বিতর্ক লড়াকু মোডে ইংরেজি, বাংলা ও মাদ্রাসাব্যবস্থা

কে কোন মাধ্যমে পড়ছে সেটা নিয়ে লড়াই না করে কে কতটা দুনিয়া জানতে পারছ, সেটাই হোক মুখ্য।
মডেল: ফাতিমা ও সুমাইয়া | অলংকরণ: নামিস্তা তাবাসসুম

আমার দুই ভাগনি বাসার কাছেই একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। সেদিন তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ক্লাসের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তারা গড়গড় করে ইংরেজিতে কী কী জানি ছড়া বলা শুরু করল। আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, চমৎকার হয়েছে। এবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতা বল তো। ঠোঁট উলটে একজন জবাব দিল, রবীন্দনাট আবার কে?

আমার এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে অনেকেই হাত-পা নেড়ে দারুণভাবে একমত প্রকাশ করবেন। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে ছেলেমেয়েরা কত খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তাদের দেশাত্মবোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে যথেষ্ট লেখালেখি আমাদের চোখে পড়ে। দিন দিন বাংলা, ইংরেজি আর মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তর্কবিতর্ক বাড়ছে, অনেকটা চিরায়ত বিভেদ মনে করে এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট আলোচনাও হচ্ছে না।

সেদিনের অভিজ্ঞতা বলি। বাচ্চাদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় গিয়ে দেখি এক বাচ্চা তাদের পাশের বাচ্চার সঙ্গে চিৎকার করে ঝগড়া করছে। একজন ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে, অপরজন বাংলা মাধ্যমে। একে অপরকে যুক্তিতর্ক এবং চোখের জল ফেলে বোঝানোর চেষ্টা করছে কার ক্লাসের পড়া কতটা কঠিন, তাদের অঙ্ক ক্লাসে যেসব জটিল ফর্মুলাগুলো যে পারে, সে-ই আসল পণ্ডিত। দুঃখের বিষয় হলো, তাদের মায়েরাও তর্ক করছে। ‘জানেন, আমার বাচ্চার ক্লাসে এখনই জ্যামিতি শেখানো হচ্ছে। আপনাদের ইংলিশ মিডিয়ামে তো এখনো নামতা মুখস্থ চলছে। আপনি কীভাবে বুঝবেন আমার ছেলে কতটা ট্যালেন্টেড। ও অঙ্ক পারে আবার আর্টও করে।’ এমনিতেই আমাদের সমাজে নানা ধরনের বিভেদ, তার ওপর যদি কে কোন মাধ্যমে পড়াশোনা করে তা দিয়ে সে খারাপ নাকি ভালো, তার কতটুকু মেধা আছে সেটি যাচাই করা শুরু হয়ে যায়, তাহলে তো মহাবিপদ।

আমি নিজে সারা জীবন ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করেছি। আমার অনেক বন্ধু আর সব ভাইবোন বাংলা মাধ্যমে পড়েছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই তর্কের আগুনে আমাকে বহুবার কেরোসিন ঢালতে হয়েছে। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় একদিন টিফিন পিরিয়ডে গভীর মনোযোগে জাফর ইকবালের ‘টুকুনজিল’ পড়ছিলাম। আমার সহপাঠী ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি বাংলা বই পড়ছ কেন? আমি জবাব দেওয়ার আগেই সে ভেংচি কেটে ‘তুমি খ্যাত! তুমি খ্যাত!’ বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার কয়েক দিন পর বাসার বারান্দায় হাত-পা ছড়িয়ে রোয়াল্ড ডালের ‘মাটিল্ডা’ পড়ছিলাম। আমার খালাতো ভাই চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই! তুই ইংলিশ বই পড়িস ক্যান? বাংলা পারিস না?’ সেদিনও কিছু বলার আগে ভাইয়া আমার মায়ের কাছে নালিশের ভঙ্গিতে বলা শুরু করল, ‘দেখেছেন খালা! ও পুরো বিদেশি হয়ে যাচ্ছে। কয়েক দিন পর ওর জন্য আমাদের ডিকশনারি মুখস্থ করতে হবে।’ আমি ছোটখাটো মানুষ, এভাবে ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনায় আমি ভয়াবহ ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’-এ মুষড়ে পড়েছিলাম। আমি তো ভাবতাম বই পড়াটা মুখ্য।

