পিঙ্ক ফ্লয়েডের বাড়ির ডিজাইনার তানভীর

পিঙ্ক ফ্লয়েড সব সময় দেয়াল ভাঙার কথা বলে। তাই তানভীর পিঙ্ক ফ্লয়েডের বাড়ির নকশা করেছেন দেয়াল ছাড়াই
পিঙ্ক ফ্লয়েড সব সময় দেয়াল ভাঙার কথা বলে। তাই তানভীর পিঙ্ক ফ্লয়েডের বাড়ির নকশা করেছেন দেয়াল ছাড়াই

 ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’ ষাট ও সত্তরের দশকের সাইকোডেলিক রক মিউজিক আর প্রগ্রেসিভ রক মিউজিকের জন্য বিখ্যাত এক ব্রিটিশ ব্যান্ড। দার্শনিক চিন্তাধারায় প্রভাবিত এই ব্যান্ডটি লাইভ মিউজিকের এক নতুন ধারার প্রবর্তক। স্টেজে আলো নিয়ে খেলা, অ্যালবামের প্রচ্ছদে নান্দনিকতা, ক্লাসিক্যাল রক কম্পোজিশন, সাউন্ড ইফেক্ট ইত্যাদি ব্যান্ডটি দিয়েছে নতুন এক মাত্রা। আমেরিকার সাউথ ক্যারোলাইনার বিখ্যাত ব্লুজ গায়ক গিটারিস্ট পিঙ্ক এন্ডারসন এবং  ব্লুজ গায়ক ও গিটারিস্ট ফ্লয়েড কাউন্সিল—এই দুজনের নাম পাশাপাশি করে ব্যান্ডের নাম রাখা হয় ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’।

পিঙ্ক ফ্লয়েড ব্যান্ডের সদস্যরা
পিঙ্ক ফ্লয়েড ব্যান্ডের সদস্যরা

পিঙ্কের জন্মের পরে বাবা মারা যান আর মা ছিলেন অতিরিক্ত শাসনপ্রিয়। বাবাবিহীন শিশুবেলা, মায়ের অন্তর্মুখী মনোভাব, দেশের জন্য যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করা বাবাকে দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেটে রাবার স্ট্যাম্প সাঁটিয়ে দিয়ে দেশের রাজার দায়িত্বের পরিসমাপ্তি, স্কুলে শিক্ষকদের তিরস্কারপূর্ণ নিষ্ঠুর আচরণ, এমন ঘটনা পিঙ্কের কিশোর মনকে ব্যথিত করে। অবিশ্বাস, নিষ্ঠুরতা, পেশাগত জগতে ব্যর্থতা, ড্রাগে আসক্তির কারণে সম্পর্কগুলো নষ্ট হতে থাকে। কনসার্টের পারফরমেন্সকে সে একজন নব্য নাজি-শাসকের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। ‘রান লাইক হেল’ অথবা ‘কম্ফোর্টম্বলি নাম্ব’ গান দুটি এই দর্শক-পরিবেশকের সম্পর্কের রূপক উপস্থাপন। আর এ সবকিছুই ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে ‘ওয়াল’-এর গানগুলোর মাধ্যমে। আস্তে আস্তে সে নিজেকে গুটিয়ে নেয় একটি দেয়ালের আড়ালে। স্ব-আরোপিত ‘দেয়াল’ এখনে রূপক অলংকার, যা সমাজ থেকে পিঙ্কের অন্তরণ, বিচ্ছেদ তথা তার নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বজনিত বিষণ²তাকে প্রকাশ করে।

পিঙ্ক ফ্লয়েড ব্যান্ডের রোমানিয়ায় যাত্রা উপলক্ষে ‘ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন ইন আর্কিটেকচার’ এবং বিখ্যাত রোমানিয়ান স্থাপত্য ম্যাগাজিন  আতেলিয়েরুল দে  প্রোয়েচার  আয়োজন করে ডিজাইন কর্মশালা। কর্মশালাটির নাম ‘আ হাউস ফর পিঙ্ক ফ্লয়েড’। এখানে এমন সব বাড়ি বানাতে হবে, যেখানে থাকবেন পিঙ্ক ফ্লয়েড সদস্যরা। সেখানে সারা পৃথিবীর স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারবেন। সেখানেই বাংলাদেশের তানভীর হাসান অংশ নিয়ে সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছেন।

