ল্টোউ রশেদে ল্পগ

 পরীক্ষার রেজাল্ট হাতে নিয়েই ভ্যা করে কেঁদে দিল ক্রিৎমৃৎ। ল্টোউ শদে নামের এই দেশটির ইতিহাসে এত ভয়াবহ খারাপ রেজাল্ট এর আগে কেউ করেনি। এখনো সাংবাদিকেরা নিশ্চয়ই খবর পায়নি। পেলে পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসবে ক্যামেরা নিয়ে। ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলতে থাকবে, যারা পত্রিকায় কাজ করে। আর টিভি সাংবাদিকেরা মাইক্রোফোন বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করবে, ‘আচ্ছা, তোমার এই ভয়াবহ খারাপ রেজাল্টের কারণ কী? তুমি দিনে কয় ঘণ্টা পড়ো? কী খাও? তোমার রুটিনটা আমাদের বলবা প্লিজ?’

ক্রিৎমৃৎ আর কী বলবে! সে নিশ্চয়ই আরও একবার ভ্যা করে কেঁদে দেবে। সেই কান্নার ছবি পরদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপা হবে। লাইভ দেখাবে সব টিভি চ্যানেল। ছি ছি, কী লজ্জার!

ক্রিৎমৃতের ইচ্ছা করছে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে। এই রেজাল্ট নিয়ে সে মুখ দেখাবে কী করে! সব বিষয়েই ক্রিৎমৃৎ ১০০-তে ১০০ করে পেয়েছে। কেবল অঙ্ক পরীক্ষায় ১০০-তে পেয়েছে ১০১, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য দেওয়া হয়েছে বাড়তি এক নম্বর। ফলে দেখা গেল, মোট ৫০০ নম্বরের পরীক্ষা। আর ক্রিৎমৃৎ পেয়ে বসে আছে ৫০১!

নিজে খারাপ করেছে জন্য যতটা না দুঃখ হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে মুল্টুৎটা ফার্স্ট হয়েছে বলে। মুল্টুৎ ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। নিজে পরীক্ষায় খারাপ করলে যতটা না সমস্যা, তার চেয়ে বেশি সমস্যা সবচেয়ে কাছের বন্ধুটা পরীক্ষায় ভালো করে ফেললে। বুকের মধ্যে কেমন জানি চিনচিন করে। এ এক অসহ্য জ্বালা। যার কখনো হয়নি, কোনো দিনই সে বুঝবে না।

ক্রিৎমৃতের কষ্টটা আরও বেড়ে যাচ্ছে এই দেখে, মুল্টুৎ আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কেমন মিটিমিটি হাসছে! এই কি তবে বন্ধুত্বের নমুনা! এ জন্য রোজ তোকে টিফিনের ভাগ দিই! আর কপালও বটে ওই নচ্ছারটার। ক্রিৎমৃৎ যেমন এবার ল্টোউ শদে নামের এই দেশটার ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ রেজাল্ট করেছে, মুল্টুৎও করেছে ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট। ৫০০ নম্বরের মধ্যে ও পেয়েছে ‘মাইনাস ১’। শূন্যই পেত। কিন্তু হাতের লেখা এত বিচ্ছিরি, বাংলায় ১০০-এর মধ্যে ওকে দেওয়া হয়েছে শূন্যরও এক নম্বর কম। এর আগ পর্যন্ত ল্টোউ শদে নামের এই দেশটিতে সবচেয়ে ভালো ফলাফলের রেকর্ড ছিল ৫০০-তে শূন্য। সেই রেকর্ডই ভেঙে দিয়েছে মুল্টুৎ!

সমস্যা আবার অন্য জায়গায়। মুল্টুৎ সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করলে কী হবে, ওকে সবাই যতটা বাহবা দেবে, তার চেয়েও বেশি বাহবা দেবে ক্রিৎমৃৎকেই। ল্টোউ শদে নামের এই দেশটিতে এটাই নিয়ম। যে খারাপ করে, তাকে কেউ বকা দেয় না। বরং অনেক অনেক প্রশংসা করে। এটাই বরং বেশি বিব্রত করছে ক্রিৎমৃৎকে। সবাই বকুনি দিলেই বরং মন খারাপ হতো না। নাহ্‌, পরেরবার জানপ্রাণ খাটিয়ে দিতে হবে। কিছুতেই এত খারাপ ফল করা যাবে না। ক্রিৎমৃৎ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, পরেরবার ৫০০-এর মধ্যে মাইনাস ২ নম্বর পেয়ে বন্ধুর বিশ্ব রেকর্ডই সে ভেঙে দেবেই দেবে।

