ডিসি-১০-এর ককপিটে

ডিসি-১০-এর ককপিটঃ বাঁয়ে ক্যাপ্টেন, ডানে ফার্স্ট অফিসার ও পেছনে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।
ডিসি-১০-এর ককপিটঃ বাঁয়ে ক্যাপ্টেন, ডানে ফার্স্ট অফিসার ও পেছনে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।

এক.

রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস’ কিছুদিন আগে মহা ধুমধাম করে যে ‘ডিসি-১০’ উড়োজাহাজটিকে চিরবিদায় জানাল, যেটা আর কোনো দিন যাত্রীবাহী ফ্লাইট হিসেবে আকাশে উড়বে না, কয়েক বছর আগে আমরা সেটার ককপিটে চড়ে ঢাকা থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু যাওয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম।

এমন না যে লোকজন ইচ্ছা করলেই উড়োজাহাজের ককপিটে লাফ দিয়ে উঠে বসতে পারে, কিংবা ককপিটের প্রবেশাধিকার সবার জন্যে উন্মুক্ত কিন্তু বাংলাদেশ বিমানে অতি আপনজন প্রকৃতির পাইলট বন্ধুবান্ধব থাকায়, আমাদের মধ্যে কারও কারও আগে থেকেই বোয়িং অথবা ফকার অথবা এয়ারবাসের ককপিটে চড়ে আকাশ ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। তবে ডিসি-১০-এর ককপিটে সেবার ওই অভিজ্ঞতাটি ছিল দুর্ধর্ষ, রোমাঞ্চপূর্ণ, চাঞ্চল্যকর এবং প্রথম ও শেষ।

বার্মিংহামের উদ্দেশ্যে ডিসি-১০-এর শেষ উড়াল।
বার্মিংহামের উদ্দেশ্যে ডিসি-১০-এর শেষ উড়াল।

ডিসি-১০ সাধারণত পৃথিবীর এক মাথা থেকে আরেক মাথায় দূরপাল্লার রুটে চলাফেরা করে। ঢাকা থেকে কাঠমান্ডুর মতো অল্প দূরত্বে ডিসি-১০ পেয়ে যাওয়াটা ছিল প্রায় হঠাৎ করে পাওয়া।

আমাদের অতি কাছের বন্ধু মুসা ইব্রাহীম পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বত এভারেস্ট জয় করেছে। আমরা যাচ্ছিলাম তাকে ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নিয়ে আসতে।

(মুসা যখন এভারেস্ট অভিযানের যাওয়ার তহবিল সংগ্রহের জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে মাথা কুটে মরছিল, আমরা বন্ধু-বান্ধব ও চেনা-পরিচিতরা তখন নানা রকম ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে যে যার বাড়ির দুয়ারে শক্ত করে খিল এঁটে বসে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত যখন কাঠমান্ডু থেকে পাকা খবর এল, মুসা সত্যি সত্যি এভারেস্ট জয় শেষ করে পায়ে হেঁটে কাঠমান্ডুর দিকে রওনা দিয়েছে; তখন আমরা যারা তার অতি ‘আপনজন’, তাদের মধ্য একাধারে আনন্দ, বিস্ময়, গর্ব, অহংকার ও পাপবোধের অনুভূতি হতে থাকল। মূলত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যই আমরা স্থির করলাম— মুসাকে কাঠমান্ডু থেকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিয়ে আসা যাক, এতে যদি সে সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়।)

প্লেন ছাড়ার কয়েক ঘণ্টা আগে আমাদের ছোটখাটো দলটি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হলো। আমি ছাড়া দলের অন্য সদস্য সিমু নাসের, জিয়া ইসলাম  প্রথম আলো তেই কাজ করেন। ফখরুল আবেদীন (মিলন ভাই) একটা বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা (ব্যাংকিং-সংক্রান্ত নানা রকম কাজকর্মে প্রায়ই তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা দরকার হয়, এ কারণে আমরা সব সময় তাঁর মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করি)।

মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট-জয় উপলক্ষে তাঁর সংগঠন ‘নর্থ আলপাইন ক্লাব’ মুসার হাস্যোজ্জ্বল ছবি, এভারেস্টের চূড়া (হাতে আঁকা স্কেচ, যে এঁকেছে সে আগে কোনো দিন এভারেস্টের ছবি দেখেনি, এ কারণে এভারেস্টের চেহারা হয়েছে বালুর ঢিবির মতো) আর জাতীয় পতাকাসংবলিত একটা টি-শার্ট প্রস্ত্তত করেছে। সিমু আর জিয়ার গায়ে সেই টি-শার্ট সবচেয়ে ভালো ফিট করেছে। আমি কোনো রকমে শরীর মোচড়া-মুচড়ি করে টি-শার্টের মধ্যে নিজেকে আঁটিয়ে ফেলেছি। কিন্তু ফখরুল আবেদীনের অবস্থা হয়েছে সবচেয়ে করুণ। তার শরীর-স্বাস্থ্য একটু ভালোর দিকে, মিডিয়াম সাইজের টি-শার্টের কারণে একটু পরে পরে তার ভুঁড়ি বের হয়ে যাচ্ছে। তিনি বিব্রত মুখে টি-শার্ট টেনে টেনে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

ইমিগ্রেশন, কাস্টমস, সিকিউরিটি ইত্যাদি ঝামেলা শেষ করে আমরা প্রকা-ডিসি-১০ উড়োজাহাজের মধ্যে ঢুকে দেখি, আমাদের একেকজনের সিট পড়েছে একেক জায়গায়। আমি, জিয়া আর সিমু জানালার পাশে সিট চেয়েছিলাম, তা-ই পেয়েছি। কিন্তু মিলন ভাইয়ের সিট পড়েছে মাঝখানের সারিতে এবং তিনটা সিটের মাঝখানে। তার এক পাশে একজন বয়স্ক মানুষ (তাঁর ভয়াবহ ঠান্ডা লেগেছে, একটু পরপর বিকট হাঁচি দিচ্ছেন এবং টিস্যু দিয়ে নাক মুছছেন), অন্য পাশে প্রায় বাচ্চা একটা ছেলে (প্লেনে উঠলে অনেকেই অসুস্থ বোধ করলে বমি করে দেয়, এই ছেলেটা দেখা যাচ্ছে প্লেনে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থ বোধ করছে)।

ফখরুল আবেদীন আমার কানে কানে বললেন, ‘আমি টয়লেটে চলে যাচ্ছি। টয়লেটের জানালা দিয়ে প্লেনের টেকঅফ করা দেখব।’

আমিও তাঁর কানে কানে অভয় দিয়ে বললাম, ‘মিলন ভাই, টেনশন নিয়েন না। আমাদের জন্য বিরাট একটা সারপ্রাইজ আছে।’

‘কী সারপ্রাইজ?’ (কানে কানে ফিসফিস)

‘আমি আমাদের পাইলট বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। তিনি মনে হয় চেষ্টা করে দেখবেন, আমরা ককপিটে চড়ে যেতে পারি কি না। যদি হয়, তাহলে প্লেনের পাইলট হয়তো আমাদের ককপিটে ডেকে নেবেন।’

ফখরুল আবেদীনের মধ্যে ভরসা পাওয়ার কোনো নিশানা দেখা গেল না। তিনি বললেন (কানে কানে), ‘দূর, কখন ডাকে না ডাকে, ঠিক নেই। আমি কোনো দিন জানালা দিয়ে টেকঅফ করা দেখিনি। আজ দেখতেই হবে।’

