দিনে না ঘুমানো খুবই সম্ভব।

তোমরা যারা রাত জেগে চ্যাটে থাকো, নেটে থাকো, মুঠোফোনে থাকো, গেমসে থাকো, কিংবা শুধু শুধুই খাটে থাকো, তারা শুনে রাখো, সাময়িক আনন্দ পেলেও দীর্ঘদিনের এমন অভ্যাস তোমার মধ্যে তৈরি করবে চরম অবসাদ। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের গবেষকেরা এ নিয়ে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১৫ হাজার ৫০০ কিশোর-কিশোরীর ওপর গবেষণা চালান। এই গবেষণাই আমাদের জানাল, যারা মধ্যরাতের পরও জেগে থাকে, তাদের অবসাদজনিত মানসিক সমস্যা হওয়ার প্রবণতা যারা মধ্যরাতের আগেই ঘুমিয়ে পড়ে তাদের তুলনায় প্রায় ২৪ শতাংশ বেশি। শুধু তা-ই নয়, একই গবেষণায় দেখা যায়, রাত জাগা কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার প্রবণতাও সাধারণের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। যারা বেশি বেশি রাত জাগে, তাদের কী বলা হয় জানো?  Night owl বা রাতের প্যাঁচা। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত রাতের প্যাঁচার নাম হলো হিটলার। উগ্র হিটলারকে অনুসরণ করা নিশ্চয়ই কাজের কথা না। ও হ্যাঁ, আরেকটি কথা। হিটলার জীবনভর শুধু ধিক্কৃতই হননি, ধিক্কৃত জীবনখানির অবসান করেছেন কিন্তু আত্মহত্যা করেই।

‘তুমি কি নৈশপ্রহরী নাকি যে তোমাকে রাত জেগে বসে থাকতে হবে?’ এটা শুনে আমার ভাগনে মেহেদী বলতেই পারে, ‘ভুল বললে মামা, আমাদের নাইট গার্ড মোটেও রাত জাগতে পারে না। বাড়ির সবার আগে সে-ই ঘুমায়।’

এই বয়সে রাতজাগার তাৎক্ষণিক ফল হলো ক্লাসে বসে ঝিমুনি (ছবিটি আয়োজন করে তোলা)
এই বয়সে রাতজাগার তাৎক্ষণিক ফল হলো ক্লাসে বসে ঝিমুনি (ছবিটি আয়োজন করে তোলা)

তবু আমি আমার ভাগনেকে সুযোগ পেলেই শুনিয়ে দিতে চাই, ‘ early to bed and early to rise, makes a man healthy, wealthy and wise’! কিন্তু আমি তাকে বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক হিলারি রুবিন্সতেইনের উক্তিটি শোনাতে চাইনি। তিনি বলেছিলেন, ‘ blessed are the night owls, for they shall inherit the mystery and magic of the night।’ তাকে বলতে পারি না আরেকটি প্রচলিত উক্তি: ‘ people who stay up late may generally be more intelligent than others, because staying up late is considered evolutionarily novel’, কিংবা বলি না সনামধন্য রাত জাগা প্যাঁচা থমাস এডিসন, উয়িন্সটন চার্চিল, জোসেফ স্তালিন, এলভিস প্রিসলি কিংবা এ আর রহমানের রাত জাগার কথাও। কারণ, আমি চাই না আমার ভাগনেটা রাত জাগুক। ওর সকালে স্কুল আছে, পড়া আছে। রাত জেগে ফেসবুকিং কিংবা গেমস খেলার চেয়ে ওটা ওর জন্য বেশি জরুরি। রাতে কম ঘুমিয়ে সকালে উঠুক, সেটাও আমি চাইতে পারি না। কারণ, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষণা কিন্তু এটাও বলেছিল যে যারা দিনে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমায়, তারা আট ঘণ্টা ঘুমানো কিশোর-কিশোরীদের তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়, আর অবসাদগ্রস্ত হয় ৭১ শতাংশের বেশি। তা ছাড়া যারা অতিরিক্ত রাত জাগে, তাদের শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, রাত জগলে রক্তের চিনি নিয়ন্ত্রণে সমস্যা তৈরি হয়, যার জন্য টাইপ টু ডায়বেটিস হতে পারে। এ ছাড়া দেহে স্ট্রেস হরমোনের পরিমাণ বাড়তে পারে, এমন কি বেড়ে যেতে পারে উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কাও। সম্প্রতি জার্মানদের এক গবেষণায় দেখা যায়, রাত জাগতে জাগতে একসময় ইন্সমিনিয়া হয়ে যেতে পারে। তখন কিন্তু তুমি চাইলেও ঘুমাতে পারবে না। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করা অসুখী ব্যক্তিদের তালিকায় তোমার নামটাও এন্ট্রি করতে হবে। তাঁরা আরও বলেছেন, যারা বেশি বেশি রাত জাগে, তাদের খারাপ নেশা করার প্রবণতাও বেড়ে যায়। কী ভয়ংকর কথা! অথচ তুমি কিনা পরীক্ষায় সামান্য দুটো নম্বর বেশি পাওয়ার আশায়ও মাঝেমধ্যে রাত জাগছ। কিন্তু তুমি কি জানো, মস্তিষ্কের সবচেয়ে ভালো বিকাশ কিন্তু ঘটে রাতে, ঘুমের মধ্যে। রাত জেগে তুমি একে যেমন বিশ্রাম নেওয়া থেকে বিরত রেখে তাকে চাপে ফেলছ, সেই সঙ্গে তাকে আবার বিকশিত হতেও বাধা দিচ্ছ। জীবনের পরীক্ষায় নম্বর কিন্তু উলটো কমেও যেতে পারে।