প্রতিটি স্কুল-কলেজে নানা ধরনের ছাত্রছাত্রী থাকে। কেউ পরীক্ষায় ফেল করে, কেউ বিতর্ক করে, কেউ বিজ্ঞান খুব ভালো পারে। তার মানে এই না যে কারও একার কাজের কৃতিত্ব অথবা দোষ বাকিদের ওপর এসে পড়বে। এখানে স্কুল কতৃ‌র্পক্ষের দায়িত্ব যেমন ছেলেমেয়েদের দিকনির্দেশনা দেওয়া, ঠিক তেমন বাবা-মায়ের দায়িত্ব তাদের সন্তানদের ক্লাসরুমের বাইরের পৃথিবী চিনিয়ে দেওয়া। আমার ভাগ্য খুব ভালো, আমার নানার বিশাল লাইব্রেরি ছিল। তার লাইব্রেরিতে বসে আমি লিও টলস্টয় ও সমরেশ মজুমদার পড়েছি। আমার রসায়ন বইয়ের ফাঁক দিয়ে টিনটিন উঁকি মারত, কানে গুঁজে রাখা ওয়াকম্যানে জন লেননের পাশাপাশি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর ওয়ারফেজের গান বাজত। এগুলোর প্রতি যত না আমার আগ্রহ ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহ আমি বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। তারা কখনো আমার ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেননি। শুধু বাসা ভর্তি বই, গানের অ্যালবাম আর সিনেমা রেখেছেন। দুপুরের পর যখন কিছু করার থাকত না, আমি এগুলো ঘেঁটে বের করেছি, এক এক করে সব পড়েছি, শুনেছি, দেখেছি।

আরও পড়ুন

এটিও জানিয়ে রাখা ভালো, ইংরেজি মাধ্যমে ক্লাসের পড়া একেবারেই সহজ নয়। বাকিদের যেমন গাদা গাদা পরীক্ষা দিতে হয়, যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে, তাদেরও সিস্টেম অনুযায়ী গাদা গাদা পরীক্ষা দিতে হয়। সারা বছর ফাঁকি দিয়ে পরীক্ষার আগের রাতে তারাও প্রচুর ফর্মুলা মুখস্থ করে, হলে বসে মাথা চুলকায়, রেজাল্ট খারাপ হলে হাউমাউ করে কাঁদে। পাঠ্যবইয়ের তালিকায় জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি , আনিসুল হকের মা আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আছে। কবিতার আট লাইন মুখস্থ করে তাদেরও ঘাম ঝরিয়ে হরহর তা আওড়াতে হয়। ফেল করলে বাবা-মা মোটেও তাদের আইসক্রিম কিনে দেয় না, মার দিয়ে দাঁত ফেলে দেয়। এত বিত্তবান সবাই নয় যে চাইলে বিদেশ ভ্রমণ করবে, বরং সবার মতো তাদের গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে জোর করে নাচ-গান-আবৃত্তির কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। ক্লাস টেনে না ওঠা পর্যন্ত কারোরই হাতে মুঠোফোন দেওয়া হয় না।

অপরদিকে বাংলা মিডিয়ামে যারা পড়ে, তাদের অনেকের ফ্যাশন সেন্স যেমন দুর্দান্ত, তেমন উৎসাহ নিয়ে তারা এলিয়ট, ডিকেনস, মার্কেজ পড়ে ফেলেছে। সৃজনশীলতার দিক থেকে তারা পশ্চিমা বিশ্বের অনেকের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে, এই মাসের বিলবোর্ড চার্টের শীর্ষে থাকা শিল্পীদের গান সবার আগে তাদের শোনা।

পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে আসলে মাধ্যমের কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। আমাদের জানার চেষ্টার অভাব আর বোঝার ভুল আছে। স্কুলের কারণে কেউ বিশেষভাবে দুষ্টুমি করে না, বরং ভালো বই, সিনেমা, গান আর বন্ধুদের সঙ্গ না পাওয়ার কারণেই আমরা অনেকে বখে যাই। প্রতিটি ব্যবস্থায় ভালো-মন্দ আছে। তাই ভিকারুননিসার মতো ভালো ফলাফল না করার কারণে যেমন একচেটিয়া বাকি স্কুলদের এবং বাংলা মাধ্যমকে আস্তাকুঁড় ডাকা হয় না, সেভাবে পাড়ার কিন্ডারগার্টেনগুলো বেশি পয়সা নিয়ে কিছু পড়ায় না বলে সমগ্র ইংরেজি মাধ্যমকে ডাস্টবিন খেতাব দেওয়াটাও ঠিক না।