আমি বললাম (কানে কানে), ‘তাই বলে কমোডে বসে টেকঅফ দেখবেন? এটা কেমন কথা? কমোডের সিটে কি সিটবেল্ট থাকে? আমার সিট জানালার পাশে। আপনি আমার সিটে বসেন।’

আমাদের কানাকানি দীর্ঘায়িত হলো না। ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট রাগী রাগী গলায় নির্দেশ দিতে শুরু করেছেন, ‘প্লিজ, আপনারা যে যাঁর সিটে বসে পড়ুন। কেউ দাঁড়িয়ে থাকবেন না, বসে পড়ুন। প্লিজ।’

একজন বিমানবালা (সুন্দর চেহারা, তবে তাঁর হৃদয়ের মতো মুখটাও মনে হয় শক্ত পাথর দিয়ে তৈরি) বোর্ডিং পাস দেখে আমাকে জানালার পাশে একটা সিটে বসিয়ে দিলেন। আমি আশপাশে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করেও কাছাকাছি কোথাও জিয়া ইসলাম কিংবা সিমু নাসের কিংবা ফখরুল আবেদীনকে আর দেখতে পেলাম না।

সব যাত্রী উঠে যাওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই ডিসি-১০ উড়োজাহাজ নড়তে শুরু করল। ট্যাক্সিওয়ে ধরে কিছুক্ষণ চলার পর, রানওয়ের যে অংশ থেকে টেকঅফের জন্য দৌড় শুরু করতে হয়, সেখানটাতে পৌঁছে কিছুক্ষণের জন্য থামল।

উড়াল দেওয়ার জন্য ইঞ্জিনের পুরো শক্তি দরকার হয়। পাইলটরা ককপিটে বসে যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করে প্লেনটাকে সেই পুরো শক্তি আদায় করার অবস্থায় নিয়ে আসতেই, আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে বিকট গর্জন শুরু হলো। সারা পৃথিবীতে একযোগে বজ্রপাত শুরু হলে যে আওয়াজ হওয়ার কথা, ডিসি-১০-এর তিনটি ইঞ্জিনের উৎপাদিত শব্দের কাছে সেটা অবশ্যই তুচ্ছ।

শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অতিকায় প্লেনটিও থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে। কাঁপুনির চোটেই যেখানে যত নাটবল্টু আছে, সব খুলে পড়ে যাওয়ার কথা। পাইলটরা তাই দেরি না করে তাঁদের যন্ত্রপাতি ধরে আবারও একটু নাড়াচাড়া করলেন। তাতে ডিসি-১০ ভয়ানক ভঙ্গিতে নিজে কাঁপতে কাঁপতে এবং সারা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দুর্বার গতিতে ছুটতে শুরু করল। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, পুরো বিমানবন্দরের উপস্থিত প্রত্যেকে নিশ্চয়ই সেই ভূমিকম্প টের পাচ্ছে।

এর মধ্যে দেখি, যাঁর যা দোয়া-দরুদ আর সুরা-কালাম জানা ছিল—কেউ বিড়বিড় করে, কেউ উচ্চ স্বরে পড়তে শুরু করেছেন। কয়েকজনের কোলে ছোট বাচ্চাকাচ্চা ছিল, তারা ভয় পেয়ে গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করেছে।

রানওয়ে ধরে কয়েক কিলোমিটার ছোটার পর, সামনের চাকা মাটি ছেড়ে কিছুটা ভেসে উঠতেই আমরা টের পেলাম, প্লেনের সামনের অংশ উঁচু হয়ে গিয়েছে। তখনই প্লেনের বিভিন্ন অংশে মুহুমু‌র্হু বিস্ফোরণ শুরু হলো। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, বিমানে আগে থেকে সন্ত্রাসীরা রিমোট কন্ট্রোল্ড অ্যাটম বোমা পেতে রেখেছিল, এখন সেগুলো রিমোট টিপে ফাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু ঘটনা হলো—আকাশে ওড়ার আগে পাখিরা যেমন ছোট্ট লাফ দেয়, ডিসি-১০-ও আলতো করে লাফ দিয়েছে। এতে যে প্রবল ঝাঁকুনি তৈরি হয়েছে, তাতে প্লেনের মধ্যে ঢিলেঢালা যা কিছু ছিল, সব খুলে পড়েছে। যেমন মাথার ওপর কেবিন লাগেজ রাখার যে হোল্ডার, সবগুলো ঢাকনা খুলে গিয়েছে। কয়েকজনের মাথায় টুকটাক জিনিসপত্র পড়ে মনে হয় টুকটাক ব্যথাও পেয়েছে। ইকোনমি ক্লাসের সামনে যাত্রীদের চিত্তবিনোদনের জন্য একটা বাক্সের মতো টেলিভিশন রাখা ছিল, সেটার কাভার খুলে পড়েছে। অবশ্য সেটার সামনে কেউ বসা ছিল না দেখে অল্পের জন্য রক্ষা।

একবার আকাশে উড়ে গেলে চাকাগুলো কোনো কাজে লাগে না বলে পাইলটরা ককপিটে বসে কয়েকটা বোতাম টিপাটিপি করে চাকাগুলো ভাঁজ করে বিমানের পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখেন। আকাশে উড়াল দেওয়ার কিছুক্ষণ পর ডিসি-১০-এর চাকাগুলো ভাঁজ করে রাখার সময় যে ভয়ানক আওয়াজ হতে লাগল, আমরা যাত্রীরা ধরে নিলাম— চাকাগুলো মোটেও প্লেনের পেটের মধ্যে ঢুকতে পারেনি, সেগুলো খুলে নিচে পড়ে গিয়েছে। কে জানে, কারও মাথার ওপর পড়েছে কি না।

প্লেন আকাশের অনেকখানি ওপরে উঠে যাওয়ার পর দেখি বিধ্বংসী আওয়াজ আর কাঁপাকাঁপি একেবারেই কমে গিয়েছে। তার পরও সাবধানের মার নেই ভেবে আমরা সিটবেল্ট শক্ত করে বেঁধে যে যার সিটে পাথর হয়ে বসে রইলাম।

মনটাকে সহজ করার জন্য জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি, ওপর থেকে ঢাকা শহরটাকে গুগল ম্যাপের মতো দেখা যাচ্ছে। রাস্তাঘাট হয়ে গিয়েছে সরু ফিতার মতো। পিঁপড়ার সারির মতো লাইন দিয়ে গাড়িঘোড়া চলছে। মানুষজনকে অবশ্য আলাদা করে চেনার উপায় নেই।

অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকা শহরের ঘিঞ্জি দালান-কোঠার স্তূপ পার হয়ে সবুজ মাঠ আর বিস্তীর্ণ জলাভূমি দেখা যেতে থাকে। আমরা যখন মাটির ওপর চলাফেরা করি, তখন শুধু রাস্তা আর আশপাশের ঘরবাড়ি, গাছপালা দেখতে পাই। ওপর থেকে যা দেখা যাচ্ছে, তার প্রায় বেশির ভাগই পানি।

কিছুক্ষণ বাদে সুন্দর চেহারার বিমানবালা (যার হৃদয়ের মতো মুখখানিও পাথরের তৈরি) ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীদের মধ্যে এসে জানতে চাইলেন, ‘মিস্টার নওরোজ ইমতিয়াজ কে?’