কিন্তু সে-ও তো চার-পাঁচ বছর পরের কথা। এই দেশে আবার প্রতিবছর পরীক্ষা হয় না। পরীক্ষা হয় চার-পাঁচ বছর পর পর। তবু তো টিচাররা কিছুতেই পরীক্ষা নিতে চান না। বারবার করে বলেন, খামোখা পরীক্ষা নামের এই যন্ত্রণাটা ছোট ছোট বাচ্চাকে দিয়ে কী লাভ! যা শিখছে, এমনিতেই শিখুক না! কিন্তু স্টুডেন্টরাই জোর করে পরীক্ষা দেয়। সেটিও হয় এত দিন পর পর।

তাহলে এখন উপায়? একটা উপায় অবশ্য আছে। মুল্টুৎ খুবই শান্তশিষ্ট (লেজবিশিষ্ট) একটা ছেলে। এ কারণে সব সময় মা-বাবার বকা খায়। আর ক্রিৎমৃৎ যাকে বলে  স্যিদ। পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ানও ওর কাছে নস্যি। খুব দুষ্টুমি করে জন্যই ও সবার প্রিয় পাত্র। সবাই ওকে ভালোবাসে। এই তো সেদিন পাড়ার কিপটে বুড়ো দাদুটা কী রাগটাই না করলেন। বললেন, ‘কিরে, তোরা দেখি আমার বাগানের ফলটল কিছুই চুরি করিস না! কেন, আমার বাগানের আম-জামে কি টেস্ট নেই?’

আরও একটা আশার ব্যাপার আছে। ক্রিৎমৃতের ক্রিকেট দল প্রতিদিনই ম্যাচ হারে। মুল্টুৎদের দল খালি বোকার মতো রোজ রোজ জিতে যায়। ক্রিৎমৃৎরা তাই মজা করে ম্যাচের পরাজয় নিয়ে আনন্দ-উল্লাস করতে পারে। আর মুল্টুৎরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ম্যাচ জিতে মন খারাপ করে বাড়িতে যায়...

কী, অবাক হয়ে ভাবছ, এ কেমন দেশরে বাবা! পরীক্ষায় ৫০০-তে ৫০১ করেছে, সেটাই সবচেয়ে খারাপ রেজাল্ট, আর যে কিনা শূন্যও নয়, মাইনাস ১ পেল—তার রেজাল্টই সবচেয়ে ভালো! তা-ও নাহয় মানা গেল, কিন্তু সেখানে পরীক্ষায় তাদের হিসাবেই সবচেয়ে খারাপ ফলাফল করলেও কেউ বকাবকি করে না! উল্টো অনেক অনেক আদর করে। চকলেট দেয় গিফট হিসেবে! সেখানে টিচাররা পরীক্ষাই নিতে চান না, আর আমাদের সপ্তাহে সপ্তাহে পরীক্ষা দিতে দিতে জান কাবার!

ভাবছ, দুষ্টুমি করার জন্য গতকালই তো মায়ের বকুনি খেলাম। আর দেখো, কী এক অদ্ভুত দেশ। যেখানে বাচ্চাদের সবাই দুষ্টুমিই করতে বলে। বকা দেয় না! সবাই বোঝে, বাচ্চারা দুষ্টুমি করবে না তো কে করবে? পাড়ার দস্যিবাহিনী আম-জাম চুরি করে না খেলেই তাই কিপটে বুড়োর মন খারাপ হয়! আর ম্যাচে হেরে গেলেই সবাই আনন্দ করে!

এটা আবার কোথাকার দেশ? খুলেই তবে বলি। ল্টোউ শদে, মানে হলো উ-ল্টো দে-শ! গুগলে খুঁজলে অবশ্য না-ও পেতে পারো। তবে এই দেশটা থাকে আমাদের প্রত্যেকের ড্রেসিং টেবিলের আয়নার ঠিক ওদিকটায়। সেখানে সবকিছুই উল্টো চলে, তাই দেশের ওমন নাম। জানো তো, এ কারণেই আয়নায় আমরা সবকিছু উল্টো দেখি।

অলংকরণ: রকিবুল হাসান