আমি তাই তাকে ও তোমাকে শুনাতে চাই আরনেস্ত হেমিং ওয়ের কথাটি। তিনি বলতেন, ‘আমি ঘুমাতে খুবই ভালোবাসি, আর যতক্ষণ আমি জেগে থাকি, ততক্ষণ আমার জীবনের একটা লক্ষ্যই থাকে, তা হলো আবার কখন ঘুমাব!’ আইরিশরা বলে, ‘চিকিৎসকদের বইয়ে লেখা সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হলো, সুন্দর হাসি আর দীর্ঘ ঘুম।’ তাই বলে সারাক্ষণ তো আর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে না, তাই না? বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লেওনার্দো দা ভিঞ্চি বলেছিলেন, ‘একটা সুন্দরভাবে কাটানো দিনই পারে ভালো একটা ঘুম উপহার দিতে।’ রাতে ভালো একটা ঘুমের আগে তাই দিনটাকেও সুন্দরভাবে কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। মানে, ভালোভাবে জেগে থাকতে হবে। মনে রেখো, তুমি ঘুমাচ্ছ না মানেই কিন্তু জেগে আছো, এমনটি নয়। অনেক মানুষই স্লিপ এপ্নিয়া নামের একধরনের রোগে ভোগে, যারা ঘুমের মধ্যে কথা বলে কিংবা হাঁটে। সুতরাং, হাঁটা-চলা, কথা বলাই জেগে থাকার একমাত্র প্রমাণ নয়, সত্যিকারের জেগে থাকা হলো মানুষের মতো বেঁচে থাকা, মানুষের জন্য বেঁচে থাকা। সুন্দরভাবে জেগে থাকা যেমন জরুরি, তেমনি সুন্দরভাবে ঘুমানোও সমান জরুরি।

‘আমাদের অফিসের মিটিংগুলো বেশ সফলভাবেই সম্পন্ন হয়।’ আমার এই কথা শুনে পাভেল বলল, ‘এর জন্য আপনি কী করেন?’

আমি বললাম, ‘তেমন কিছু না। মিটিংয়ের সময় ঘুমাই।’

ও বলল, ‘ও বুঝছি, এই জন্যই।’

আমার প্যাঁচাল পাড়া শেষ; এখন বলটা তোমার কোটে ছুড়ে দিলাম। তুমিই সিদ্ধান্ত নাও, তুমি কি রাত জাগা প্যাঁচা হবে, নাকি শুভ্র সকালের কোকিল হবে।

ছবি: কবীর শাহরীয়ার

মডেল: তাসনিম