তানভীর হাসান
তানভীর হাসান

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি)-এর স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্র, পিঙ্ক ফ্লয়েডের মস্ত ফ্যান তানভীর খবরটা পেয়েছিলেন ফেসবুকের মাধ্যমে। কিন্তু কাজ নিয়ে যখন বসলেন, তখন দেখেন সময় প্রায় শেষ। নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল তাঁর। কেন যে খেয়াল করেননি। মেজাজটা ঠান্ডা হতে আবারও শেষদিন গিয়ে পড়লেন নিয়মাবলি। পরেরটুকু শুনুন তানভীর হাসানের মুখেই—‘কী করব ভেবে না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়লাম ফেসবুকে। ভালো করে পড়ার পর মনটা খুশিতে নাচতে লাগল। ১০ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে ডিজাইন জমা দেওয়ার সময়সীমা।’

এরপর তিনি দিন-রাতের হিসাব ভুলে লেগে গেলেন ডিজাইন তৈরিতে। কয়েক দিনের মধ্যেই মনে একটা তৃপ্তির ঢেকুর ওঠে কাজ তো প্রায় শেষ। এমন সময় হঠাৎ ক্রাশ করল হার্ডডিস্ক। সেদিনই ছিল প্রতিযোগিতায় ডিজাইন জমা দেওয়ার শেষদিন। তবে হতাশায় মুষড়ে পড়লেন না তানভীর। দুর্ঘটনার কথা জানিয়ে ই-মেইল করলেন কর্তৃপক্ষ বরাবর। কিন্তু চিন্তা একটাই, তারা কি সময় বাড়াবে? তানভীর ভাবছেন আর ভাবছেন। এমন ভাবতে ভাবতেই কিছুক্ষণ পর পেলেন ফিরতি মেইল। তাতে লেখা ‘বিশেষ বিবেচনায় তানভীরের সময় বাড়িয়ে দেওয়া হলো দুই দিন। তবে অবশ্যই এ সময়সীমার মধ্যে ডিজাইন জমা দিতে হবে।’ আবার নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজে লেগে গেলেন তানভীর। কিন্তু যেটা করা ছিল অর্থাৎ মূল ডিজাইনের অনেক তথ্যই ভুলে গেছেন এর মধ্য। তাই ভালো হলো না প্রথমটার মতো। তার পরও কাজটি শেষ করে ফেললেন এবং পাঠিয়ে দিলেন। এরপর অপেক্ষার পালা। আগস্টের (২০১৩ সাল) শেষে সুসংবাদটা পেলেন তানভীর। সেরা ৩০ ডিজাইনের সংক্ষিপ্ত তালিকায় আছে তাঁর নামটি। কিছুক্ষণের মধ্য খবরটি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে এল চূড়ান্ত খবর। সেখানে ৯ নম্বরে আছে তানভীরের নাম।

যে নকশা নিয়ে এত আলোচনা, এত মাতামাতি সে সম্পর্কে তানভীর বললেন, ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড সব সময় দেয়াল ভাঙার কথা বলে ছিঁড়তে চায় নিয়মের বেড়াজাল। সেই চিন্তা থেকে মনে হলো, দেয়াল ছাড়াই হবে বাড়ি, সঙ্গে প্রকৃতির যোগাযোগ।’ এই থিমটি তুলে ধরতে মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করলাম বাংলাদেশের সহজলভ্য বস্ত্ত বাঁশ। ‘বাঁশ দিয়ে নকশা করা। এর ফলে বাইরে থেকে দেখা যাবে না ভেতরটা। তবে ঠিকই আলো-বাতাস আসবে। আবার ভেতর থেকে দেখা যাবে বাইরেরটাকে।’ সেটার সঙ্গে যোগ হয়েছে নান্দনিকতা, আধুনিকতার ছোঁয়া। একটা প্রাকৃতিক আবহ তৈরি হয়েছে। আর এ অনন্য বৈশিষ্টে্যর কারণে শত দুর্বলতা সত্ত্বেও সেরা দশের তালিকায় স্থান পেয়েছে বলে মানেন তানভীর।

তানভীর এখন দশম সেমিস্টারের ছাত্র। নেশা তাঁর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। প্রতিটি থেকেই কিছু না কিছু শিখেছেন। সে শেখার পালাই এনে দিয়েছে এই আন্তর্জাতিক সম্মাননা। তানভীরের ডিজাইনসহ সেরা ১০টি ডিজাইন ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে রুমানিয়ার  আতেলিয়েরুল দে প্রোয়েচার  ম্যাগাজিনে। রোমানিয়ায় আয়োজন করা হয়েছিল ডিজাইনের প্রদর্শনী। এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পিঙ্ক ফ্লয়েডের কনসার্টে প্রদর্শিত হবে ডিজাইনগুলো।