আমি হাত তুললাম।

বিমানবালা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন (তার মুখখানি এখন পাথরের তৈরি মনে হচ্ছে না, হৃদয়টা কী দিয়ে তৈরি কে জানে)। ‘স্যার, আপনি ক্যাপ্টেন এনামের বন্ধু?’

‘জি।’

‘দয়া করে আমার সঙ্গে আসবেন।’

‘কোথায়?’

‘এই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন আপনাকে ডেকেছেন।’

‘খুব ভালো। কিন্তু আমরা তো চারজন।’

‘আপনারা চারজনই আসবেন। অন্যরা কোথায়?’

আমি শত শত যাত্রীর মধ্য থেকে জিয়া ইসলাম আর সিমু নাসেরকে খুঁজে বের করে আনলাম। বিমানবালার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম, ‘আরেকজনকে টয়লেটে পাবেন। উনি টয়লেটের জানালা দিয়ে প্লেন টেকঅফ করা দেখতে গিয়েছেন।’

বিমানবালা বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কিন্তু টয়লেটে তো কোনো জানালা নেই।’

দুই.

যারা কোনো দিন প্লেনের ককপিট সামনাসামনি দেখেনি, হঠাৎ করে কোনো প্লেনের ককপিটে ঢুকিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলে, তারা অবশ্যই বড় ধরনের ধাক্কা খাবে।

ককপিটে ঢুকলেই প্রথমে যে দিকে চোখ যায়, সেটা হলো চারদিকে শুধু যন্ত্রপাতি। কত রকম যে সুইচ, গুনে শেষ করা যাবে না। কত রকম যে ডায়াল, সেগুলোতে দুর্বোধ্য আর সাংকেতিক ভাষায় কী বলা হয়, পাইলটরা ছাড়া দুনিয়ার অন্য কারও তা জানার কথা না।

যাত্রীদের কেবিনের তুলনায় ককপিটে ভয়াবহ আলো। সামনের উইন্ডশিল্ড আর দুই পাশের বড় বড় জানালা দিয়ে প্রচুর আলো আসছে। আমরা কিছুটা অন্ধকার থেকে এসেছি বলে চোখ ঝলসে যাওয়ার মতো অবস্থা।

প্লেনের পেছনে বসে ইঞ্জিনের বিকট গর্জনে মাথা ধরে যাচ্ছিল, ককপিটে কোনো আওয়াজ নেই, প্রায় সুনসান। খুব খেয়াল করলে অবশ্য একধরনের যান্ত্রিক গুঞ্জন শোনা যায়।

চারপাশে আকাশটা অদ্ভুত নীল। বড় মায়াময়। আমরা মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশের যে নীল দেখি, এই নীল সেই রকম না, কেমন জানি অপার্থিব ধরনের। একটু নিচের দিকে মেঘ আর মেঘ। কিছু মেঘ চুপচাপ স্থির হয়ে আছে। আরেক দল দলবেঁধে ধীরেসুস্থে কোথায় জানি যাচ্ছে। তাদের দেখাচ্ছে মরুভূমিতে বেদুইনদের কাফেলার মতো। মাঝেমধ্যে মেঘের ফাঁক দিয়ে মাটি দেখা যাচ্ছে—সবুজ অথবা বাদামি। হঠাৎ কোনো জলাভূমির পানি ঝিক করে ওঠে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে। খুব খেয়াল করে দেখলে অনেক নিচে আঁকাবাঁকা সরু ফিতার মতো গাঢ় রেখা যায়। ওগুলো নদী।

যাত্রীদের সিটের জানালা দিয়ে শুধু একটা দিক দেখা যায়। ককপিট থেকে দেখা যায় অন্তত তিন দিক। ডিসি-১০-এর বিশাল ককপিটে দাঁড়িয়ে আমাদের অনুভূতি হলো—আমরা আসলে একটা স্পেস শিপের কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে আছি। সামনের স্ক্রিনে যে গ্রহটা দেখা যাচ্ছে, আমরা এখন সেই গ্রহে অবতরণ করব। সাদা, নীল, বেগুনি আর অল্প অল্প বাদামি রং মিলিয়ে পৃথিবী নামক এই গ্রহটাকে দেখাচ্ছে অদ্ভুত রহস্যময়।

ককপিটে বসে প্লেন চালানোর জন্য পাইলটদের পাশাপাশি দুটো সিট। ক্যাপ্টেন বসে আছেন বাঁ দিকে। ডান দিকে ফার্স্ট অফিসার। তাঁর ঠিক পেছনে বসেছেন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।

আমরা চারজন ককপিটের সামনে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছি। টাইট-ফিটিংস কালো টি-শার্টের কারণে আমাদের নিশ্চয়ই প্লেন হাইজ্যাকারদের মতো দেখাচ্ছে। কালো মুখোশ আর পিস্তলটিস্তল থাকলে বোধ হয় আরেকটু বিশ্বাসযোগ্য হতো।

আমাদের ক্যাপ্টেন সাহেব একটু বয়স্ক ব্যক্তি। বুক পর্যন্ত সফেদ দাড়ি। ইউনিভার্সিটির রাগী প্রফেসরের মতো চেহারা। পথেঘাটে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে কেউ কোনো দিন বিশ্বাস করবে না, এই মানুষটা আস্ত একটা প্লেন নিয়ে আকাশে উড়ে বেড়ান।

আমরা চোখ বড় বড় করে বাইরের পৃথিবী, রংবেরঙের মেঘমালা আর পাইলটদের কর্মকাণ্ড দেখছি, ক্যাপ্টেন সাহেব পেছনে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘আমরা এখন ৩৪ হাজার ফুট অলটিচুডে আছি। স্পিড ঘণ্টায় ৩৫০ নট। আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এখানে দুটো সিট আছে। আপনারা চারজন তো? দুজন বসেন, দুজনকে একটু দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।’

আমি বুদ্ধিমানের মতো তাড়াতাড়ি ক্যাপ্টেনের ঠিক পেছনের সিটটা দখল করে ফেললাম। ককপিটে ঢোকার মুখেই যে ওয়াল-মাউন্টেড সিট, মুরব্বিজন বিবেচনায় সেখানে বসতে দেওয়া হলো ফখরুল আবেদীনকে। সিমু তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। জিয়া ইসলাম অতিশয় বিনয়ী হওয়ার কারণে সিট দখলের লড়াই থেকে ছিটকে পড়ে দরজাতেই দাঁড়িয়ে রইল।

ক্যাপ্টেন সাহেব ককপিটে তাঁর দুই সহকর্মী—ফার্স্ট অফিসার আর ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমরাও নিজেদের বিস্তারিত পরিচয় দিলাম। কিছু হালকা কথাবার্তার পর ক্যাপ্টেন সাহেব বললেন, ‘অন্য এয়ারক্রাফটে কিন্তু এত বড় ককপিট থাকে না। ডিসি-১০-এর ককপিট অনেক বড়। আমরা তিনজন বসার পরও দেখেন আরও দুটি এক্সট্রা সিট! আপনারা আরাম করে বসেন।’

আমি আর ফখরুল আবেদীন একটু নড়েচড়ে উঠে আরাম করে বসার ভঙ্গি করলাম।

ডিসি-১০-এর ককপিটের এই সুন্দর ছবিটি তুলেছেন বিশ্বখ্যাত এভিয়েশন ফটোগ্রাফার পল ডব্লিউ ফার্মানস্কি
ডিসি-১০-এর ককপিটের এই সুন্দর ছবিটি তুলেছেন বিশ্বখ্যাত এভিয়েশন ফটোগ্রাফার পল ডব্লিউ ফার্মানস্কি

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘এখনকার আধুনিক এয়ারক্রাফটে কিন্তু ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার দরকার পড়ে না। ডিসি-১০ যে আমলের, তখনকার দিনে লাগত। এখন তো টেকনোলজি উন্নত হয়েছে। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের কাজগুলো পাইলটরা নয়তো কম্পিউটারই করে ফেলে। বাংলাদেশ বিমানের অন্য এয়ারক্রাফট যেমন—এয়ারবাস বা বোয়িংয়ে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার নেই। ডিসি-১০ যেদিন থাকবে না, তাদের কাজও ফুরিয়ে যাবে। হা-হা-হা।’

ফখরু²ল আবেদীন সরল গলায় বললেন, ‘এই প্লেনটা কি সব সময় আপনারা তিনজনই চালান?’

