একটা বিমান, দুটো গল্প

 গল্প: ১

 ঠিক মাঝরাত।

তুমুল গর্জন করে চালু হয়ে গেল বোয়িংয়ের ইঞ্জিন। সিটবেল্ট বেঁধে ওড়ার অপেক্ষায় থাকা সাধারণ যাত্রীরা অবশ্য এই শব্দের শতাংশও টের পেলেন না; টের পাওয়ার কথাও নয়। এই স্বাভাবিক শব্দ তো দূরে থাক, আসলে অধিকাংশ যাত্রী অনেক অস্বাভাবিক ঘটনাও টের পেলেন না। তাঁরা টেরও পেলেন না, ১০ বছর ধরে পৃথিবীর গোপন এক গবেষণাগারে তৈরি এক বিশেষ ধরনের নামকাওয়াস্তে বোয়িংয়ে চেপে বসেছেন তাঁরা। যাত্রীরা শুধু শুনতে থাকলেন একটার পর একটা ঘোষণা—আমরা এখন মালয়েশিয়ার সীমানা অতিক্রম করছি, আমরা এখন ৩৫ হাজার ফুট উচ্চতায়।

এর মধ্যে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। যাত্রীরা শরীর এলিয়ে দিয়েছেন। এখন অপেক্ষা শুধু আরেকবার সিটবেল্ট বেঁধে ল্যান্ডিংয়ের ঘোষণা শোনার। আর কোনো দিকেই মন নেই কারও, থাকার কথাও নয়।

কিন্তু যদি কেউ বিশেষ করে নজর দিতেন যাঁর যাঁর সিটের দিকে, একটা অভিনব ঘটনা দেখতে পেতেন। বোয়িংয়ের প্রতিটা সিট একটু একটু করে সামনের দিকে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে; পায়ের নিচ থেকে একটু একটু করে একটা প্লেট সরে গিয়ে নতুন একটা কাঠামো তৈরি হচ্ছে। এত ধীরে ঘটছে ঘটনাটা, তার কোনো প্রভাব যাত্রীদের ওপর পড়ছে না। প্রভাব পড়ার কথাও নয়।

ঠিক এই সময়ে পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা অতিদৃষ্টিসম্পন্ন কোনো মানুষ যদি রাতের আকাশে ৩৫ হাজার ফুট ওপরে দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি দেখতেন এক যুগান্তকারী দৃশ্য—একটা আস্ত বোয়িং বিমান লেজের দিকটা নিচে দিয়ে আস্তে আস্তে পুরো খাড়া হয়ে যাচ্ছে।

তখনো জেট ইঞ্জিনগুলো চালু আছে। আর খুব বেশিক্ষণ চলবে না। তাই বোয়িং বিমান এবার চেহারা বদলাতে শুরু করল। লেজের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল রকেট ইঞ্জিনের নারকীয় গর্জন। দুম করে একটা লাফ দিয়ে উঠল বিমানটা।

যাত্রীরা এবার একটু চমকে উঠলেন।

পাইলটের শান্ত কণ্ঠ শোনা গেল, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই, প্রিয় যাত্রীরা। আমরা একটা এয়ার পকেটে পড়েছিলাম মাত্র।’

পাইলট অবশ্য আসলে শান্ত থাকতে পারছেন না। আর খুব বেশি সময় নেই। কৃত্রিম মহাকর্ষ চালু করে দিতে হবে, ভেতরের ২০ বিজ্ঞানীকে সংকেত পাঠাতে হবে। বিজ্ঞানীরা কাজ শুরু করবেন। আর তাঁর কাঁধে সবচেয়ে কঠিন দায়িত্ব—প্রায় ২০০ সাধারণ মানুষকে অভিযানটা সম্পর্কে বুঝিয়ে বলতে হবে।

বলার ব্যাপারটা খুবই কঠিন হলেও অভিযানের আইডিয়াটা খুব কঠিন নয়; খুব বড় পথও তাঁদের পাড়ি দিতে হবে না—পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহ; সামান্য পথ মাত্র!