আমরা হয়তো জানি না, বাংলা মাধ্যম থেকে পাস অনেক ছেলেমেয়েরা ভারতীয় আর চায়নিজদের টেক্কা দিয়ে এমআইটি-হার্ভার্ডে ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। অপরদিকে ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা বুয়েট, মেডিকেল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। অমিয়া আতাহার ঠিক তেমনই একজন। সানবিমস স্কুল থেকে পাস করে সে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে পড়ছে। ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আর বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থার মূল পার্থক্য ধরন। অর্থাৎ আমরা একধরনের প্রশ্নে অভ্যস্ত যা প্রথম দিকে আমার রপ্ত করতে বেশ পরিশ্রম হয়েছিল। এখন তা পারি, এটাও বুঝি যে আসলে আমাদের মাধ্যমগুলোতে সবই পড়ানো হয়, খুব একটা পার্থক্য নেই।’ ছড়াকার অনিক খান সাউথ ব্রিজে পড়াশোনা করেছেন। তিনি বললেন, ‘যখন নিজ নিজ স্কুল নিয়ে আমরা তর্ক করি, তার হয়ে লড়াই করি, সেইটা আমাদের স্কুলের প্রতি একটা ভালোবাসা থেকে করি। কিন্তু ইংরেজি বনাম বাংলা বনাম মাদ্রাসা আমার কাছে নেপলিওন পদ্ধতির খুব অদ্ভুত ব্যবহার মনে হয়। আমার বিশ্বাস, আজকালকার ছেলেমেয়েরা স্মার্ট, তারা এসব বিভেদের ধার ধারে না। চোখ-কান খোলা রাখলে, অনেক পড়লে আর মানুষের সঙ্গে মিশলে দেখা যাবে আমাদের এই সমস্যা দূর হয়ে যাচ্ছে।’ অপরদিকে আইনজীবী তানজীম উল আলম সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী। চট্টগ্রাম জামিয়া আহমাদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করে তিনি বাইরে গিয়ে আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর মতে, ‘আমরা ঝকঝকে দেয়ালের ক্লাসরুমে পড়ি কিংবা গাছের নিচে পড়ি, মূল ব্যাপার আমরা নিজেরা সেই শিক্ষা দিয়ে কী করছি। এ ক্ষেত্রে মাধ্যমের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমরা যা শিখছি, তা কতটুকু বাস্তব কাজে লাগাচ্ছি, কতটুকু চারপাশ দেখে শিখছি।’ বাংলাদেশের প্রথম ফর্মুলা রেসার মাহফুজুর রহমান তুষার একজন মাদ্রাসার ছাত্র। কাজেই সবাইকে এক কাতারে ফেলে দেওয়া বোধ হয় ভালো কোনো সিদ্ধান্ত হবে না।

আরও পড়ুন

আমাদের একেক জনের মত প্রকাশের মাধ্যম একেক রকম। এখানে আমাদের ভাষা যা-ই হোক না কেন, আমরা সবাই কিন্তু এক। সুযোগ পেলে আমরা সবাই কিছু না কিছু একটা করতে পারব। বাংলাদেশকে আমরা সবাই ভালোবাসি, যে যার কাজ দিয়ে তা দেখিয়ে দিতে চাই। ইংরেজি মাধ্যমে আরও বেশি বেশি করে নজরুল যেমন পড়ানো উচিত ঠিক তেমন বাংলা মাধ্যমে ই ই কামিংসের কবিতা থাকলে মন্দ হয় না। আমাদের দেশের কোনো মাধ্যমের পড়াশোনার ধারাই যথেষ্ট নয়, প্রতিটি সিস্টেমে ত্রুটি আছে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি ত্রুটি আছে আমাদের ভাবনায়, আমরা যেভাবে আরেকজনের সঙ্গে ব্যবহার করি তাতে। এর পর থেকে ঠোঁট উল্টিয়ে কে কোন মাধ্যমে পড়াশোনা করেছ, তা নিয়ে তর্ক না করে জানার চেষ্টা করো তারা তোমার চেয়ে ভিন্ন কী কী শিখেছে। তাতে আর যা-ই হোক না কেন, তোমার জ্ঞানের ভান্ডার কমবে না। বরং একটা ভালো বন্ধু পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।