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘না না। তা কেন হবে? ডিসি-১০ এয়ারক্রাফটের জন্য কয়েকজন করে ক্যাপ্টেন, ফার্স্ট অফিসার আর ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার আছেন। সারা মাসের রোস্টার বানানো থাকে—কার কবে-কখন ডিউটি, কার কবে অফ। আমরা সব সময় আগে থেকে জেনে আসি না, কোন ফ্লাইটে কার সঙ্গে কার ডিউটি পড়বে।’

ফার্স্ট অফিসার সাহেব এবার ক্যাপ্টেনকে দেখিয়ে বললেন, ‘স্যারের সঙ্গে আজ দুই মাস পরে ফ্লাই করছি।’

ফখরুল আবেদীন সহানুভূতির গলায় বললেন, ‘একেক সময় একেকজন থাকলে প্লেন চালাতে অসুবিধা হয় না? আই মিন, আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে সমস্যা হয় না?’

ফার্স্ট অফিসার হাসলেন, ‘সমস্যা হবে কেন? সবাই এসওপি মানে, স্ট্যাটার্ন্ড অপারেটিং প্রসিডিউর আছে, সেটা ফলো করে। পাইলটদের একেকজন একেক দেশের বা একেক ভাষার হলেও, সমস্যা নেই। ককপিটে বসে সবাই এক ভাষাতেই কথা বলে। ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেই।’

ফখরুল আবেদীনের বিস্ময় শেষ হয় না। তিনি ককপিটের সামনের জটিল চেহারার ইনন্ট্রুমেন্ট কনসোল দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে এত এত যন্ত্রপাতি, কোনটা কী কাজে লাগে, এগুলো মনে রাখতে সমস্যা হয় না?’

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘এগুলোই তো ট্রেনিংয়ের সময় একটা একটা করে শেখানো হয়। ধরেন, আপনার গাল চুলকাচ্ছে, আপনি নিশ্চয়ই আয়নার সামনে গিয়ে কোথায় চুলকাচ্ছে, সেটা দেখে তারপর চুলকাবেন না? জায়গামতো অটোমেটিক আঙুল চলে যাবে। ঠিক না?’

আমরা মাথা নাড়লাম। ঠিক। ঠিক।

ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্য তখনই আমার গালের দুই পাশে একটু একটু চুলকানি অনুভূত হতে লাগল। ক্যাপ্টেনের কথামতো আমার আঙুলও সত্যি সত্যি যথাস্থানে চলে গেল।

‘আমাদের যখন ট্রেনিং হয়, তখন পুরো ব্যাপারটা এমনভাবে ভাজা ভাজা করা হয়, চোখ বন্ধ করে হাত বাড়ালেও ঠিক জায়গামতো হাত চলে যাবে।’

ক্যাপ্টেন সাহেবের চেহারা এমনি এমনি ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের মতো হয়ে ওঠেনি। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে ককপিটের ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলের বিভিন্ন রকম যন্ত্রপাতি, সুইচ, লিভার, ডায়ালের সঙ্গে আমাদের পরিচিতিমূলক ক্লাস নিতে লাগলেন।

এসব ইনস্ট্রুমেন্টের কোনোটাতে জানা যাচ্ছে, প্লেন এখন কত উচ্চতায় আছে, কোনোটা দেখাচ্ছে—প্লেনের গতিবেগ কত, কোনোটাতে জানা যাচ্ছে—আশপাশে আর কোনো বিমান আছে কি না, থাকলে কত দূরে। সামনে কোথাও ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে কি না, পাহাড়-পর্বত-নদী-জলাশয় কোথায় কী আছে, ফুয়েলের কী অবস্থা, বাতাসের গতি কত, তাপমাত্রা কেমন—এ রকম দরকারি আর বিচিত্র নানা তথ্য-উপাত্ত এক নিমিষেই জানা যাচ্ছে।

ক্যাপ্টেন বলে যাচ্ছেন, ‘ডিসি-১০ তো অনেক পুরোনো এয়ারক্রাফট। এটার ইনস্ট্রুমেন্ট বলতে গেলে প্রায় অ্যানালগ। এখনকার আধুনিক এয়ারক্রাফটে সব ডিজিটাল ইনস্ট্রুমেন্ট। ম্যাপ বা চার্টের জন্যে মোটা মোটা বই হাতড়াতে হয় না, একটা ইএফবি মানে ইলেকট্রনিক ফ্লাইট ব্যাগ নয়তো আইপ্যাডে ইএফবি অ্যাপস থাকলেই কাজ চলে যায়।’

ফখরুল আবেদীন ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ভাগ্যিস পাইলট হইনি। আমাকে দিয়ে কোনো দিন এসব মনে রাখা সম্ভব ছিল না।’

ফার্স্ট অফিসার হেসে বললেন, ‘ভেবেন না, একবার যা শিখলেন, সারা জীবন ধরে সেটাই মনে রাখতে হবে। এক মডেল থেকে আরেক মডেলে গেলেও নতুন করে শিখতে হবে। তার আগে পুরোনো বিদ্যা মাথা থেকে মুছে ফেলতে হবে। ধরেন, আমি এখন ডিসি-১০-এর ফার্স্ট অফিসার, ডান দিকে বসি। আমাকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, ডান দিকে বসলে কীভাবে কী করতে হবে। আমি যখন ডিসি-১০-এর ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রমোশন পাব, তখন বাঁ দিকে বসব। তখন আবার বাঁ দিকের জন্য আবার ট্রেনিং নিতে হবে।’

ক্যাপ্টেন যোগ করলেন, ‘আবার এমন যদি হয়, ডিসি-১০ থেকে কেউ বোয়িং অথবা এয়ারবাসে যাচ্ছে, তখনো তাকে মাথা থেকে ডিসি-১০ তাড়াতে হবে, তারপর নতুন এয়ারক্রাফটের ওপর ট্রেনিং।’

জিয়া ইসলাম এতক্ষণ চুপ করে ছিল। সে বলল, ‘ট্রেনিংটা যে প্লেনে হয়, সেটা কী রকম? একই প্লেন? মানে যাত্রী থাকে?’

‘একই তো অবশ্যই। তবে শুরুতেই সত্যিকারের এয়ারক্রাফট না। প্রত্যেক মডেলের জন্য আলাদা আলাদা সিমুলেটর আছে। সিমুলেটর হচ্ছে বিশেষভাবে বানানো থ্রিডি ভিশন আর রিয়েলিস্টিক মোশনের একটা চেম্বার। সবকিছু একদম সত্যিকারের ককপিটের মতো। ইনস্ট্রুমেন্ট হুবহু এক। আকাশে উড়বে না, তবে একই রকম সিচুয়েশন তৈরি করা যাবে। সেভাবেই প্রোগ্রামিং করা আছে। সত্যি সত্যি টেকঅফ-ল্যান্ডিং বা ফ্লাই করার সময় যে অভিজ্ঞতা হয়, থ্রিডি ভিশনে আপনি তাই দেখবেন। রিয়েলিস্টিক মোশনে আপনি তাই অনুভব করবেন। আবার চাইলে বিশেষ সিচুয়েশনও ক্রিয়েট করা যাবে। ধরেন, আপনার মনে হলো, ফ্লাই করে টুইন টাওয়ারের ওপর গিয়ে পড়বেন। সেটা সিমুলেটরে সম্ভব। যতবার খুশি, ততবার। কিন্তু মজা হলো, আপনার কিছু হবে না। হা-হা-হা। সিমুলেটরে পাস করলে, তবেই সত্যিকারের এয়ারক্রাফট।’

ফার্স্ট অফিসার হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে সামনের রাডারের দিকে তাকিয়ে আমাদের বললেন, ‘আমাদের পাশ দিয়ে আরেকটা প্লেন ক্রস করছে। বাঁয়ে তাকালেই দেখবেন, তাড়াতাড়ি।’

আমরা সবাই বাঁয়ে তাকালাম। একটু নিচুতে অনেক দূর দিয়ে সাঁই করে একটা মিসাইলের মতো কী জানি ছুটে যেতে দেখা গেল।

ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের সামনে রেডিও খড়খড় করে উঠতে, তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। ওপাশে একটা নারীকণ্ঠ। কী কী জানি কথাবার্তা হলো। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হেসে বললেন, ‘ওই ফ্লাইটটা দিল্লি থেকে ব্যাংকক যাচ্ছে। এয়ার ইন্ডিয়া।’

এবার ক্যাপ্টেন বললেন, ‘এবার ডান দিকে তাকান। মাথার ওপর দিয়ে আরেকটা যাবে।’

সত্যি সত্যি আরেকটা বিমানকে দেখা গেল আমাদের কিছুটা ওপর দিয়ে আড়াআড়ি ডান দিক থেকে বাঁ দিকে চলে গেল।

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘ওটা বোয়িং ট্রিপল সেভেন। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস।’

বিমান চালানোর নিয়মকানুন বিষয়ে ক্যাপ্টেন সাহেবের চমৎকার বক্তৃতা আর ককপিটে বসে থাকার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের চারজনের মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস জন্ম নিল। যা দেখা যাচ্ছে, বিষয়টা খুব কঠিন কিছু না। আরও কয়েকবার সামনাসামনি দেখার সুযোগ পাওয়া গেলে, এরপর নিজেরা একটু চেষ্টা করে দেখলে, বলা যায় না, প্লেন চালানোর কাজটা সবাই শিখেও ফেলতে পারি।

বিমানবালা (আগেরজন না, ইনি একটু বয়স্কা) ট্রেতে করে প্রচুর খাবারদাবার নিয়ে এসেছেন। সুস্বাদু খাবারের গন্ধে পুরো ককপিট ম-ম করছে। জটিল-দর্শন যন্ত্রপাতিগুলো না থাকলে অবলীলায় ককপিটটাকে এ মুহূর্তে রেস্তোরাঁ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেত। আমরা কেউ সমুচায় কামড় দিয়ে, কেউ চামুচে করে একটু ফিরনি মুখে দিয়ে, কেউ কলার খোসা ছিলতে ছিলতে পাইলট সাহেবের লেকচার শুনছি।

আমি বসেছি বাঁ দিকের জানালা ঘেঁষে। রোদটা সরাসরি আমার মুখে এসে পড়ছে। রোদের তীব্রতা থেকে বাঁচতে ক্যাপ্টেন সাহেবকে দেখেছিলাম, তাঁর বাঁ পাশের জানালার পাশে ছায়ার জন্য একটা সবুজ শেডের সানভিজর নামিয়ে রেখেছেন। সূর্যের অবস্থান একটু সরে যাওয়ায় সেটা অবশ্য এখন তাঁর দরকার হচ্ছে না। তিনি কথা বলায় ব্যস্ত, কাজেই আমি খুব সাবধানে সানভিজরটা আমার কাছাকাছি সরিয়ে আনতে টানাটানি করতেই দেখি, জিনিসটা তার হুক থেকে খুলে চলে এসেছে।

ঘটনা এখানেই শেষ না।

আমি জিনিসটা আবার হুকের সঙ্গে আগের মতো আটকে দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে পরপর কয়েকটা ছোট ছোট দুর্ঘটনা ঘটল। জানালার পাশে কনুইয়ে ভর রেখে আমি একটু বাঁ দিকে ঝুঁকতেই, সেখানকার শেলফে একটা মোটা বই রাখা ছিল, সেটা আমার সিটের ফাঁকে পড়ে গেল। আমি সেই পতন ঠেকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সিমু নাসেরের গায়ে একটু ধাক্কা লেগে থাকতে পারে। সিমুর হাতে ছিল চায়ের কাপ। চা যেন ছলকে না ওঠে, সে জন্য সে চায়ের কাপটা উঁচু করে ধরল। তাতেও শেষ রক্ষা হলো না, অল্প কয়েক ফোঁটা ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের গায়ে পড়ল। তিনি লাফ দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সিটবেল্ট বাঁধা থাকায় তিনি চট করে নড়তে পারলেন না। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের কাছাকাছি বসে ছিলেন ফখরুল আবেদীন। তাঁর হাতে ছিল পায়েসের বাটি। ধাক্কা খেয়ে সেই বাটি উল্টে গেল। পাশেই হাঁটু গেড়ে বসে ছিল সিমু নাসের। পায়েসের কিছু অংশের ভাগ পেল তাঁর টি-শার্ট।

একটা যাত্রীবাহী বাসের ড্রাইভারের কাছাকাছি এসব ঘটনা ঘটলে, বাসটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের ধানখেতে চিৎ হয়ে পড়ে থাকত। এবং এসব তুলকালামের কারণে ডিসি-১০ প্লেনটারও আকাশ থেকে দুম করে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ার কথা ছিল। নিদেনপক্ষে একটু কেঁপে উঠলেও হয়তো পারত।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না। যেভাবে উড়ছিল, সেভাবেই উড়তে থাকল।

আমার তিন সহযাত্রী আমার দিকে যেভাবে চোখ গরম করে তাকাচ্ছে—আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় প্লেন থেকে নামিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে, সন্দেহ নেই তারা আমাকে ঘাড় ধরে আকাশের মাঝখানে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত।

তবে ক্যাপ্টেন সাহেব যেহেতু শুধু প্রফেসরদের মতো দেখতেই নন, তাঁর মনটাও অতি নরম। তিনি শান্ত মুখে বললেন, ‘টেক ইট ইজি। আপনাদের লাগেনি তো?’