বড় করে নিঃশ্বাস নিলেন পাইলট। যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার আগে দুটো কাজ করতে হবে। মহাকাশ অভিযান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে এক অ্যাস্ট্রোনটকে; তিনিই এখন থেকে দলনেতা হবেন। দ্বিতীয় কাজটা হলো, পৃথিবীর সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া। তার আগে একবার কথা বলে নেবেন না? একবার অন্তত।

যোগাযোগ মডিউলটা চালু করলেন পাইলট। সব বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার আগে একটা কথাই বললেন, ‘সবকিছু ঠিক আছে, শুভরাত্রি।’

বলা উচিত ছিল, শুভবিদায়!

 গল্প: ২

 চীন-জাপান, ভারত-পাকিস্তান, আমেরিকা-রাশিয়া রোজকার তপ্ত কথার লড়াই। আজ এখানে গাড়িবোমা, কাল ওখানে ড্রোন। সকালে দিল্লিতে গুলি, বিকেলে সোমালিয়ায় না খেয়ে মৃত্যু।

আর এভাবে ভালো লাগে না।

একদিন ভদ্রলোক ভাবলেন, কিছু একটা করতে হবে। কী করা যায়? একটা নতুন রাজ্য, কল্পরাজ্য গড়ে তুলতে হবে, যেখানে শুধু মানুষ থাকবে; ড্রোন থাকবে না, বোমা থাকবে না, মৃত্যু থাকবে না। থাকবে শুধু বিজ্ঞান আর ভালোবাসা।

এমন রাজত্ব কাদের নিয়ে করা যায়?

পৃথিবীর বাছাই করা লোকেদের সঙ্গে ফেসবুক আর ফোনে তৈরি হলো যোগাযোগ। কেউ আমেরিকার, কেউ চীনের, কেউ ইরানের, কেউ ইতালির। এক জায়গায় মিললেন এক ঝাঁক ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং এক ঝাঁক শিল্পী। সব মিলিয়ে ২২৭ জন মানুষ। একে একে পৌঁছালেন তাঁরা। পৌঁছে গেল দুনিয়া কাঁপানো সব প্রযুক্তি আর শিল্প-উপকরণ। উঠল সেগুলো বিমানে। আর উঠলেন তাঁরা।

স্বপ্নের মানুষগুলোকে নিয়ে আকাশে ডানা মেলল মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০!

শুরুতে বিমানের ক্রুরা ও পাইলট বড় গাঁইগুঁই করছিলেন। একবার যখন দেখলেন সব সিগন্যাল মেধাবী এই দলটা বন্ধ করে দিয়েছে, তাঁরা কথা শুনলেন। একসময় তারাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। চললেন সবাই মিলে সেই রাজত্ব তৈরি করবেন বলে; মহাসাগরের বুকে এক পায়ের চিহ্ন না পড়া দ্বীপে।

ঘটনার চার দিন পার হয়ে গেছে। রাজত্বে টিভি-ইন্টারনেট সব চালু করে ফেলা হয়েছে। প্রথম সেই ভাবা মানুষটি উদাস হয়ে সাগরপারে বসে আছেন। এক তরুণ বিজ্ঞানী ছুটে এলেন, ‘আমরা তো শুরু না করতেই সফল।’

‘কেমন?’

‘এই দেখুন, আমাদের খঁুজতে চীন আর আমেরিকা, ইরান আর ব্রিটেন, ভিয়েতনাম আর কোরিয়া; সবাই হাত মিলিয়েছে; ভুলে গেছে শত্রুতা। কে বলে, এই পৃথিবীর আশা নেই?’

‘আশা তো অবশ্যই আছে। শুধু স্বপ্নটা দেখতে পারতে হবে।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল