ক্রিস গেইলের সঙ্গে এক বিকেল

১৭ মার্চ, বিকেল চারটা। বিশ্বকাপের রীতি অনুযায়ী, হোটেল রূপসী বাংলায় চলছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ‘উন্মুক্ত মিডিয়া সেশন’। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে শীর্ষ কয়েকজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সাংবাদিকদের একান্ত আলাপচারিতার সুযোগ করে দেয় প্রতিটি দল। একটু আগে কথা বলে গেলেন টি-টোয়েন্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্যতম সফল বোলার সুনীল নারাইন। আমরা ১০ থেকে ১২ জন দেশি-বিদেশি সাংবাদিক অপেক্ষা করছি পরবর্তী খেলোয়াড়ের জন্য।

ঠিক এ সময় দরজা পেরিয়ে প্রবেশ করলেন দীর্ঘদেহী একজন। উপস্থিত সবার উৎসুক দৃষ্টি তাঁর দিকে। যিনি আসছেন, তিনি যে টি-টোয়েন্টির সবচেয়ে আদর্শ ব্যাটসম্যান। ‘মুডে’ থাকলে ২২ গজে রীতিমতো ক্যারিবিয়ান ঝড় তোলেন! নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বোলারদের যেভাবে পিটিয়ে ছাতু করেন, মনে হতে বাধ্য, টি-টোয়েন্টির জন্মই তাঁর জন্য! ঠিকই, তিনি ক্রিস গেইল! তাঁকে বলা হয় বিনোদনের এক উত্তম প্যাকেজ—সে হোক মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপই যেন দর্শনীয়। সাংবাদিকদের গুরুগম্ভীর প্রশ্নে গেইলের হাস্যরসাত্মক সব উত্তর মুহূর্তেই মিডিয়া সেশনও রূপ নিল ঘরোয়া আড্ডায়। যেন গেইলের বাড়ির উঠোনে এক অলস বিকেলে ধূমায়িত চায়ের কাপ হাতে ধুমসে আড্ডা দিচ্ছি আমরা কজন!

ব্যাট হাতে রুদ্র রূপের পাশাপাশি খণ্ডকালীন বোলার হিসেবে অফ স্পিনটাও মন্দ করেন না। বাংলাদেশের উইকেটও যথেষ্ট স্পিন-সহায়ক। তা ছাড়া বেশ কদিন বল হাতে গেইলকে দেখা যাচ্ছে না—একজন এটা বলতেই ভীষণ অবাক হলেন। বললেন, ‘বলছেন কী? আই অ্যাম দ্য বেস্ট স্পিনার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ম্যান! বুঝতে পারছি, বেশ কিছুদিন বল করছি না বলে আমাকে মিস করছেন!’ অমনি সাংবাদিকদের মধ্যে হাসির হুল্লোড়।

দুর্দান্ত টাইমিং আর প্রচণ্ড গায়ের জোরে ধুমধুাম পিটিয়ে বল পাঠিয়ে দেন সীমানার বাইরে। কখনো তা আছড়ে পড়ে দর্শক গ্যালারিতেও! এমনিতেই টি-টোয়েন্টিতে নিত্যনতুন শটের আবির্ভাব হয়। জিজ্ঞেস করা হলো, ব্যাটিংয়ে গেইলের এমন কোনো উদ্ভাবন আছে কি না। বললেন, ‘নতুন একটা শট বের করেছি। এখন থেকে বাঁ হাতে নয়, ডান হাতে ব্যাটিং করব!’ মুহূর্তেই হাসির রোল পড়ল সবার মাঝে। সঙ্গে গেইলও যেভাবে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসলেন, সেটিও কম বিনোদিত করল না উপস্থিত সাংবাদিকদের। নিশ্চয় মনে আছে, গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপে জিতে গ্যাংনাম নেচেছিল গেইল ও তাঁর দল। তো এবার...প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়েই বলেন, ‘ছিলেন কোথায় এতক্ষণ! মাত্রই পাশের রুমে নতুন নাচ দেখালাম! আচ্ছা, পরে টিভিতে দেখে নেবেন।’

যশ-খ্যাতি, অর্থ-বিত্তে গেইল বিশ্বের শীর্ষ ক্রিকেটারের একজন। কিন্তু তাঁর এ উঠে আসার পেছনে অবদান রয়েছে নিজের শহর জ্যামাইকার কিংসটনের বিখ্যাত লুকাস ক্রিকেট ক্লাবের। মূলত এ ক্লাবটিই বদলে দিয়েছে তাঁর জীবন। গেইল এখনো কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেন ক্লাবটিকে। প্রায়ই নাকি বলেন, ‘যদি লুকাসে না খেলার সুযোগ পেতাম, জানি না আজ কোথায় থাকতাম; হয়তো পথে।’ ব্যক্তি গেইলের মনটাও কিন্তু ক্যারিবিয়ান সাগরের মতোই বিশাল। নিজের শহরে নবনির্মিত একটি স্কুল আর্থিক অভাবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি কিনতে পারছিল না। শুনে সঙ্গে সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন গেইল। গত বছর স্কুলটিতে শিক্ষা ও খেলাধুলার সরঞ্জামাদি, সঙ্গে একটি টেলিভিশন সেট কিনে দিয়েছেন। যখন খেলা থাকে না, পছন্দ করেন ভিডিও গেমস খেলতে। পছন্দ করেন টিভিতে  টম অ্যান্ড জেরি  কাটু‌র্ন দেখতে। গেইল মানুষকে যেমন বিনোদন দেন, তেমনি নিজেও প্রতিমুহূর্ত উপভোগ করেন জীবনটাকে।

মাত্র ১৪ মিনিটের ব্যতিক্রমধর্মী হাস্যরসে ভরপুর মিডিয়া সেশন শেষে উঠে পড়লেন গেইল। এ সময় তাঁর পিছু নিলাম। যদিও কোনো খেলোয়াড়ের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ নেই। তবু হাল ছাড়লাম না। ‘গেইল’ বলে ডাকতেই পেছনে তাকালেন। বললাম, ‘কিশোর আলো’ নামে আমাদের একটি কিশোর ম্যাগাজিন আছে। তোমার প্রচুর ভক্তও এই ম্যাগাজিনটির পাঠক। তুমি কী একটা অটোগ্রাফ দেবে তাদের জন্য?’ গেইল ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। বোঝা যাচ্ছিল, ‘কিশোর আলো’ শব্দদ্বয় তাঁর জন্য কতটা দুর্বোধ্য। তাঁকে বোঝালাম, এটা চিলড্রেন অ্যান্ড টিন ম্যাগাজিন। তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে বললেন, ‘বুঝেছি। কোথায় দেব তা বলো।’ বললাম, ‘ফর কিশোর আলোর নিচে দাও।’ অমনি গেইল একটা অটোগ্রাফ দিয়ে দিলেন, শুধু তোমাদের জন্য!