আমরা প্রত্যেকে খুব তাড়াতাড়ি কয়েকবার মাথা নেড়ে ভাব করলাম, লাগার প্রশ্নই আসে না।

সিমু নাসের ব্যাপারটা হালকা করার জন্য বলল, ‘প্লেন চালানো তো সোজা দেখছি। বসে বসে গল্প করা আর খাওয়াদাওয়া করা। পাইলটদের কিছুই করতে হয় না।’

ক্যাপ্টেন সাহেব বললেন, ‘এখন অটোপাইলটে চলছে। কোর্স সেট করে দেওয়া আছে। জায়গামতো পৌঁছে যাবে। গ্রাউন্ডে বসেই ফ্লাইট ম্যানেজমেন্ট কম্পিউটার-এফএমসিতে প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য দরকার হলে এখনো যেভাবে খুশি প্রোগ্রাম বদলে দেওয়া যাবে।’

‘বাহ্‌। তাহলে পাইলটের দরকার কী? অটোপাইলটে দিয়ে বসে থাকলেই হয়।’

‘অটোপাইলট দিয়ে টেকঅফ হবে না। ল্যান্ডিং হবে না।’

‘আপনার সামনে স্টিয়ারিংয়ের মতো দেখতে ওই জিনিসটা কী?’

‘কন্ট্রোল কলাম। এটা দিয়েই তো পুরো জাহাজ কন্ট্রোল করা হয়। চালাতে চান?’ ক্যাপ্টেন সাহেব ভুরু নাচালেন।

সিমু নাসেরের ভাবভঙ্গি দেখে এতক্ষণ মনে হচ্ছিল, সে প্লেন চালানোর বিষয়টা প্রায় শিখে গিয়েছে। সত্যিকারের প্লেন না হোক, সিমুলেটরে নিয়ে বসিয়ে দিলে সে নিশ্চয়ই টুইন টাওয়ারে গিয়ে ছোটখাটো ধাক্কা দিতে পারবে। কিন্তু ক্যাপ্টেন সাহেবের প্রস্তাব শুনে তার ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা হলো। আরও কয়েকবার সাধাসাধি করা হলে, সে বোধ হয় মানইজ্জতের খাতিরে রাজিও হয়ে যেতে পারত।

কিন্তু আমরা বাকি তিনজন নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার খাতিরে প্রতিবাদ করে উঠলাম, ‘না না। আগে আমাদের নামিয়ে দেন।’

ক্যাপ্টেন সাহেব মুচকি হেসে তাঁর জটিল জটিল ইনস্ট্রুমেন্টগুলোর মধ্যে একটা সুইট অফ করে দিয়ে কন্ট্রোল কলাম শক্ত হাতে ধরলেন, ‘এই দিলাম অটোপাইলট অফ করে। কন্ট্রোল এখন আমার হাতে। এই দেখেন ডাইভ দিচ্ছি।’

ক্যাপ্টেন সাহেব কন্ট্রোল কলাম সামনের দিকে ঠেলে দিতেই ডিসি-১০ নাক নিচু করে নিচের দিকে নামতে শুরু করল। আমরা এতক্ষণ সামনের জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে পাচ্ছিলাম, হঠাৎ সেখানে পৃথিবীর অর্ধগোলাকৃতি অংশটা ফুটে উঠল।

‘এই দেখেন, এবার ওপরে উঠে যাচ্ছি।’

ক্যাপ্টেন সাহেব কন্ট্রোল কলাম নিজের দিকে টানলেন। ককপিটের সামনের জানালায় পৃথিবী অদৃশ্য হয়ে গিয়ে সেখানে নীল আকাশ ভেসে উঠল।

ক্যাপ্টেন সাহেব অবশ্য কন্ট্রোল কলাম ডানে-বাঁয়ে ঘুরিয়ে প্লেনটাকেও ডানে-বাঁয়ে কাত করিয়ে দেখালেন। তারপর আবার অটোপাইলটের সুইচ অন করে দিলেন।

সিমু নাসের বলল, ‘প্লেনটাকে উল্টা করে ফেলেন না প্লিজ। ওই যে সিনেমায় যেমন দেখায়, ফাইটার প্লেনগুলো উল্টা হয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে যাচ্ছে।’

ক্যাপ্টেন সাহেব অট্টহাসি দিয়ে বললেন, ‘ওটা ফাইটার প্লেনেই সম্ভব। এটা প্যাসেঞ্জার প্লেন। এটা উল্টানো দূরে থাক, একটু বেশি অ্যাঙ্গেলে টার্ন করলেই যাত্রীদের খবর হয়ে যাবে।’

আমরাও যেহেতু এই বিমানের যাত্রী, কাজেই নিজেদের খবর হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ঘটানোর ঝুঁকি নিতে আমরা কেউ রাজি হলাম না।

 তিন.

 আমাদের উড়োজাহাজটা মনে হয় নেপালের সীমানায় ঢুকে পড়েছে। নিচে রুক্ষ চেহারার পাহাড়-পর্বত দেখা যাচ্ছে।

ক্যাপ্টেন সাহেব হাত উঁচু করে একদিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘ওই দিকে এভারেস্ট। আকাশ পরিষ্কার থাকলে, আপনারা দেখতে পেতেন।’

আমরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে নির্মল আকাশ ছাড়া অবশ্য কিছু দেখতে পেলাম না।

‘নিচে তাকান। সরু রুপালি ফিতার মতো কী দেখা যায় বলেন তো?’

আমরা সমস্বরে বললাম, ‘নদী। নদী।’

‘নদী তো বুঝলাম। কী নদী?’

আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। ক্যাপ্টেন বললেন, ‘ওটা গঙ্গা। এটাই ভারতের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে পড়েছে। নাম হয়েছে পদ্মা।’

ফার্স্ট অফিসার সাহেব রেডিওতে কার সঙ্গে জানি কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন। ইংরেজি ভাষা, কিন্তু এত বেশি টেকনিক্যাল শব্দের ছড়াছড়ি, আমরা একবর্ণও বুঝতে পারলাম না।

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘আমরা কাঠমান্ডুর কাছাকাছি চলে এসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ল্যান্ড করব। আপনারা চারজন তো একসঙ্গে ককপিটে থাকতে পারবেন না। দুজন পারবেন, দুজনকে চলে যেতে হবে। যাঁরা থাকবেন, তাঁদের অবশ্যই সিটবেল্ট বাঁধতে হবে। ল্যান্ডিংয়ের সময় কারও সিটবেল্ট ছাড়া চলবে না।’

জিয়া ইসলাম আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র, অমায়িক, আত্মত্যাগী, বিনয়ী ও বিবেচক। একটু আগে সে তার বিনয় দেখিয়েই সিটে বসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এবারও সে তার ভদ্রতা, অমায়িকতা, আত্মত্যাগ, বিনয় ও বিবেচনাবোধের পরিচয় দিয়ে উল্টো ঘুরে নিজের সিটের দিকে রওনা হলো।

আমি টুক করে নিজের সিটবেল্ট বেঁধে নিয়ে বাঁ দিকে তাকিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে নিচে নেপালের কঠিন শিলামণ্ডিত ভূপ্রকৃতি অবলোকন করতে লাগলাম।

ফখরুল আবেদীন সিটে বসে ছিলেন, তিনি পেছন থেকে সিটবেল্ট টেনে এনে কোমরে বেঁধে ফেললেন। সিমু নাসেরের এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার বিশেষ ইচ্ছা ছিল না। সে মরিয়া হয়ে ফখরুল আবেদীনের কোলের ওপর বসে পড়ল।

ক্যাপ্টেন সাহেব পেছনে তাকিয়ে খুবই বিব্রত হয়ে বললেন, ‘আহা। সিট তো মাত্র দুটো। আরেকটা সিট থাকলে না-হয় হতো। কিন্তু সিটবেল্ট তো বাঁধতেই হবে।’

ফখরুল আবেদীন পেছন থেকে দুই হাত দিয়ে সিমুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। এই যে সিমুর সিটবেল্ট বেঁধে ফেললাম। আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।’

সিমু বলল, ‘হ্যাঁ। অসুবিধা হলে ল্যান্ড করার পর পেছনে চলে যাব। ল্যান্ডিংটা ককপিটে বসে দেখতে চাই।’

ক্যাপ্টেন সাহেবের চেহারায় সত্যি সত্যি একরাশ বেদনা এসে ভর করেছে, ‘দুঃখিত। এভিয়েশন রেগুলেশন মানতেই হবে।’

অতএব, সিমু নাসের আর ফখরুল আবেদীনকে নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতায় আসতে হলো। ফখরুল আবেদীন বিষণ্ণ ভঙ্গিতে প্যাসেঞ্জার কেবিনের পথ ধরলেন।

ক্যাপ্টেন সাহেব ল্যান্ডিংয়ের প্রস্ত্ততি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ককপিটের জটিল-দর্শন কনসোলের শত শত ইনস্ট্রুমেন্টের ওপর তার হাত বিদ্যুতের মতো নেচে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে।

ডিসি-১০ এরই মধ্যে অনেকখানি নিচে নেমে এসেছে। পাহাড়-পর্বতের চূড়াগুলো খুব এখন খুব কাছাকাছি। একটু এদিক-ওদিক হলেই প্লেনের সঙ্গে ঘষা খেয়ে যাবে, এমন অবস্থা। এরই মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে একরাশ মেঘ এসে চারপাশ অদৃশ্য করে ফেলল। শুধু সাদা আর সাদা। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। মেঘের মধ্যে পড়ে বিশাল প্লেনটা জোরে জোরে কয়েকবার কেঁপে উঠল।

ক্যাপ্টেন পেছনে না তাকিয়ে বললেন, ‘এই মেঘটা সব সময়ই থাকে। একটু রিস্কি। এখনই পার হয়ে যাব।’

বলা মাত্র মেঘ সরে গেল। একদম সামনেই বিশাল এক পর্বত দেখি দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘বুঝলেন। কাঠমান্ডু শহরটা আসলে বিশাল একটা উপত্যকা। চারদিকে পাহাড়। ওই যে সামনে পাহাড় দেখছেন, ওটা পার হয়েই আমরা বিশাল ডাইভ দেব। দিয়েই নেমে যাব। ওই পাহাড়টা পার হওয়ার সময় ডিসট্যান্স খুব সামান্য থাকবে। ৭০০ ফুটের মতো। দেখবেন, কেমন ট্যাঁ ট্যাঁ করে।’

ক্যাপ্টেনের বক্তব্যের প্রমাণ দিতেই একটু পর ককপিটের মধ্যে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করল। ক্যাপ্টেন বললেন, ‘পাহাড়চূড়াটার সঙ্গে ডিসট্যান্স কমে আসছে। সেটাই অ্যালার্ট করছে। চাইলে বন্ধ করে দেওয়া যায়। কিন্তু বন্ধ করব না।’

ককপিট থেকে নিচের দিকে তাকালে সবকিছু কেমন অপা্থিব মনে হয়
ককপিট থেকে নিচের দিকে তাকালে সবকিছু কেমন অপা্থিব মনে হয়

ডিসি-১০ পাহাড়-চূড়াটা পার হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য অ্যালার্ম থেমে গেল। আকাশের অনেক ওপরে থাকার সময় মনে হচ্ছিল, প্লেনটা বুঝি খুব ধীরে ধীরে চলছে। নিচে নামতে শুরু করার পর দেখা গেল, ভয়ানক গতিতে সাঁই সাঁই করে সবকিছু সরে যাচ্ছে। পর্বতের চূড়া অদৃশ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সামনের জানালায় কাঠমান্ডু শহরটা ভেসে উঠল। ছোটছোট দালানকোঠা, আঁকাবাঁকা পথঘাট।

ক্যাপ্টেন বলে যাচ্ছেন, ‘ল্যান্ড করাই সবচেয়ে কঠিন। আজ পর্যন্ত যতগুলো এয়ার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে ফাইনাল অ্যাপ্রোচের সময়, এয়ারপোর্টের কাছাকাছি। যে পাহাড়টা পার হয়ে এলাম, সেটা খুবই রিস্কি। একবার পিআইএর একটা এয়ারবাস এথ্রি-১০ সেটার চূড়ায় ক্রাশ করেছিল।’

আমাদের বুক শুকিয়ে গেল। ক্যাপ্টেন সাহেবকে এখন আর আগের মতো হাসিখুশি দেখাচ্ছে না। তাঁর মুখচোখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। তাঁকে এখন দেখাচ্ছে সত্যিকারের পাইলটদের মতো। তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে ইনস্ট্রুমেন্ট কনসোলের যন্ত্রপাতি টেপাটেপি করছেন। ফার্স্ট অফিসার আর ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের চোখেমুখেও সিরিয়াস ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, প্লেনের কলকবজা বুঝি সব বিকল হয়ে গিয়েছে। একটু পরেই বোধ হয় প্যারাস্যুট নিয়ে লাফ দিতে বলা হবে।

আমাদের প্লেনটা খুব নিচু দিয়ে ডানে-বাঁয়ে কয়েকবার কাত হয়ে চক্কর খাওয়ার পর সোজা হতেই দেখি, সামনে একটা সরলরেখা দেখা যাচ্ছে।

রানওয়ে!

ক্যাপ্টেন সাহেব কন্ট্রোল কলাম ধরে নাড়াচাড়া করে খুব তাড়াতাড়ি প্লেনটাকে রানওয়ে বরাবর নিয়ে এলেন। সমতল এলাকায় এ কাজটা করার জন্য মনে হয় একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টে সেই সুযোগ সামান্য। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমাদের প্লেনটা রানওয়ের খুব কাছাকাছি নেমে গেল। ক্যাপ্টেন সাহেব বোতাম টিপে চাকাগুলো ভাঁজ খুলে বের করে দিয়েছেন।

ককপিটের মধ্যে একটা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর খুব বিচলিত হয়ে দশের ঘরের নামতা উল্টোদিক থেকে পড়তে শুরু করেছে।

‘হানড্রেড... নাইন্টি... এইটি... সেভেনটি... সিক্সটি...’

আমরা ককপিটের অতিথিরা নিঃশ্বাস আটকে অবতরণের প্রক্রিয়া দেখছি। প্রথমে পেছনের চাকা রানওয়ে স্পর্শ করল, পর মুহূর্তে সামান্য লাফিয়েই উঠল, তারপর মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেনটা রানওয়েতে নেমে ভয়ানক গতিতে ছুটতে লাগল। আকাশে থাকতে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু ল্যান্ডিংয়ের সময় এত বিশাল উড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারাটাই দেখা গেল সবচেয়ে দুরূহ। একবার ডানে চলে যেতে যায় তো পর মুহূর্তেই বামে চলে যেতে চায়। ক্যাপ্টেন সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে কন্ট্রোল কলাম শক্ত হাতে ধরে রেখেছেন। তাঁর চোখ বিস্ফারিত, যেন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে হচ্ছে।

প্রথমে মনে হচ্ছিল, এত বড় উড়োজাহাজটাকে বোধ হয় কোনো দিন থামানো যাবে না। একসময় রানওয়ে ফুরিয়ে যাবে, তারপর আমরা শেষ মাথায় গিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে কয়েক হাজার ফুট নিচে পড়ে যাব। সেই সঙ্গে আমরাও আলুভর্তা হয়ে যাব। কিন্তু প্লেনটা রানওয়ের সমান্তরালে ঠিকমতো বসে যেতেই ক্যাপ্টেন সাহেব সর্বশক্তি দিয়ে দুই পায়ে ব্রেক প্যাডেল চেপে ধরেছেন। তাতেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গতি একদম কমে এল।

ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে পরে জেনেছিলাম, কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট গোটা পৃথিবীর মধ্যে শীর্ষ পাঁচটা বিপজ্জনক এয়ারপোর্টের মধ্যে একটা। আমাদের দেশের পাইলটরা সীমাহীন দক্ষতায় প্রতিদিন সেখানে কোনো ঝামেলা ছাড়াই ডিসি-১০-এর মতো প্রাগৈতিহাসিক উড়োজাহাজ নিরাপদে নামান ও ওঠান। তাঁদের এই সীমাহীন দক্ষতার সামান্য নমুনা চাক্ষুষ করে আমাদের বুক গর্বে ১০ হাত ফুলে উঠল।

চার.

অবতরণ করে ফেলার পর অবশ্য আবার সেই সাদাসিধে দৃশ্য। প্লেনটা ধীরেসুস্থে  ////////ট্যাক্সিয়িং///////  করে এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ভবনের সামনে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ককপিটের তিনজন ক্রু ব্যস্ত ভঙ্গিতে একের পর এক সুইট টেপাটেপি করে যাচ্ছেন। ফার্স্ট অফিসারকে দেখা গেল, বিজাতীয় ভাষায় রেডিওতে কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছেন। ক্যাপ্টেন এখনো ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেল নিয়ে ব্যস্ত। ইঞ্জিনের আওয়াজ কমে এসেছে। একধরনের ভাইব্রেশন টের পাওয়া যাচ্ছিল, সেটা এখন বন্ধ।

বিমানবালা এসে জানতে চাইলেন, ‘স্যার। গেট ওপেন করে দেব?’

ক্যাপ্টেন তাকে হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে আরও কী কী জানি সুইচ টিপে বন্ধ করে দিলেন।

আমি বাঁ পাশের জানালা দিয়ে একটু পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এয়ারপোর্টের লোকজন এরই মধ্যে বিশাল যান্ত্রিক সিঁড়ি এনে প্লেনের দরজার সঙ্গে ফিট করে দিয়েছে। বাইরে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সবার গায়ে কয়েক প্রস্থ গরম কাপড়। কাঠমান্ডুতে মনে হয় ব্যাপক ঠান্ডা। ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার সময় তো এসির মধ্যে বসেও দরদর করে ঘামছিলাম।

ক্যাপ্টেনও কিছুক্ষণ পর বাঁ দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার, গেট খুলছে না কেন?’

এর মধ্যে বিমানবালা আপু আবার ককপিটের দরজায় উদয় হলেন। ‘স্যার। মনে হয় সমস্যা হয়েছে। গেট খুলছে না।’

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘কী সমস্যা? গেট খুলবে না কেন? দেখো জ্যাম হয়ে আছে কি না।’

আমাদের ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার এতক্ষণ তেমন কথাবার্তা বলেননি। তিনি তাঁর ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সমস্যা হওয়ার তো কথা নয়। এয়ার প্রেশার লেভেল করে দিয়েছি। খুলে যাওয়ার কথা।’

ক্যাপ্টেন সাহেব আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বুঝলেন, কেবিনের এয়ার প্রেশার আর বাইরের এয়ার প্রেশার সমান না হলে গেট খুলবে না। ঢাকা শহর তো সি-লেভেলের কাছাকাছি। কিন্তু কাঠমান্ডু এয়ারপোর্ট চার হাজার ৪০০ ফুট উঁচুতে। আমরা কেবিনের মধ্যে পাঁচ থেকে আট হাজার ফুটের এয়ার প্রেশার মেইনটেইন করি। এখন এটা কমাতে হবে।’

ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার তাঁর সামনের প্যানেলে পাশাপাশি দুটো ডায়াল দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে তো দেখাচ্ছে দুটোই লেভেলে আছে। এই যে এটা বাইরের এয়ার প্রেশার, এটা কেবিন এয়ার প্রেশার। দুটোই সমান।’

ফার্স্ট অফিসার ডান পাশ থেকে চাপা গলায় বললেন, ‘৩০ থেকে ৪০ বছর বয়স হয়েছে। আর কত! জাদুঘরে রাখার টাইম হয়ে গেছে।’

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘প্রেশারাইজেশনে গোলমাল মনে হচ্ছে। আপনার ডায়াল ঠিক আছে তো? চেক করেন আবার।’

ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার মানুষটা মনে হয় কম কথা বলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে স্ক্রু ড্রাইভার বের করে দেয়াল-জোড়া ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলের একটা অংশের কয়েকটা স্ক্রু খুলে ফেললেন। তাতে বাইরের কাভারটা আলগা হয়ে খুলে এল। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার সেটা এক পাশে সরিয়ে রেখে ডায়ালের দিকে তাকিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘দেখলেন কারবারটা! আমি বাইরে থেকে লিভার ঘুরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ভেতরে ঘোরেনি।’ বলেই তিনি ভেতরের লিভারটা ঘুরিয়ে নির্দিষ্ট অবস্থানে নিয়ে এলেন।

সিমু নাসের তার কান চেপে ধরে বলল, ‘কান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’

ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার বললেন, ‘হ্যাঁ। তাই হওয়ার কথা। কেবিন প্রেশার এবার কমে যাচ্ছে। আপনার কানের ভেতরের এয়ার প্রেশারের সঙ্গে এখনো অ্যাডজাস্ট হয়নি। এ জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।’

ক্যাপ্টেন সাহেব বিমানবালাকে বিজয়ীর ভঙ্গিতে বললেন, ‘এবার চেষ্টা করেন। এখন গেট খুলে যাওয়া উচিত।’

সিমু বলল, ‘যদি না খোলে, তাহলে কি তালা-চাবিওয়ালাকে খবর দিতে হবে? নাকি ভাঙতে হবে?’

ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘না, তাহলে আমরা আবার ঢাকায় ফিরে যাব।’

এক মিনিটের মাথায় দেখা গেল, গেট খুলে গিয়েছে। যাত্রীরা লাইন ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। প্রায় সবাই নেমে যাওয়ার পরে, ফখরুল আবেদীন আর জিয়া ইসলামকে দেখা গেল ককপিটের দরজায় (হিংসা ও ঈর্ষায় তাঁদের চোখ ছোট ছোট হয়ে গিয়েছে)। তাঁরা আমাদের দেখে অত্যন্ত শীতল গলায় বললেন, ‘কী ভাই, নামবেন না? ঢাকায় ব্যাক করবেন নাকি?’

আমরা ক্যাপ্টেন, ফার্স্ট অফিসার আর ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে করমর্দন করে ককপিট থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে হিমহিম ঠান্ডা আবহাওয়া। টি-শার্ট পরে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না মনে হয়।

কাঠমান্ডুর আকাশে বিকেলের রোদটা নিরুত্তাপ, কিন্তু বেশ চড়া। সেই সোনালি আলোয় বাংলাদেশ বিমানের ধবধবে সাদা ডিসি-১০ উড়োজাহাজটাকে অদ্ভুত রহস্যময় দেখাচ্ছে।